Header Ads

উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা: পর্ব এক – অনুপ্রবেশ

 পড়ুন উপন্যাস:  সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব এক – অনুপ্রবেশ (ছবিটির নিচে)



নিবেদন: উপন্যাসটির সময়কালের প্রেক্ষাপট

আশির দশকের প্রথম ভাগ। তখন মোবাইল ফোন আসেনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিফোনও ছিল না। তখন চিঠির মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতো সবাই। আর গ্রাম-গঞ্জে পাহাড়ি অঞ্চলে বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল না। এরকম সময়-পরিবেশে যাপিত জীবনের কল্পকাহিনি  নিয়ে গড়া উপন্যাসটি। আশির দশকের সময় পরিবেশ অনুধাবন করে উপন্যাসটির সকল পর্ব পড়তে থাকলে নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে। এটি প্রথম পর্ব।  পড়ার অনুরোধ রইলো।

 

সুপ্রিয়া প্রিয়তমা: পর্ব এক অনুপ্রবেশ

পাহাড় দেখলে কেনো যেনো আমার সাঁওতাল মেয়েদেরকে মনে পড়ে। সাঁওতালরা পাহাড়ি বলে হয়তো। পিচ ঢালা পাহাড়ি রাস্তা। আঁকাবাঁকা, শর্পিল। দুপাশে ছোট বড় পাহাড়। পাহাড়ের উপরে কোথাও কোথাও উঁচু টিলা। গোলাকার। রকম ছোটো ছোটো টিলা দেখতে আমার ভালো লাগে। সাঁওতাল তন্বির বুকের মতো। মাংসল বুকের মতো। মধ্যিখানটায় সুউচ্চ শৃঙ্গ।

রাস্তাটি সামনের পাহাড় থেকে নিচু হয়ে পূব দিকে নেমে গেছে। একদম সোজা। সরল রেখা এঁকে এঁকে।

পাহাড়ি রাস্তায় মোটর সাইকেল চালাতে আমার খুব ভালো লাগে। উঁচু থেকে নিচে নামার সময় অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ফিল করি আমি।

রাস্তার দু'ধারে শাল-সেগুনের সারি। মোটরসাইকেলের মিররে এরা ছোট্ট ছোট্ট প্রতিবিম্ব আঁকে। প্রতিবিম্বগুলো পেছন দিকে দ্রুত গতিতে চলতে চলতে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়।

গতরাতে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। ধুলোহীন সুন্দর রাস্তা। ঝকঝকে তকতকে। নিকষ কালো। মসৃণ। সাঁওতাল মেয়েদের গায়ের মতো।

কিছুক্ষণ আগে সূর্যটা প্রকাণ্ড ছিল। লাল।  রক্তিম।  তবে এখন অনেক উপরে উঠে ছোট্ট হয়ে গেছে। সূর্যরশ্মি উজ্জল, তীব্র। হয়তোবা মেঘ ভাঙ্গা বলে।

আমার মোটরসাইকেলটি পুরনো। প্রচন্ড শব্দ করে। শব্দ করতে করতেই রাস্তায় পাঁজরের চিহ্ন আঁকে। আর দ্রুতগতিতে সামনে এগিয়ে চলে। প্রশ্বস্থ রাস্তা। সামনে সবুজ গ্রাম। পেছনে সবুজ পাহাড়। দুপাশে ফসলের মাঠ। মাঠে ফসল নেই। হলদে সবুজ নানা রকম ঘাস। ছোট্ট ছোট্ট ঝোপালো আগাছা। ঘাস-আগাছায় লাল নীল হলদে রংয়ের ফুল। অপরূপ রূপে শ্যামল সবুজ মাঠ। জ্যৈষ্ঠের শেষে বৃষ্টি রসে প্রমত্তা যৌবনা। সারা অংগে কুমারী মেয়ের মাধুর্য যেনো! মাধুর্য - দেবী বিসর্জনের পূর্বমুহূর্তে দুর্গা দেবীর মাধুরীর মতো। কিছুদিন পরে ঝমঝম করে বর্ষণ নামবে। মাঠের এই বর্ণালী সৌন্দর্য তখন থৈথৈ পানির নিচে বিসর্জিতা হবে!

সামনে সবুজ শ্যামল গ্রাম। রাস্তার দুপাশ দিয়ে কয়েকটি মেয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে। সামনেই স্কুল। মুখ দেখা যাচ্ছে না মেয়েগুলোর। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ। ব্যাগে বই। গলার দুপাশ থেকে পেঁচিয়ে নিচে দোলায়িত ওড়নার ঝুলানো আঁচল। গায়ে আঁটসাঁট কামিজ। পরনে সালোয়ার। পায়ে ক্যানভাসের জুতো। কোমরে চওড়া বেল্ট। হাই স্কুলের ছাত্রী ওরা।

প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রেমিক আমার তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো। চোখ দুটো রাস্তার এপাশ থেকে পাশের মেয়ে দেহের সৌন্দর্য পানে ব্যস্ত হলো। রাস্তার ডান পাশে একটু দূরে ঘন পাতা বিশিষ্ট একটি মেহগনি গাছ। সোজা হয়ে দাঁড়ানো। গাছটি বরাবর এপাশে একটি মেয়ে। কাঁধে লাল রংয়ের ব্যাগ। গায়ে ছাই রঙা কামিজ। পরনে সাদা সালোয়ার। পায়ে ক্যানভাসের জুতো। কাঁধের দুপাশ থেকে দোলানো মোটা দুটো বেণী। নিতম্বের নিন্ম ভাগে এসে দুলছে বেণী দুটো। ফোলা ফোলা গাল। ভারী নিতম্ব। খাটো গলা। চিতানো শরীর। উজ্জ্বল হলুদ রাঙা ত্বক। চিতানো পিঠের পেছনে দোলায়িত বেনির অগ্রভাগে কৃত্রিম দুটো ফুল। লাল ফিতেয় তৈরি।

মেয়েটিকে চট করে ভালো লাগলো আমার। ভালোলাগা মেয়েদের ভালো করে দেখার ইচ্ছে জাগে। মোটর সাইকেলের গতি কমালাম। মেয়েটির কাছে যেতেই ইচ্ছে করেই চেঁচিয়ে হর্ন বাজালাম। ত্রস্তে পেছন ফিরে তাকালো মেয়েটি। ভয়ও পেল যেনো! স্নিগ্ধ চঞ্চল মুখশ্রী। উজ্জল পেলব বাহুলতা। আঙ্গুর ফোলা টস টসে গাল। নব যৌবনের সৌন্দর্যে ভরপুর যেনো।

এক পলকের দেখা ভালোলাগা মেয়েটি পেছনে রয়ে গেলো মোটর সাইকেলের গতি বাড়ালাম।  শাশাকরে এগিয়ে যাচ্ছে মোটর সাইকেলটি।

মেয়েটির স্নিগ্ধ কোমল মুখখানা আমার রুপালি পর্দায় ছবি হয়ে ভাসতে থাকলো। সারা শরীর জুড়ে একটা ভালো লাগা অনুভূতি রিমঝিমিয়ে বয়ে চললো। মেয়েটির মুখখানাকে কল্পনার চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ করে আমার মনে হলো - কোথায় যেনো তাকে দেখেছি!

ফেলে আসা স্মৃতিগুলোকে কল্পনার হাত দিয়ে হাতরাতে থাকি। দেখি, আমার হৃদয়ের তন্ত্রীতে অসংখ্য স্মৃতির কাঁপন জেগেছে। সেই অসংখ্য স্মৃতির মধ্য থেকে একটি স্মৃতি তার কুঞ্চিত শরীর খুলে খুলে আমার চোখের পর্দায় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে।….

রাজধানীর একটি কারিগরি কলেজের ছাত্র তখন আমি স্নাতকে পড়ি। বিখ্যাত কলেজ সেটি। সে কলেজ থেকে পাশ করা বহু ছাত্র-ছাত্রী তাদের কর্ম কুশলতা দিয়ে প্রথিতযশা হয়েছে। এমনি প্রথিত যশাদের মাঝে স্থান পাবার আশায় টেবিল-বই, বই-টেবিল ছাড়া কিছুই বুঝতাম না আমি। কিন্তু পর পর দুবার পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে দু বছর পর  মনের উৎসাহ উদ্দীপনায় ভাটা পড়লো। মনের দুঃখকে ভুলে থাকার জন্য কোনো একটি পন্থার সন্ধান করলাম। পেয়েও গেলাম। একদল বন্ধুদের সাথে গাঁট বাঁধলাম। বিকেল বেলায় পাশের কলোনিতে সুন্দুরী মেয়েদের দেখতে বেরুনো। অন্যান্য বন্ধুদের সাথে প্রতিদিন বৈকালীন ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তাম। কি বর্ষা, কি শীত ! বিকালে একটু না বেরোলে শান্তি পেতাম না।

আমাদের ছোট্ট পর্যটক দলের প্রথম পদচারণা হতো স্থানীয় সরকারি কলোনিতে। উদ্দেশ্য - বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীদের রুপ-দর্শন। ভদ্র মার্জিত ভঙ্গিতে কলোনির সামনের রাস্তায় ধীরগতিতে পা ফেলতাম। চোখগুলোকে ফোর্টি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বাঁকিয়ে তির্যক দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকাতাম। একটু  প্রেমময় অথবা একটু উৎকট কমেন্ট ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের প্রেমিক মিশন বুক ফুলিয়ে কলোনির সামনের রাস্তা দিয়ে  এগিয়ে যেত। তখন কেনো যেনো মনে হতো প্রথিতযশা হতে আর বেশি দিন বাকি নেই!

বৈকালীন ভ্রমণ ওরফে উৎশৃঙ্খল ঘোরাফেরা শেষ করে প্রতিদিন একবার স্থানীয় বাজারে যেতাম। কলোনির কলোনির পাশে বড় রাস্তার ওপাশেই বাজার। বাজার। কয়েকটি গলি এতে। বাজারের চার নাম্বার গলির ডান পাশের তিনটি দোকান পেরিয়ে চতুর্থ দোকানটি ছিল একজন বুড়োর। বয়স পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন। গৌরবর্ণের লম্বাটে বুড়ো। মাথায় কাঁচা পাকা চুল। কপালে গভীর করে আঁকা বলিরেখা। লম্বা ভ্রুর নিচে কোটরাগত দুটি চোখ। গায়ে হাতাওয়ালা গেঞ্জি। পরনে কম দামের লুঙ্গি। মোদি স্টেশনারি দ্রব্য নিয়ে অপরিপাটি করে সাজানো দোকানটি। সিগারেটও বিক্রি হয় দোকানটিতে। বেচাকেনার ভিড় খুব কম। দোকানের একপাশে ছোট্ট টুলে বুড়ো বসে থাকতো। মাঝে মাঝে একজন কাস্টমার এলে বড় কষ্ট করে উঠে সওদা দিতো। পয়সা নিয়ে আবার টুলটির উপর চুপ করে বসে পড়তো। তারপর ফ্যাল  ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো গলি দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলোর দিকে।

একদিন দোকানের সামনে দুটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। একটি ছোট। সাত আট বছরের। আরেকটি বড়।  তেরো চৌদ্দ বছরের। বড়োটি অপেক্ষাকৃত সুন্দরী। শালিক পাখির মতো লম্বা লম্বা হাত পা। হ্যাংলা পাতলা গড়ন। গোল মুখমন্ডলের নিচে চিকন চোঁয়ালে। মাথায় লম্বা বেণী। গায়ে চাইনিজ প্রিন্টের কামিজ। পরনে হাফপ্যান্ট। পায়ে রাবারের চপ্পল। সুন্দর ফর্সা। হলদেটে শরীর। তখনো সন্ধা নামেনি। রমজানের প্রথম দিন। একটু পরে ইফতারির সময় ঘোষণা করে আজান নামবে। রোজা রেখেছিলাম। ইফতারি করার জন্য সামনে এগিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম।

ইফতার করে ফেরার পথে দেখি বড় মেয়েটি দোকানে চুপ করে বসে আছে। ছোট মেয়েটি বাহিরে টুলের উপর বসে আপন-মনে পা দোলাচ্ছে। আর নিঃশব্দে নিজের ঠোঁট দুটোকে নাড়াচাড়া করে কি যেনো বকে যাচ্ছে। চার পাঁচশত পুরুষ দোকানীর মাঝে একজন মেয়ে দোকানীর প্রত্যাশা কেউ হয়তো করেনি। এরই মধ্যে পাঁচজন যুবক কাস্টমার দোকানের সামনে এসে ভীড় জমিয়েছে।

বুড়োর দোকানে মেয়ে দোকানী অপ্রত্যাশিত হলেও কারণটা আঁচ করতে কষ্ট হলো না। বুড়ো রমজান মাসে রোজা রাখে। সারাদিন অফিসের খাটুনির পর বিকেলে দোকানে বসে মালামাল বিক্রির অহেতুক ঝামেলা সহ্য করে সন্ধ্যায় দোকানে বসে ইফতার করা আরামদায়ক নয়। তাই সন্ধ্যার পূর্বে মেয়েদুটোকে দোকানে বসিয়ে কলোনির বাসায় ইফতার খাবার খেতে চলে যায়। এর মধ্যে মেয়েটি যা পারে বিক্রি করে।

প্রতিদিনের ইফতার শেষে মেয়েটির দোকানের সামনে দিয়ে আসার সময় মেয়েটির সাথে আমার চোখাচোখি হতো। আমাকে দেখেই মেয়েটি চোখ নামিয়ে রাখতো একদিন অনুভব করলাম - দোকানি মেয়েটির গলি দিয়ে আসা যাওয়া আমার ভালো লাগে। আমার হৃদয়ের বদ্ধ গলি মেয়েটির গলির মধ্যে কোন বাঁধ  নেই। গলি দুটি স্বপ্নের মায়াজালে ঘেরা। দুটি গলিতেই মেয়েটির অবাধ বিচরণ!

একটুক্ষণের জন্য দেখা দোকানীর মায়াবী মুখটি আমার মনের আয়নাতে দীর্ঘ এক ছায়া ফেলতো বাজার থেকে হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে আমি তা অত্যন্ত নীরবতায় অনুভব করতাম। আর ভাললাগার তৃপ্তির দীঘিতে অবগাহন করতাম। সন্ধ্যার একটুক্ষণের দেখা স্মৃতি আমার পরবর্তী দিনটিতে মহা তৃপ্তির আস্বাদ যোগাতো। মানসলোকে বর্ণালী স্বপ্নের আবির ছড়াতো। আমি তখন পুলকিত হতাম।

খুব কাছে থেকে দেখার ইচ্ছে হতো মেয়েটিকে। কাছে যাবার ইচ্ছে হতেই মনের মাঝে সংকোচ এসে ভিড় জমাতো। মনের সব দ্বিধা কাটিয়ে সিগারেট কিনার ছুতোয় একদিন সামনে গিয়ে দাড়ালাম আমি, ….

এই যে শোনো, …..

আমাকে দেখলো একবার মেয়েটি। দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলো  আবার সে।

…. একটি সিগারেট দেবে? ....

সিগারেটের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার থেমে গেলো মেয়েটি। সিগারেটের বাক্সের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো, …..

কি সিগারেট দেব? ..... লজ্জার আবীরে রাঙ্গা মেয়েটির মুখ! অপ্রস্তুত হয়ে যাই আমি, ….

কি সিগারেট নেয়া যায়?

মুখে হাত চেপে হেসে ফেলে মেয়েটি। বোকা প্রশ্নের জন্য লজ্জিত হলাম আমি। ….

এই মানেযে সিগারেট বেশি কড়া নয়

আবারো হাসলো মেয়েটি। একটি উইলস কিংসের প্যাকেটে চোখ বুলালো। আলতো করে জিজ্ঞেস করলো , …. উইলস স্কিংস দেবো?

আচ্ছা তাই দাওসম্মতি দিলাম আমি। সিগারেটের জন্য হাত বাড়ালো মেয়েটি। কচি কলার ফুলের মতো মেয়েটির হাতের আঙ্গুলগুলো। গোলাকার মুখমন্ডল। সরু চিবুক। লজ্জা লাজুক চোখ। ঘন কালো চুল। সর্পিল বেনি। সরু নাক। পাতলা ঠোঁট। আপেল রঙা গাল।

মেয়েটি ডান হাতে সিগারেট বাড়িয়ে ধরল আমার দিকে। হাত বাড়ালাম আমি। মেয়েটির আংগুলের সাথে আমার আঙ্গুলের ছোঁয়া লাগে। মেয়েটির হাতটি কেঁপে ওঠে হয়তো। সিগারেটটি ছেড়ে দেয় সে। আমার হাত গলিয়ে নিচে পড়ে সিগারেটটি। ঘাড় নূয়ে তুলে নেই আমি। পকেট থেকে দু'টি টাকা বের করি। ওর সামনে টাকা দুটো রাখি। শ্লথ গতিতে দোকানের সামনে থেকে গলির দিকে পা বাড়াই। অমনি ওর কচি কণ্ঠের ডাক শুনি, ….

এই যেবাকি পয়সা নিয়ে যান!..... আমার চোখে চোখ রাখে মেয়েটি।

…. ! পয়সা পাবো নাকি?....মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দেই আমি। একটি পঞ্চাশ একটি পঁচিশ  পয়সার মুদ্রা আমার হাতের তালুতে রাখে মেয়েটি। মুদ্রা দুটি হাতে নিয়েই পালিয়ে বাঁচি আমি।

এর আগেও যে দু-একবার সিগারেট ফুঁকিনি তা নয়! কি জানি কেনো - সেদিন থেকে ইফতার করে ওর দোকান থেকে একটি সিগারেট না ফুঁকলে মনে স্বস্তি পেতাম না। প্রতি সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে ওর দোকানে গিয়ে হাজির হতাম। কিছুই বলার প্রয়োজন হতো না। আমাকে দেখলেই উইলস কিংসের প্যাকেট থেকে থেকে একটি সিগারেট নিয়ে লাইটার সহ এগিয়ে দিতো মেয়েটি পয়সা পরিশোধ করে সিগারেট ফুঁকতে  ফুঁকতে চলে আসতাম। কেমন করে যেনো হঠাৎ একদিন অনুভব করলাম - দোকানীর প্রতি কামনার যে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি দিয়ে তাকাতাম, তা ক্রমে ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসছে। কামনাকে সরিয়ে সে স্থানে সুকোমল মমতা স্থান করে নিয়েছে। দৃষ্টির গভীরতায় যৌনতাকে তাড়িয়ে স্নেহ মাখা প্রেমের  কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। একদিন সিগারেট কিনতে গিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, …..

তোমার নাম কি? …মেয়েটি উত্তর না দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। হাতের আঙ্গুল দিয়ে কাল্পনিক কিছু একটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলো কিশোরী কিশোরী মুখখানা ওর লজ্জা-মাখা উচ্ছলতায়  আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। ওকে সহজ করার জন্য এবার জিজ্ঞেস করলাম, ….

তুমি পড়ো না? …. উত্তরের আশায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু নড়েচড়ে ঠোটের উপর ঢেউ তুলে উত্তর দিলো, ….

জি! …..উত্তর দিয়েই আবার ক্যাসবাক্সের উপর চোখ দুটোকে স্থাপন করলো মেয়েটি।

…. কোন ক্লাসে পড়ো?

ক্লাস এইটে …., শান্ত নম্র, অথচ লজ্জায় জড়িত কন্ঠ মেয়েটির।

তোমার নামটা যেনো কি?... এবারে সহজ হয়ে উত্তর দিলো মেয়েটি, ….

সুফিয়া।…  উত্তর দিয়েই দৃষ্টিটাকে টুলে বসা ছোট মেয়েটির প্রতি স্থাপন করলো আমিও তাকালাম সেদিকে। দেখলাম ছোট মেয়েটি উৎসুক্য দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে। বোকা বোকা চেহারা। মুখে দুষ্টুমির লুকোচুরি। উপরের মাড়ির সামনের দুটো দাঁত পড়ে গেছে। নিঃচুপ  পরিবেশটিকে সরব করতে কন্ঠে মুরুব্বীয়ানার সুর টেনে ছোট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু চেঁচিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, …..

কি! তুমিও কি দোকান করতে এসেছো?... সম্মতিসূচক হাসলো ছোটটি।

তোমার নাম কি? একটু নড়েচড়ে সুফিয়ার দিকে তাকালো। এবার আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, ….

রুবি

কোন ক্লাসে পড়ো?

ক্লাস ফোরসুফিয়ার দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভ জিজ্ঞেস করলাম, …

তোমার ছোট বোন নাকি?

জি

তোমার বড় ভাই নেই? …. এমন করে জিজ্ঞেস করলাম - থেকে থাকলে দোকানে বসে না কেনো? সুফিয়া হয়তো বুঝতে পারলো। জবানবন্দি দেয়ার ভঙ্গিতে উত্তর দিলো, ….

জি আছে। পরীক্ষা দেবে তো! তাই দোকানে বসে না।

কোন স্কুলে পড়ে?

পাশের বয়েজ হাইস্কুলে

তুমি?

গার্লস

ক্লাসে তোমার রোল নাম্বার কতো?

ফোর। ….

সিগারেট ধরাতে ধরাতে প্রশ্নগুলো করছিলাম। কন্ঠে সন্তুষ্টির আমেজ টেনে উপদেশের স্বরে বললাম,….

বেশ ভালো। বেশ ভালো। তুমিতো ছাত্রী হিসেবে অনেক ভালো। আরো ভালোভাবে লেখাপড়া করলে ফার্স্ট হতে পারবে। ভাল করে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হও। তোমার সব আশা পূর্ণ হবে। সুফিয়ার দিকে আর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে চলে এলাম। আমার সমস্ত মনে একটা সুখের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো। সে সুখটাকে বিশ্লেষণ করে বুঝতে পেরেছিলাম, সেটা ছিল বিজয়ের সুর। একটা অপরিচিতা সুন্দরী মেয়ের সাথে নিজেকে পরিচিত করতে পারার সুখ।

তখনো কোন মেয়েকে আপন করে ভাবতে শুরু করিনি। সেদিন শবে কদরের রাত। পবিত্র রাতের শুরুতে কেনো যেনো ওকে বারবার মনে হতে লাগলো। কেনো যেনো মনের কাছ থেকে আপন আপন লাগলো। সে রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক অনেক কল্পনার জাল বুনেছি। বাসর ভাবনার সুখের দোলায় দোল খেয়েছি। তখন একটুও মনে হয়নি, - যা কিছু কল্পনা করছি, তা শুধু নিছক কল্পনা! একটা দরিদ্র কিশোরীর   উচ্চ বিত্তের একজন যুবকের মধ্যকার  বিভেদকে উপেক্ষা করে ভালোবাসার ব্যাকুলতা বাতুলতা বৈ কিছুই নয়। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, তা বলতে পারবোনা। পরের দিন দিনের আলো ফোটার পর ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।

ঈদের ছুটি কাটিয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। সুফিয়া কে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলাম। দোকানে গিয়ে দেখলাম সুফিয়া নেই। সোফিয়া যে স্থানে বসে দোকানদারী করতো, সে স্থানে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের বুড়োটি বসে বসে ঘুমোচ্ছে। সম্পূর্ণ বাজারটাকে শূন্য মনে হলো। হৃদয়ের প্রতিটি প্রকোষ্ঠ জুড়ে হাহাকার পড়ে গেলো ওকে না-দেখার বেদনায় চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে উঠলো। বিষন্ন মনে হোস্টেলে ফিরে এলাম।

এরপর কতো দিন কতো জায়গায় সুফিয়াকে খুঁজেছি! কোথাও পাইনি। স্মৃতির খাতার যে পাতায় তার ছবি পড়েছিলো, -  ক্রমে ক্রমে একদিন তা মলিন হয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেলো !

আজ দীর্ঘ আট বছর পর রাস্তার পাশের স্কুলছাত্রীকে দেখে সুফিয়াকে মনে পড়ে গেলো সুফিয়া নামের মেয়েটি আজও বেঁচে আছে কিনা - তা জানা নেই। আর বেঁচে থাকলেও কি করছে - তাও জানার প্রয়োজন নেই। একদিন নিঃশব্দে সে আমার জীবনে অনুপ্রবেশ করেছিল,- কালের নিয়মে আবার নিঃশব্দে হারিয়েও গেলো কেনো এসেছিল - তা ভাবিনি। কেনোই বা চলে গেলো  - তাও জানিনা। হয়তো হৃদয়ের বিচারালয়ে বাদিনি সে! কাঠ গড়ায় বিবাদী আমি। আর আমাদের দুজনের মাঝখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে মহাকালের কতকগুলো বছর!

মোটরসাইকেলে দৌড়াতে দৌড়াতে অনেক কথাই ভাবি। সবাই ভাবে। আমিও ভাবি। ভাবনারা এভাবেই আসে। এক ঘটনার উপর আরেক ঘটনার ঠোকর বাজাতে-বাজাতে। শোকাতুর বিউগলের সুরে সুরে। তালে তালে। অথচ নিঃশব্দে!

 

 


কোন মন্তব্য নেই

50

Blogger দ্বারা পরিচালিত.