ছোট গল্প: শান্ত বাত্যা
শান্ত বাত্যা
এখানে বেড়াতে এসে ডলি জানতে পারে, লোকটি বড় আপার একজন প্রতিবেশী। বিবাহিত। দুই সন্তানের জনক। আপাদের বারান্দা হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয় লোকটিকে। বারান্দার এপাশে সারি সারি ঘর। ওপাশে থাকে লোকটি। এপাশে আপারা।
এর
আগেও ডলি আর একবার এসেছিল এ বাসায়। সেবারে লোকটির স্ত্রী ও সন্তানরা ছিল। লোকটির স্ত্রীর সাথে ভালো ভাব জমিয়েছিল ডলি। প্রথম দেখায় লোকটিকে আর সব সাধারণ লোকের মতই মনে হয়েছিল তার। পাশ
কেটে হেঁটে যাওয়া কিংবা আপাদের বৈঠকখানার সামনে দিয়ে সিঁড়ি ভাঙার সময়গুলোতে লোকটির মোদির চাহনির ভঙ্গিমায় লোকটি
সম্পর্কে ডলিকে ভাবিয়ে তুলেছে। এর আগের বারেও ডলি ভেবেছে - লোকটির চাহনিতে ভালোবাসা নাকি কামনার অভিব্যক্তি! এ
বিষয়ে ডলি কোনো সুরাহা খুঁজে পায়নি। আসলে শহরের মানুষগুলোই নির্লজ্জ প্রকৃতির! রাস্তায় হাটার সময় ডলির বুকে মুখে তাকিয়ে থাকে কেউ কেউ। যেনো মেয়েলোক দেখেনি কখনো!
প্রথম
প্রথম লোকটিকে খুব বিরক্তিকর মনে হতো ডলির। পরে পরে লোকটির তীব্র চাহনিগুলো ডলির গা সওয়া হয়ে গেছে। লোকটির চাহনিতে ভালোবাসা বা কামনা - যেটাই থাকুক, তার তাকানোর মাঝে এক অনাস্বাদিত স্বাদ ও
গন্ধ খুঁজে পেয়েছিল ডলি। ডলির প্রতি লোকটির আকর্ষণ ডলির
গর্ব। ডলির প্রতি লোকটার অনুরক্ততা ডলির নারীত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ধারণার পর থেকে লোকটিকে সে একটু একটু পছন্দ করতে শিখেছে।
ঠিক
এই মুহূর্তে দরজার ফাঁক দিয়ে ডলি দেখছে, লোকটি দাঁড়িয়ে
আছে বারান্দায়। মুখে
মৃদু হাসি। আশ্চর্য ! এত সুন্দর করে হাসতে পারে মানুষটি! কি ভাবছে লোকটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে? তার সন্তানদের নিচ্ছয়ই! ভাবছে
হয়তো ছেলে সন্তান বউয়ের কথা!
ছেলে বউয়ের কথা ভাবলে কি আনন্দে মুখখানা এত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে? বিয়ে হয়েছে ডলির। সন্তান হয়নি এখনো। ছেলে সন্তানের আনন্দ নিরানন্দের কিছুই বোঝেনা সে। শুধু লোকটিকে খুব ভালো লাগে। এটাই ডলি বুঝতে পারে।
দরজার
আড়ালে দাঁড়িয়ে লোকটির হাস্যোজ্জ্বল মুখ
খানা দেখতে থাকে ডলি। এই মুহূর্তে মাজেদের কথা মনে পড়ে যায় তার। ডলি কে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে মাজেদ। ডলি পারেনি মাজেদকে ভালবাসতে।
সেকি এই লোকটির সাথে দেখা হয়ে যাবার জন্য?
প্রতিদিন তিনটে সাড়ে তিনটে অফিস থেকে সুস্বাস্থ্য কোকড়ানো চুলের হাসিমাখা লোকটির জন্য ডলি অপেক্ষা করতে থাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ডলির চোখে চোখ পড়ে যায় লোকটির। লজ্জায় নিচু করে লোকটি মাটির দিকে তাকিয়ে এগুতে থাকে সামনের দিকে। এক এক সময়ে লোকটির সাথে ভাব জমাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ডলি। সূত্র খুঁজে পায়না কোনো। লোকটির উপর রাগ ধরে তখন ডলির। আলো জ্বলছে লোকটির ঘরে। ডলির দিকে মোহগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকতেই জানে লোকটি! প্রকাশ করার সাহস নেই অথচ!
গতরাতে ছিল গুমোট গরম। ঘরে বসে থাকতে পারেনি ডলি। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। দূরে রাস্তার লাইট পোস্ট হতে আলো আসছিল বারান্দায়। ডলি দেখলো, লোকটির ঘরে আলো জ্বলছে। ফ্যানের শব্দও শোনা যাচ্ছে। কাজ করছে নাকি লোকটি? কাজ করা মানেতো কাগজে লিখা। কি যে লেখেন লোকটি এতো!
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের তারা দেখে ডলি। এক-একটা তারা যেনো এক একটা নারী। অসংখ্য তারার মাঝে নিজেকে খুঁজতে থাকে সে। একসময়ে পেয়েও যায় ডলি। কল্পনা করে, লোকটি যেনো সুদূর মহাশূন্যের একটি নক্ষত্র। ডলির রূপে পাগল হয়ে তাকিয়ে আছে তারারূপী ডলির দিকে। সম্মোহনী দৃষ্টিতে! কল্পিত নক্ষত্র ও লোকটির ব্যবধান নির্ণয় করতে পর্দার ফাঁক দিয়ে লোকটিকে দেখার চেষ্টা করে ডলি। দেখতে দেখতে সৃষ্টিকর্তার উপর অভিমান হতে থাকে তার। মনের মানুষ যদি দিলেই বা বিবাহিত করে দিলে কেন! ডলি অনুভব করে - তার মনের মধ্যখানে একটি বেদনার পিণ্ড আছে। নিয়তি যেনো সে পিণ্ডটিকে কচলিয়ে কচলিয়ে এসিড বের করছেন তা থেকে। সে এসিড গড়িয়ে পড়ছে ডলির কচি মনের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতে চায় ডলিকে। বেদনায় সারা অঙ্গ নীল হয়ে যায় তার। বেদনায় কোঁকাতে থাকে ডলি।
ডলি ভাবে, সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্তেই সবকিছুই হয়। তারই ইচ্ছায় নিজের মনকে লোকটির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দেয় সে। সম্ভাব্য পরিণতি কি হবে, ডলি তা নিয়ে একটু ভাবে। হয়তোবা সফলতা, নতুবা বঞ্চনা! লোকটিকে পাবার জন্য মাজেদ কে অস্বীকার করতে দ্বিধা করবে না ডলি। লোকটি কি পারবে তার বউকে অস্বীকার করতে? ছিড়ে ফেলতে পারবে কি বাচ্চাদের বাঁধন! বাচ্চাদের কথা মনে হতেই ডলির নারীত্বে মমত্ব আসে। লোকটিকে স্বামী ও বাচ্চাদেরকে নিজ বাচ্চা রূপে জ্ঞান করলো ডলি। ডলি ভাবতে থাকে বাচ্চারা মা মা শব্দে কোলাহলো করতে করতে তার কোলে চেপে বসেছে। … স্নেহের প্রস্রবণ বয়ে চলে ডলির মন থেকে। পরম স্নেহে কল্পিত হাতে বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলাতে থাকে ডলি।
ডলি দেখলো, লোকটি এবার এ দিকে ফিরেছে। এদিকে আসবে হয়তো। ডলির ড্রইং রুম পেরোবার সময় দরজা দিয়ে ভেতরে তাকাবে লোকটি ডলির দিকে। কি যে এত দেখেন লোকটি! যেনো খেয়ে ফেলবেন ডলিকে! ঠিক এই মুহূর্তে কেনো যেনো ডলির মনে হলো - এই মন এই শরীর সবই তো ও লোকটির জন্য! আমার শরীরের সব কিছুইতো তার। এ সবকিছু তাকে সমর্পন
করেইতো জীবনে সার্থকতা আসবে।
এ মুহূর্তে ডলির মনে হলো, নিজের এ সুন্দর রূপটা লোকটাকে
দেখিয়ে ডলিকে দেখার লোকটার প্রবল ইচ্ছের পূর্ণতা দেয়া দরকার। লোকটির কাছে নিজেকে প্রদর্শন করার লোভ সামলাতে পারেনা ডলি। দরজাটিকে ফাঁক করে পর্দা সরিয়ে দেয় সে। বুকের ওড়না সরিয়ে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে খাটে। চোখ বুজে পায়ের শব্দ শোনার জন্য প্রতীক্ষা করে ডলি। ডলি অনুভব করে, … এগিয়ে আসছে লোকটি তারই দিকে। পায়ের শব্দ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে আসে। এক সময়ে কাছে এসে পায়ের শব্দটি চুপ হয়ে যায়। ডলি চোখ বুঝে অনুভব করে, লোকটি দরজায় দাঁড়িয়ে ডলির সৌন্দর্য সুধা পান করছে। নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারার আস্বাদে পুলকিত হচ্ছে ডলি। ডলি অনুভব করছে, কামনার মিষ্টি যন্ত্রণায় ছটপট করছে সে। অধর ভিজে চটপটে হয়ে গেছে তার। প্রলম্বিত নিঃশ্বাসে উন্নত বুকখানা উঠছে আবার নামছে। এক অনাবিল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে ডলির সারা অঙ্গ বেয়ে। এক সময়ে ডলি অনুভব করে, লোকটি দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করেছে। নিঃশব্দে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার কাছে। উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপতে থাকে ডলি। হাতদুটো বাড়িয়ে আহ্বান জানায় লোকটিকে। লোকটি কাছে এসে বসতে বিলম্ব করছে কেনো? এত কি দেখছে লোকটি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে! অভিমানে কাঁপতে থাকে ডলির ঠোঁট দুটো। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় তার। চোখ খুলে লোকটির শরীরের স্বাদ পেতে চায় ডলি। চোখ খুলতেই সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় তার। বন্ধ দরজার পাশে পর্দা খানা নিঃচুপ দুলছে। সারা ড্রয়িং রুম নির্জন হয়ে খাঁ খাঁ করছে।
দুঃখ বেদনায় কোঁকাতে থাকে ডলি। অসহ্য যন্ত্রনায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার।
উদ্ভ্রান্ত ডলি চোখ বুজে দেখতে থাকে, …… আকাশে অসংখ্য তারা হতে একটি তারা খসে পড়ছে এবং তলিয়ে যাচ্ছে তিমির অন্ধকারের গহীন থেকে গহীনতরে!
তবুও ডলি অভিসম্পাত করতে পারেনা লোকটিকে। ভালোবাসার আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করুক সৃষ্টিকর্তা তাকে। পবিত্র থাকুক লোকটি। সুখে থাকুক তার ছেলে সন্তানদের নিয়ে!
ঠিক এই মুহূর্তে লোকটির সন্তানদের জন্য ডলির মনটি একখণ্ড বরফ গলার মত গলে গলে পড়ছে। আর বরফ গলা-মনটির গা বেয়ে বেয়ে লোকটি ও তার সন্তানদের জন্য মায়া-রস ঝরছে!
কোন মন্তব্য নেই
50