ছোট গল্প: উলকো মায়াবন
উলকো মায়াবন link text
এক
আমি লিটার কথা কটি বুঝতে পারলাম না। লিটা বার বার বলছিলো,….
আব্বু! তারি খালাম্মা এসেছেন। আমার জন্য অনেক খাবার জিনিস এনেছেন।
আমি
যা কিছু চাইবো, তাও নাকি কিনে দেবেন। আব্বু তুমি তো দেখলে না। তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেলেন। আগামীকাল আবারও আসবেন। তুমি থেকো কিন্তু।….
এক নাগাড়ে কথাকটি বলে গেলো লিটা। কিছুই বুঝতে পারলাম না। সাত বছরের মা-হারা
লিটা থেমে থেমে তোতা পাখির মতো বকতে পারে। লিটার স্নেহের আবেগে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম লিটার দিকে। লিটা
আমার কোলের কাছে ঘন হয়ে চলে আসে। অনুনয়ের স্বরে আবার বলে, …..
তোমার চাইতেও সুন্দর গাড়ি আছে খালাম্মার। সুন্দর একটা গাড়ি আছে। গাড়িতে
করে তারি খালাম্মা আসবেন, আমাকে গাড়িতে চড়াবেন। তুমি থাকবে তো আব্বু….
লিটার প্রতি আমার মনে স্নেহের বান নামলো। আমি লিটাকে কোলে টেনে নিলাম। লিটার কচি মুখে একটা
চুমু খেলাম। লিটাও আমার মুখে চুমু খেয়ে আবার বললো,
….
থাকবে তো আব্বু, থাকবে তো আব্বু!....
কিন্তু মা, তোমার তারি খালাম্মাটা
কে?
তাকে তো চিনতে পারলাম না!
কেন ওই যে লম্বা ফর্সা। চোখে চশমা। কালো শাড়ি। নীল গাড়ি!
আহ, বুঝলাম তো! কিন্তু, আমি তো তাকে দেখিনি। চিনবো কেমন করে?
তুমি শুধু মিথ্যে বলো আব্বু। তারি খালাম্মাতো বললেন, তিনি তোমার কাছে ছয় মাস ছিলেন। আমি নাকি তখন আল্লাহর কাছে ছিলাম?
অনেক রাত হয়েছে। খাবে চলো। কাল দেখা যাবে।
কাল তুমি বাইরে যাবে না কিন্তু!
আচ্ছা, ঠিক আছে আম্মু, এবার চলো।…
লিটাকে বুকে জড়িয়ে আদর করে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম।
দুই
কাল তারি আসবে। আমি চিনতে পারলাম না। সুন্দর। কালো শাড়ি। নীল গাড়ি। আমার সাথে ছয় মাস ছিলো। নাহ!, চিনতে পারছি না। আমি যখন একটি ফার্মের সুপারভাইজার ছিলাম, তখন আমার মেসের পার্শ্বে শাহীন ভাইয়ের বাসায় একটি কাজের মেয়ে ছিলো। নাম তারানা। সবাই বলতো তারি। গ্রামের স্কুলে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছে। গরিব বাপ মা আর লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারেনি। কাজের মেয়ে হিসেবে তারি এলো শাহিন ভাইয়ের বাসায়। লম্বা কিশোরী তারি। শাহীন ভাবি প্রতিদিন তারিকে
আমার রুম ঝার দিতে পাঠাতো। সে তো শাহীন ভাইয়ের কাজের মেয়ে! সে তারি আর এ তারির সাথে তো কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না!
তারিকে মনে করতেই আমার পুরনো দিনের কতকগুলো দিনের সোনালি মুহূর্তকে মনে পড়ে। দশ বছর আগেকার ব্যাচেলর ম্যাচের নিঃসঙ্গ জীবনে তারি মাঝে মাঝে সুখের ফল্গুধারা
বইয়ে দিতো। ফিরঙ্গি গড়ন। পরিধেয় বস্ত্রে দারিদ্রতার ছাপ থাকলেও
সারা অঙ্গ ও মনে ছিলো রূপ ও গাম্ভীর্যের ধনাঢ্য উচ্ছ্বাস। ঘর ঝাড়
দিতে আসা তারিকে যখনি দেখতাম, তারিকে নিয়ে তখনি আমার ঘর বাঁধার সাধ হতো। যৌবনের আবেগে তাড়িত হয়ে মাঝে মাঝে তারিকে জড়িয়ে
ধরে গভীর করে চুমু খেতাম। নিজেকে
ছাড়িয়ে নিতে নিতে তারি বলতো,….. এমন করলে কিন্তু আর আসবো না।….এর
পরের প্রতিদিনই তারিকে আদর দেয়ার উন্মত্ত বাসনার পুনরাবৃত্তি হতো। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যাস্ততা থাকলেও তারিও আমার আদর নেয়ার ইচ্ছেটাকে নিবৃত্ত করতে পারতো না। আদর
না পেলে কিছু একটা ভনিতার আশ্রয় করে তারি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতো। আদর দেয়া ও
আদর নেয়ার উন্মত্ত ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি হতেই থাকলো। হঠাৎ করে একদিন মনে হলো, …কি হচ্ছে এসব! কেউ যদি ব্যাপারটা জেনে ফেলে? তাহলে কি কান্ডই না বেধে যাবে! ছি ছি!
এরপর থেকে তারিকে চুমু খাওয়ার প্রবল ইচ্ছেটাকে
নেকি-অনিচ্ছার আবরণে ঢেকে দিতাম। অনেক কষ্টে নিজের প্রবল ইচ্ছেটাকে
দমন
করে রাখতাম। নিয়মিতভাবেই তারি আমার ঘর ঝাড় দিতো। ময়লা কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিতো। হাড়ি পাতিলগুলো ঘষে মেজে চকচক করে রাখতো।
কোনো
একদিন সুন্দর জামা কাপড় পরে তারি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। তারির মুখখানা খুব মলিন।…
আমি বাড়ি যাচ্ছি।..
এর
আগেও তারি কয়েকবার বাড়ি গিয়েছে। প্রতিবারই বাড়ি যাওয়ার সময় তারি আমাকে বলে যায়।
…আচ্ছা।….
তারি চলে গেলো।
আমার বাসা থেকে শাহিন ভাইয়ের বউয়ের চড়া কন্ঠ স্পষ্ট শোনা যায়। কি নিয়ে যেন শাহীন ভাইয়ের সাথে ভাবি রেগে গিয়েছে। ভাবির কন্ঠ চরমে পৌঁছে
এক সময়ে আবার থেমে গেলো। কিছুক্ষণ পর দেখি, ভাবি নিজেই আমার ঘরে এসে হাজির,…
এই যে সুমন ভাই। আপনি কি একটা কাজের মেয়ে
ঠিক
করে দেবেন? নাকি, নিজে গিয়েই আমার কাজকর্ম করে দিয়ে আসবেন?
ভাবি,
আপনার কাজকর্ম করে দিতে পারলে তো ধন্যই হয়ে যেতাম! তারি তো এসে পড়বে! এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
আরে ভাই আসছে না, ঢাকা চলে যাচ্ছে।
ঢাকা? ঢাকা কেন?
কেন আবার! গ্রামে
পড়েছে আকাল! ওর বাবা-মা তাই গ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে।
তা যাক না! ক্ষতি কি? বাবা
মার্ সাথে কিছুদিন থেকে না হয় আবার আসবে !
ও ওর বাবা মাকে ছাড়া থাকবে না। খুব করে বুঝিয়েও কিছুই করতে পারলাম না। তাই ছেড়ে দিলাম।…
তারি তাহলে আর আসছে না?
না, মেয়েটা বাবা মাকে ছেড়ে থাকবেই না। ও থাকলে ওকে বড় করে বিয়ে-শাদী দিয়ে দেয়া যেতো। খুব ভালো মেয়ে ভাই। কোন কাজকর্মের জন্য বলা লাগতো না।
হ্যাঁ, খুব ভালো মেয়ে ছিলো। সব সময়ে
ঘর দোর ঝকঝকে তকতকে করে রাখতো। এখন ঘরটা একেবারে নোংরা হয়ে যাবে। ঢাকা চলে যাবে, তাতো আমি ভাবিনি। আমার জন্য অনেক কিছুই করেছিলো
মেয়েটা। কিচ্ছু দেওয়া হলো না। জানলে অন্তত কিছু টাকা দেয়া যেতো!
না না, তা আর
দরকার হতো না। আপনার ভাই ওকে অনেক টাকা দিয়েছে।
হলে
হবে কি? মেয়েটার লজ্জা খুব বেশি। টাকাগুলো প্রথম নিতেই চায়নি।
হ্যাঁ, মেয়েটার লজ্জা খুব বেশি। আমিও কোনদিন কিছু ধরাতে পারিনি।
আপনি কিন্তু ভাই আমার জন্য একটি কাজের মেয়ে দেখবেন।
দেখব ভাবি, অবশ্যই দেখবো। কাজের মেয়ে থাকলে ওকে দিয়ে
আমারও তো এটা সেটা করিয়ে নিতে পারবো।
নিশ্চয়ই, তা আর বলতে হবে না। কাজের
মেয়ে না থাকলেও আপনার ভাবি এসে এটা সেটা করে দিয়ে যাবে।
ছিঃ ভাবি,
কি যে বলেন ! আপনাকে দিয়ে বুঝি আমি বুয়ার কাজ করিয়ে নেবো! কিযে বলেন! আল্লাহ মাফ করুন
! নিজের কাজ নিজেই করবো। এই বোটকা শরীরটাকে অলস হতে দিলে এ শরীরটা যে রোগের আখড়া হয়ে যাবে!…
ভাবি হাসলেন। হাসতে হাসতেই চলে গেলেন।
এর মাসখানেক
পরই ফার্মের সুপারভাইজারের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা ধরলাম। আরো পরে বিয়ে করলাম। বছর কেটে গেলো। লিটা এলো এবং বছর পাঁচেক পর লিটা
মা
হারা হলো। বাইরে ব্যবসা, ঘরে লিটা - এ দুয়ে মিলে দিনগুলো যে কেমন করে কেটে গেলো, টের পাইনি।
লিটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। ব্যবসার
হিসেব করতে করতে মনটাও এক্কেবারে হিসেবী হয়ে গেছে। লাভ ছাড়া কোন ব্যাপারেই এ ভোঁতা মনটি মগ্ন হতে চায় না। ব্যবসার তাড়ায় সকাল সকালই বেরিয়ে পড়তে হবে। যতো আগে ঘুমানো যায়, ততই ভালো। চোখ দুটো বুজে
ঘুমোবার চেষ্টা করা যাক!
তিন
দুপুরে বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ দেখে
মনে
একটা অজানা আশঙ্কা দেখা দিলো। এ সময়ে তো লিটার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকার কথা! লিটার কি কোন কিছু ঘটেছে? ব্যস্তত্রস্ত হয়ে বেল বাজালাম। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে লিটার খালাম্মা! হোঁচট
খেলাম যেনো। কিছু না বলেই পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। খাটের উপর শুয়ে ঘুমোচ্ছে লিটা। মাথা
নুইয়ে লিটার কপালে চুমু খেলাম। একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো লিটা ।
তারি সত্যিই খুব সুন্দর হয়ে গেছে। সারা দেহ জুড়ে লাবণ্যের জোয়ার বইছে। দশ বছর আগে আমি তারির মুখ দেখে যেমনটি কল্পনা করতাম, ঠিক তেমনটি
হয়েছে তারি। কিন্তু এ কি করে সম্ভব?
…… আমাকে চিনতে পেরেছেন?
গত রাতে লিটার মুখে তোমার নাম শুনেছিলাম। লিটার মুখে তোমার নাম না শুনলেও হয়তো চিনতে কষ্ট হতো না। কিন্তু এ কি করে সম্ভব? একি সত্যি?
ভাবতেও কষ্ট হয় তাই না? আমি আমার আমিত্বকে
হারিয়ে ফেলেছি। নিজ সমাজকে ছেড়ে আপনাদের সমাজের একজন হয়েছি। এ রকম একটি জীবন আমি চাইনি
-
তা বলবো না। কয়েক বছর আগেও আমি এ রকম একটি জীবন শুধু কল্পনাই করতাম। আর এখন তা পেয়েও গেলাম। তবে নিজের চেষ্টায় নয়, অন্যের দয়ায়।
তা কেমন?
ঢাকা যাওয়ার একদিন পর বাবা-মা কাজের সন্ধানে গেলে ট্রাক চাপা পড়ে মারা যান? আমাকে দত্বক
নিয়ে গেলেন এক নিঃসন্তান শিল্পপতি? সেখানে থেকেই আমার লেখাপড়া ও প্রতিষ্ঠা। আমি এখন এ মফস্বল শহরের একটি সরকারি কলেজের লেকচারার। আমি এখন আপনাদেরই একজন। আপনাদেরই দয়ায় আপনাদেরই সমাজের একজন
সদস্য।
তারি
আর
কিছুই বলতে পারলো না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলো। কিভাবে তারির কান্না থামাবো ভেবে পেলাম না। মুক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একসময়ে
তারি স্থির হলো। নিজেই তার চোখ মুছলো এবং ব্যস্ত হয়ে পড়লো, …
স্যরি,
খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
থাক, তোমার ব্যস্ত হতে হবে না। জরির মা আছে। সে-ই দিতে পারবে।
জরির মাকে দুদিনের জন্য ছুটি দিয়ে দিয়েছি। দেশের বাড়িতে যাবে। আমি কলেজ থেকে দুই দিনের ছুটি নিয়েছি।
আমি আশ্চর্য হয়ে তারির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তারি বুঝতে পারে, চাপা কন্ঠে বলে…
জানি আমাকে গ্রহণ করলে আপনি সমাজের কাছে হেয় হবেন। সব সময় আমাদের মত মেয়েদেরকে
পাত্তা দিতে নেই। আমারও ইচ্ছে ছিলো না এখানে আসি। দুমাস হলো এই মফস্বল শহরে এসেছি। প্রতিদিনই মন চাইতো, আপনাকে একটু দেখে যাই। সাহস পেতাম না। এবার আপনাকে একবার
দেখে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। কিন্তু
লিটাকে দেখে মায়ায় পরে গেলাম। ভাবলাম দুদিন
থেকে যাই।
অন্যায় করেছ কি কিছু?
সেটাতো
আপনার বিচারের রায়ই বলে দেবে। আমাদের মতো নিচু জাতের মেয়েদের আপনারা কোন পাল্লায় ফেলবেন,
সেটাতো আপনাদের ব্যাপার।
উঁচু
নিচুর ব্যাপার এটি নয় তারি। আমি তুমি দুজন এখন দু মেরুর বাসিন্দা। আমি বিপত্মীক হলেও
আমার একটি কন্যা আছে - যাকে অবলম্বন করেই আমি আমার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই। লিটাই এখন আমার জীবন। লিটার জীবনটাকে সুখী করতেই
আমি এখন আমার সমস্ত জীবনটাকে নিয়োজিত করেছি। আমি চাইনা - আমাদের এ দুজনের মাঝখানে অন্য
কোনো ব্যক্তি ঢুকে পড়ুক।
আমার
মনের আকুতিটা নাইবা আপনার আমলে এলো। লিটাকে দেখার জন্যকি আমি এখানে মাঝে মাঝে আসতে
পারবো না?
আমি চাই
না লিটার মনে আমার ও তোমার পূর্বেকার কোনো সম্পর্কের ব্যাপারটি জাগরুক হোক।
পূর্বেকার
কোনো সম্পর্কের দাবিতো আমি করছি না। পৃথিবীতে আমারতো আর কেউ নেই। লিটাকে কেন্দ্র করে যদি আমার মনের প্রক্সি মা হওয়ার
বাসনা মেটে, তাতেতো আপনার কোনো ক্ষতি নেই।…
…আমি
চাইনা লিটার দায়িত্ব আমি ছাড়া অন্য কেউ গ্রহণ করুক। এমনকি, লিটাকে আদর করার ভাগা-ভাগি
করতেও আমি রাজি নই।
ভাগা-ভাগির
প্রশ্ন আসছে কেন এখানে? আপনি একা কি ওর সকল দায়িত্ব পালন করতে সমর্থ হবেন? জীবন জীবিকার
জন্যেতো আপনাকে ব্যাবসার কাজে বাইরে যেতে হবে। জরির মাকে দিয়েতো সবকিছু হবে না। একজন
প্রক্সি মায়ের সেবা নিয়ে লিটার জীবনটা যদি প্রতিষ্ঠা পায়, তাহলে আপনারতো কোনো লোকসান
নেই। ঘরে আমি লিটাকে সামলাবো, আপনি বাইরে গিয়ে
লিটার জন্য বৈষয়িক স্বার্থগুলো উপার্জন করবেন। আমি কি পারিনা এ পরিবারের একজন
হয়ে আসতে?
…. না পারো না তারি। অতীতের দিনগুলোকে আমরা ভুলি কেমন করে? আমি জানলাম তুমি এখন প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এটাও তো সত্যি, এই তুমিই একদিন মানুষের বাসার কাজের মেয়ে ছিলে। অতীতের দিন গুলোকে মুছে ফেলি কেমন করে? লিটা
বড়
হয়ে তোমার অতীতকে যখন জানবে, তখন কি তোমাকে গ্রহণ করতে পারবে? তাই আমাকে ক্ষমা করো।….
তারি
থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারির নিঃস্বাস ভারী হয়ে এলো। দু হাত দিয়ে মুখখানাকে ঢেকে ফুঁফিয়ে
ফুঁফিয়ে কাঁদতে থাকলো। এক সময়ে কান্নার ধকল সামলে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকলো। হয়তোবা,
স্থিরতা পেতে লিটার খাটের দিকে এগুলো। লিটার
মুখে চুমু খেয়ে লিটাকে আদর দিলো। কি থেকে যেনো
কি হয়ে গেলো। তারি লিটার গালে মুখ চেপে ডুকরে
ডুকরে কেঁদে উঠলো। লিটা জেগে উঠে ব্যস্ত হয়ে পড়লো,….
তারি খালাম্মা! তুমি কাঁদছো কেন? তুমি কাঁদছো কেন?
লিটার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তারি লিটার গালে দুটো চুমু খেলো এবং লিটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।
লিটার চোখে-মুখে বিহবল প্রশ্ন, আব্বু তারি খালাম্মা কাঁদলেন কেন? চলে গেলেন কেন? ও আব্বু, তারি খালাম্মাকে ফিরিয়ে আনো না!
লিটার আকুতিতে আমি কোন সাড়া দিতে পারিনি। চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে
কিংকর্তব্যবিমূড় হয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। লিটার মুখখানা কান্না মাখা।ভারী।
তারির শোকে কাতর হয়ে আছে যেনো। লিটার এমন মলিন মায়া ভরা মুখখানা তারিকে ফিরিয়ে আনতে আমাকে উদ্ভুদ্ধ করে। আমি পা বাড়াই তারিকে খুঁজতে। ততোক্ষণে তারির গাড়ি আমার দৃষ্টির আড়ালে। লিটার মলিন মুখের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি। সৃষ্টি কর্তা! এই কচি মুখটার জন্য আমি নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি। এই মুখটার হাসি ধরে রাখার জন্য আমি সব কিছুই করতে পারি। তাহলে কি তারি
যা
চায় তাই হবে?.....
না। তা হবে না। একটা কাজের মেয়ে তারির মা হতে পারে না। হলেও তা হবে সৎ মা। সৎ মায়েরা সৎ থাকে না। অন্যের বোটায় ধরা লিটাদের ওরা এক সময়ে পর করে দেয়। তা ছাড়া লিটা যখন জানবে, তারি এক সময়ে কারুর
বাসার কাজের বুয়া ছিলো, তখন তার মনের উপর একটা হীনমন্যতার প্রলেপ পরবে। এতে তার মানসিক বিকাশের ব্যাঘাত হতে পারে।
এমন সুন্দর
তারিটা এ সমাজেই বা কেনো জন্মালো না? আমাদের সমাজে তারির মতো মেয়েদের অনেক কদর ! ক্ষনিকে
তারিকে আমি আমার পাশে বসিয়ে স্ত্রীর মর্যাদায় কল্পনা করলাম। অনুভব করলাম, আমার সমস্ত
সংসার জগৎ ভালোবাসায় আলোকময় হয়ে গেছে। প্রণয়ের আলোকছটায় আমার সমস্ত দেহে কিসের যেনো
প্রবল প্রণয়ী-ভালোলাগার শিহরণ বইয়ে যাচ্ছে। সম্ভিত ফিরে পেতেই নিজেকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে লিটার করুন মুখখানাকে আমার দৃষ্টির
মায়ায় নিয়ে এলাম।… লিটা ! তোর জন্য আমার পুরো জীবনটা ! তোর সুখই আমার সুখ ! পরক্ষনেই
কে যেনো আমাকে প্রশ্ন করলো,….
তারিকে
তো লিটা খুব পছন্দ করে। তাহলে তারির ইচ্ছেটা
তুমি পূরণ করছো না কেনো? তুমি কি একদিন তারিকে বুঝিয়ে দাওনি যে - তারিকে তোমার ভালো
লাগে? কতদিন তুমি তারিকে গভীরভাবে আদর দিয়েছো ! হোকনা তা শারীরিক চাহিদারও একটি কারণ
ছিলো। কিন্তু, ওতে যে তারির প্রতি তোমার অনেক মায়া মেশানো ছিলো - তাকি তুমি অস্বীকার
করতে পারবে?
কিন্তু,
তারি যে নিচু সমাজের?
মানুষ
গরিব হলেই নিচু হয়ে যায় না
গরিব
মানুষরা সমাজ দ্বারা গৃহীত হয় না
আমাদের
সমাজতো একটা ভ্রান্ত কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে।
এটাকে যে ফলো করতে হবে, তা তোমাকে কে বললো ?
কেউ নাই
বলুক। একটা কাজের মেয়ে লিটার মা হোক, বা লিটা একটি কাজের বুয়ার মেয়ে হোক - তা আমি চাই
না। সমাজে আমার নয়, আমি লিটার সামাজিক মর্যাদার ব্যাপারটিকে সকল স্বার্থের উপরে স্থান
দেই! সমাজে মাথা উঁচু করে লিটাকে বাঁচতে হবে। লিটার মনে নেগেটিভ ইম্প্যাক্টের কোনো
পরিবেশ আমি তৈরী করতে পারবো না।
আর এতো
সুন্দর রূপ নিয়েই বা তারি কেনো জন্মালো? কাজের মেয়েদের তো কাজের মেয়েদের চেহারা নিয়েই
জন্মাতে হয় ! পরমুহূর্তেই, আমার বিবেক জাগ্রত হয়ে আবার ফোড়ন কাটলো,… তারিতো লিটার মা
হতেই এ পৃথিবীতে এসেছে। কারো বাসার বুয়া করে
ওকে সৃষ্টি কর্তা তারির কাছে পাঠায় নি। তুমি রাজি হচ্ছো না কেনো?...
দূর ছাই
! কি সব আজব-অবাস্তব চিন্তা ভাবনা মনের মধ্যে স্থান দেই!...মুহূর্তেই আমি মনের ফালতু
ভাবনাগুলোকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলি। দৃঢ়ভাবেই আমি
তারিকে আমার মন হতে সম্পূর্ণভাবেই সরিয়ে দেয়ার
প্রয়াস নেই। তারি কেনই বা দশ বছর পরে আমার হৃদয়ের সাজানো গোছানো বাগানটিকে
তছনছ করে দেয়ার জন্য আবির্ভুত হলো? পরক্ষনেই আমার বিবেক আবারো জাগ্রত হয়ে মন্তব্য করলো,……
তছনছ
করতে নয়, তোমার ঝড়-বিধ্বস্ত সংসারটিকে পুনরায় সাজানোর জন্যই তারি তোমার ও লিটার মাঝে
আবির্ভুত হয়েছে। তাছাড়া, তুমি কি পারবে লিটাকে অতো সময় দিতে - যে রকমটি লিটার প্রয়োজন
হবে? পারবে না। লিটার একটি মা দরকার। ওর মনটা তো এখনো কচি। তারি যদি ওর মন জয় করে নিতে পারে, তাহলে
তো তোমারই লাভ। কচি মনে মায়ের আসন বসিয়ে নেয়া তারির জন্য সহজ হবে। মোটেই কঠিন নয়। তারিতো লিটাকে পাগলের মতোই ভালোবেসে ফেলেছে। তোমার
সংসারে তারির মা হবার বাসনাতো তার কৈশোর জীবনে তুমিই সৃজন করেছিলে। কি করে তুমি তা
অস্বীকার করবে? ….
আমি অনুভব
করতে থাকলাম, তারির জন্য আমার হৃদয়তন্ত্রে মায়াবী একটা আবহের জন্ম হচ্ছে। কিন্তু আমি তা প্রশ্রয় দিতে পারি না। ... তারি তুমি আমাকে ভুল বুঝনা। তোমাকে আমি ঘৃণা করি নি। তোমাকে আমি অপছন্দ করিনি। লিটার ভবিষ্যতের ভালোটার জন্যই আমি তোমার আড়ালে থাকতে চেয়েছি।
আমাদের সমাজটা তোমাকে আড়াল করে রাখতেই আমায় শিখিয়েছে। আমি কোন দোষ করিনি। তারি, আমাকে ক্ষমা করো। তারি, আমাকে ক্ষমা করো!....
এরই মধ্যে
হয়তো অনেকক্ষণ কেটে গিয়েছিলো। কি করতে হবে, ভেবে না পেয়ে আমি লিটার মলিন মুখখানার দিকে তাকালাম। লিটা বিহ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তে আমার মুখ হতে চোখ দুটো সরিয়ে লিটা দরজার দিকে দৃষ্টি ফেরালো।
তারপর সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো,, কি মজা, কি মজা! ওই যে তারি খালাম্মা এসেছেন! তারি
খালাম্মা এসেছেন! কি মজা! কি মজা ! ....
নিজের সৃষ্টি করা উচ্ছ্বাস নিয়ে বিছানা
ছেড়ে দৌড়ে এসে লিটা তারিকে জড়িয়ে ধরলো। তারি আরো পরম উচ্ছ্বাসে লিটাকে জড়িয়ে ধরলো। লিটার কচি গালে কয়েকবার সোহাগ দিলো। পরক্ষনেই লিটাকে ছাড়িয়ে লিটার মাথায় তার ফর্সা হাতখানাকে রাখলো। আমার
দিকে তাকিয়ে বললো, ….
জরির মাকে তো দুদিনের ছুটি দিয়েছি। ওতো এ দুদিন আসবে
না।
নতুন তারি হিসাবে না হোক, পুরাতন তারি হিসেবে কি এ দুদিন আমি আপনার বাসায় থাকতে পারি না? ব্যাবসার কাজে আপনি বাইরে চলে
গেলে তারিকে দেখাশোনা কে করবে?...
আমি কোন জবাব খুঁজে পেলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলার
মতো কোনো একটা উত্তর মনের মাঝে খুঁজতে থাকলাম। তারিকে বাসায় থাকতে দেয়ার অনুমতির পক্ষে আমি কোনো
যুক্তি খুঁজে পেলাম না।
… জানি এতে আপনার মত নেই। আমাদের
আগের জীবনের সব স্মৃতিগুলো তো এখনো মুছে যায়নি। আপনার ক্ষেত্রে না হোক, আমার
সারা হৃদয় জুড়ে সে স্মৃতিগুলো নিবিড়ভাবে লেপ্টে আছে। বাবা মা মানুষের কাছে কিছু চাইতেন। মানুষ তা সহজে দিতো না। আশা ছাড়তেন না। থেকে থেকে
বারবার মানুষদের বিরক্ত করতেন। মানুষরা বিরক্ত হয়ে ধমক দিতো। বাবা-মা তা নীরবে সহ্য করতেন। এ রকম নির্লজ্জ চেষ্টায় কখনো সফল হতেন। কখনো ব্যর্থ হতেন। আমি তো তাদেরই সন্তান! নতুন তারি নয়, পুরাতন
তারি হিসেবেই মাত্র দুদিনের
জন্য থাকবো। বেশি দিরের জন্য নয়। মাত্র
দুদিনের জন্য। জরির মা ফিরে এলেই আমি আবার
চলে যাবো। কথা দিলাম।…
এবার নিঃসংকোচে তারি লিটাকে
নিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে পা বাড়ালো। খাবার সাজিয়ে আমাকে ডাকলো
।
তার শেষের ডাকগুলো আমার কানে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর
হতে থাকলো। কেননা, ততোক্ষণে আমি আমার ঘর ছেড়ে বাইরে রাস্তায় এসে নেমেছি।
ঘর ছাড়ার
আগে এমন একটি ধারণা মনের ভেতরে চট করে জন্ম নিলো যে লিটার কথা ভেবেইতো তারি আবার চলে-যাওয়া
পথ হতে ফিরে এসেছে। তারির প্রতি আমার ফিরতি-ভালোলাগা নাইবা জাগুক, আমার প্রতিও তারির
ভালোবাসা নাইবা থাকুক,- তারি যে লিটাকে ভালোবেসে ফেলেছে - তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের মনের উচ্ছাস ও প্রকাশিত ভাবের আচরণ ব্যাখ্যা
করলেই তাদের মনের মোটিভ উন্মোচিত হয়ে পড়ে।
তারির মাঝেও আমি এ রকম একটি আচরণ আবিষ্কার করতে পেরেছি। এবং তা তৎক্ষণাৎ। যখন বুঝতে পারলাম যে, এ দুদিন
লিটাকে কে দেখবে, এটা ভেবেই তারি অনেক দূর
হতে আবার ফিরে এসেছে। । কেনো যেনো আমার মনে
হয়েছে, এ দুদিনের জন্য আমি লিটাকে দেখা-শোনার জন্য তারির কাছে রেখে যেতে পারি। আমার
জন্য তারি বিপদজনক হলেও লিটার জন্য তারি অত্যন্ত নিরাপদ। আর তাই আমি সিদ্ধান্ত নিতে
পেরেছিলাম যে জরির মায়ের অনুপস্থিতিতে লিটা তারির হেফাজতেই থাকুক। আমার প্রতি তারির আবেগকে পাত্তা না দিলেও লিটার প্রতি
তারির ভালোবাসাকে আমি অস্বীকার করলাম না। এ দুদিন একসাথে থাকার সামাজিক রিস্ক বিবেচনা
করেই আমি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলাম।
চার
মনটা কিছুতেই ভালো লাগছিলো না। দুদিন ধরে তারির জিম্মায় লিটা ভালো থাকবে, এটা আমার বিশ্বাস ছিল। তবুও লিটার জন্য বড় চিন্তা লাগে! ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবার ভয়ে বন্ধুদের বাসায় না উঠে এ দুদিনের জন্য একটা হোটেলে উঠেছিলাম। হোটেল থেকে আজ তারির সাথে বাসায় টেলিফোনে কথা হয়েছিলো। টেলিফোন ধরেই তারি বলছিলো, …. সুমন সাহেব বাসায় নেই।… আমি বললাম….
কোথায় গেছেন?
উনি একটা ব্যবসার কাজে বাইরে গেছেন। আজ দুদিন হলো।
আপনি কে, আপনাকে তো চিনতে পারিনি!
আমি ওনার বাসার পরিচারিকা।
পরিচারিকা?
জি, হ্যা।
কিন্তু
…
আপনার অন্য কোন কথা আছে কি?
কেন, বলুন তো?
দেখুন, মনে কিছু নেবেন না। বাসায় সাহেবের অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। আমার হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। উনি ফিরলে কিছু বলতে হবে কি?
ইয়ে,… তারি …. আমার এ দীনতার জন্য আমি দুঃখিত। দুদিন হলো কিন্তু!
ও সুমন সাহেব! আমার মেয়াদ তো শেষ। জরির
মা এলেই তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি চলে যাবো।
আপনি নচেৎ তখন আসবেন। আমি আপনাকে ফোন
করে জানাবো। তা আজকেই হবে। তবে আপনার
কাছে আমার একটা মিনতি আছে..
যেমন?
এ দুদিন আপনাকে বাইরে রাখার জন্য আমি দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা টুকু করতে হবে।
তারি! আমি আর বাইরে থাকতে পারছি না। লিটাকে দুদিন ধরে দেখিনি। মনটা ভালো লাগছে না। বুঝতেই তো পারছো!
বুঝতে পারছি সুমন সাহেব! তারিরা সবই বুঝতে পারে। একটা ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে সেদিন চলে যাওয়াই ভালো ছিলো। কেমন করে যে ভুলবো। তা আমি ভেবে পাচ্ছি না। লিটার সাথে এ দুদিনের স্মৃতি আমার সারাটা জীবনের জন্য
মিষ্টি অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। কিন্তু যে ক্ষতিটা হয়ে গেলো তা হলো, একটি মেয়েকে নিয়ে একটি মায়ের মধু মাখা স্বপ্নবিলাসের কষ্টটা কেমন করে যে সহ্য করবো ! স্বপ্নতো আমার কোনোদিনই পূরণ হবে না সুমন সাহেব। তবে মাঝে মধ্যে দু একদিনের জন্য হলেও লিটার সাথে থাকার সুযোগ করে দিলে স্বপ্নসাধ কিছুটা হলেও মিটবে। লিটাকে
দেখতে আমি আসবো যখন আপনি ব্যাবসার কাজে বাইরে থাকবেন। মিনতিটা রাখা যাবে কি সুমন সাহেব !
তারি! আমি লিটাকে দেখবো।
দেখবেনই
তো।
একজন কুমারী মায়ের স্বপ্নসাধ কি পূরণ হবার নয়?
তারি, প্লীজ !
আমার মিনতি?
তারি, তুমিতো এখন অনেক ধনী ও শিক্ষিতা। ইতিমধ্যে তুমি
একটি ভালো চাকরিও করছো। তোমার মতো অপূর্ব একটি সুন্দরী মেয়ের জন্য আমার চাইতে অনেক অনেক ভালো বরের কোনো অভাব হবে না তারি। তুমি বিয়ে করবে ডিক্লেয়ার দিলে রাজপুত্ররা লম্বা কিউতে লাইন ধরবে। তুমি বুঝতে পারছো
না তারি। আমি লিটাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি। প্লীজ আমাকে একটু দয়া করো!
….. অপূর্ব সুন্দরী এক কিশোরীর রূপের লহমা তো একজন যুবক দশ বছর আগেই চেখে নিয়েছে। এখন যা কিছু আছে,
তা তার সৌন্ধর্য্যের কায়া। সৌন্ধর্য্যের কায়াটা পরে আছে মাত্র। এ মেকি ও বাসি সৌন্ধর্য্যের কায়াটা
অর্পণ করে কাউকে আমি ঠকাতে পারবো না। এ উপদেশ আমাকে নাইবা দিলেন সুমন সাহেব! …. ও আচ্ছা, আপনার জন্য সুখবর, জরির মা এসে গেছে। এখন চলে আসতে পারেন।…
….. তারি আমাকে ক্ষমা করো। তোমাকে কষ্ট দিলাম।
তারি, তারি!
হ্যাঁ বলুন।… (তারির কণ্ঠ ভেজা)
…… তারি,
হেয়ালি করো না। তুমি রাজি হলে তোমাকে আমি ভালো বর দেখে বিয়ে দিতে পারি।
…… বরটা তো আপনাদেরই সমাজের। সব কিছু জেনে তিনি আমাকে নিতে চাইবেন কেন?
না, মানে তাকে তোমার অতীত জীবন সম্পর্কে নাই বা কিছু বললে!
আপনার মত কাপুরুষ তো আমি নই! সে যাক, সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত
ব্যাপার। তবে আপনার এ মহৎ ইচ্ছের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। একটা আকুতি রাখবো, রাখবেন?
কি?
ওই যে
একটি মিনতি করেছিলাম? মাঝে মাঝে দু এক মিনিটের জন্য হলেও আপনাদের বাসায় এসে লিটাকে
দেখে যাব। আমার এ মিনতিটুকু কি রাখবেন?
তারি, আমি আমার লিটাকে দেখবো। তুমি চলে যাও তারি,
তুমি চলে যাও!
আমি এখনই চলে যাচ্ছি। জানেনই
তো,
আমরা ভিখারির জাত। সহজে আশা ছাড়ি না। আমার ঠিকানাটা আপনার টেবিলে রেখে গেলাম। যদি দয়া হয়, টেলিফোনে জানালেই চলবে।
আচ্ছা ঠিক আছে। বাসা ছাড়ো।
আই এম মেন্টাললি পাজেল্ড নাউ !
স্যরি,
আপনাকে দুদিন ধরে বাইরে রাখার জন্য আমি অনেক দুঃখিত। আমাকে মাফ করে দেবেন। আল্লাহ হাফেজ।….
আমি কথা বন্ধ করে দেই। কিন্তু রিসিভারের এক প্রান্ত আমার কানেই থেকে যায়। তারিও তাই। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারির কান্নার শব্দ শুনি। তারি রিসিভার হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁফিয়ে
ফুঁফিয়ে কাঁদছে। বেদনা ও আবেগে রিসিভার রেখে দিতে
তারি ভুলে গেছে। আর কালক্ষেপ করি না আমি। হাত হতে রিসিভারটা রেখে দিয়ে একটি ট্যাক্সি ডেকে লিটাকে দেখার জন্য আমি আমার বাসার দিকে
ছুটতে থাকি।
পাঁচ
কয়েকদিন পর।
তারানা ও আমার বাসর রাত।
পাশেই
লিটা ঘুমোচ্ছে। লিটার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে তারানা বললো. …
আচ্ছা বলতো, তোমার মত পাল্টালো কেমন করে?
কেমন করে? দেখবে?
হ্যাঁ, দেখবো।
আমি পকেট থেকে একখানা ছবি বের করে তারানাকে
দেখাই। লজ্জায় তারানার মুখ লাল হয়ে যায়। ছোঁ মেরে তারানা ছবিখানাকে লুফে নেয়। …..
এটাতো
আমার !তুমি এটা কোথায় পেয়েছো? আমার দশ বছর ধরে আগলে রাখা হৃদয়ের
ধন! কেমন করে যেন কয়েকদিন আগে আমার ব্যাগ থেকে হারিয়ে গেছে!
এই ছবি খানা চুরি করেছিলে নিশ্চয়ই!
হ্যাঁ,
তা বটে।
কবে?
দশ বছর আগে। তোমার
পড়ার টেবিল থেকে। তোমার ঘর ঝাড় দেয়ার সময়।
চুরি করলে কেন?
শাহীন আঙ্কেলের বাসার কিশোরী কাজের মেয়েটি পাশের ম্যাসের যুবকটির বিরহে সদা সর্বদা পাগল হয়ে থাকতো। অনেকদিন ধরে এরকম একটি সুযোগ খুঁজছিলো কিশোরীটি। কিশোরীটি ভেবেছিলো, যুবকটির একখানা ছবি যদি তার কাছে থাকতো, তা হলে সে যখনই বিরহের আগুনে পুড়বে, তখনই যুবকটির ছবি দেখে দেখে মনের আগুন নিভিয়ে নিবে!
হ্যাঁ, ফার্মের চাকরি ভালো লাগছিলো না। একটা ভালো চাকরির বিজ্ঞপ্তি পেয়ে দরখাস্তখানা রেডি করি। দরখাস্তের সাথে দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের সত্যায়িত ছবি সাঁটাতে
হবে। সাবমিট করার দিন দেখি, ছবির একখানা কপি নেই। প্রিন্ট
করা আর কোন ছবিও সে দিন আমার হাতে ছিলো না। দরখাস্ত সাবমিশনের তারিখও শেষ। অগত্যা দরখাস্ত করা আর হলো না। দশ বছর আগেকার আমার চুরি যাওয়া ছবি খানা তুমি চলে যাবার পর লিটার কাছেই পেলাম। তুমি যাতে ফিরে আসো, তাই লিটা তোমার অজান্তেই তোমার ভ্যানিটি ব্যাগটি চুরি করে রেখে দিয়েছিলো। আমি এলে বললো,
…..
আব্বু, তারি খালাম্মানা
আজ
খুব বকা খেয়েছেন। কে যেন তাকে বকে ছিলো। তারি খালাম্মা অনেক্ষন কেঁদেছিলেন। তারি
খালাম্মানা এরপর চলে গেলেন। আব্বু, তারি খালাম্মারনা ফিরে আসতে হবে। আমি তার ব্যাগটি রেখে দিয়েছি। এই দেখো!
আমি ব্যাগটা হাতে নেই। অনধিকার চর্চা করার ইচ্ছে হলো। ব্যাগটা খুলি। দেখি ব্যাগের একটি পকেটে একখানা পাসপোর্ট সাইজের ছবি। দশ বছর আগেকার সত্যায়িত করা আমারই
ছবিখানা। দরখাস্ত করার জন্য যে ছবি দুখানা ষ্টুডিও থেকে এনেছিলাম, ছবি খানা তারই একটি।…
তারানা লজ্জা
পেয়ে মুখখানা আমার দৃষ্টি হতে আড়াল করার চেষ্টা করে।
….. ছবিখানা পেয়ে আমার
মনের ভেতর একটা ভাবান্তর ঘটে। ছবিখানা হাতে নিয়ে ভাবলাম,
যে মানুষটি দশ বছর ধরে তার প্রিয় মানুষটির একখানা ছবি সযতনে রেখে দিতে পেরেছে, আর কিছু
না হোক, ছবিখানার মানুষটিকে সে যে প্রানপনে
ভালোবাসে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সামাজিক কারণে লিটার ভবিষ্যত চিন্তা করে আমি তোমাকে
দূরে রাখতে চাইলেও তোমার প্রতি যে আমার মন টানতো না - তা নয় তারানা ! আমার সামনে তুমি
এলেই সে দশ বছর আগেকার অনাকাঙ্খিত উত্তেজনাটি মোহময়ী হয়ে আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তো।
আমি চটপট করতে থাকতাম। আর লিটার কথা ভেবেই তোমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইতাম। ছবিখানা
হাতে নিয়েই দেখলাম, দশ বছর আগেকার ছবিখানা একটুও মলিন হয়নি। ক্ষনিকেই তোমার মায়াময়ী
মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো। প্রবলভাবে ইচ্ছে হলো। ভাবলাম,
দুটো মন যদি দুজনকে ভালোই
বেসে থাকে, তাহলে আর দেরি কেন? আমাদের সমাজের নিয়ম কানুনগুলোতো মানুষের দ্বারাই
সৃষ্ট। উঁচু স্তরের মানুষরাইতো তাদের স্বার্থের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছে সমাজের এ নিয়মগুলো। সেই স্বার্থান্বেষী মানুষদের শিকার এই তারিরা। তথাকথিত তারিদের সমাজের একটি মেয়ে
তার মনের ভেতর দশটি বছর ধরে আমার জন্য যে ভালোবাসা পুষিয়ে রেখেছে,
তাকে আমার উপেক্ষা করা উচিত নয়। । ভালোবাসা, মনের সুখ - এ সবই তো
সবকিছুর উপরে। তারির ভালোবাসাই তো আমার জন্য পরম এক ঔশর্য্য। সেই ঔশর্য্যের প্লাবনে ভেসে যাওয়ার লোভ হলো। তোমাকে এক নজর দেখার লোভ ও আবেগে চটপট করতে থাকলাম আমি। লিটাকে বললাম,
আমি যাচ্ছি লিটা ! তোমার তারি খালাম্মাকে নিয়ে আসতে আমি যাচ্ছি! …
তারানা হাসে, মিষ্টি করে। আমি তারানার
মুখখানাকে কাছে টেনে নিয়ে দশ বছর আগেকার বিহ্বলতার পুনরাবৃত্তি করি। আমাকে থামিয়ে দিয়ে আবারো মিষ্টি করে হাসে তারানা।
….
…… দুদিন আগে মাসুদ এস্টেটের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের টেবিলে তোমার সাবমিট করা একটা টেন্ডার দেখলাম।….
আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। বলি,
… হ্যাঁ, এক কোটি টাকার একটা
কাজ। কাজটা পাবার জন্য টেন্ডার সাবমিট করেছিলাম। কিন্তু, তুমি জানলে কেমন করে?
তারানা আরো মিষ্টি করে হাসে। বলে,
… আমারইতো
জানার কথা। এমডি সাহেবের অনুমোদন না পেলে যে টেন্ডারটি পাস্ হবে না !
তুমি বলছো কি!
হ্যাঁ সুমন, সত্যি। মাসুদ এস্টেটের মালিক আমার ধর্ম
বাবা। এ জগতে বাবার আর কেউ ছিলো না। মারা যাওয়ার সময় তার সমস্ত সম্পত্তি আমাকে দলিল করে দিয়ে যান। ঢাকায় দশটি ফ্যাক্টরি। মারা যাওয়ার সময় সারা শহরে সর্বমোট ত্রিশ কোটি টাকার সম্পদ তিনি রেখে যান। বর্তমানে মালিক স্বত্বে আমিই সে স্টেটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
তারানা, সত্যি! তুমি আমাকে বিস্মিত করলে! তুমি যে বললে, তুমি সরকারি কলেজের লেকচারার!
হ্যাঁ বলেছিলাম। মিথ্যে করে।
সেটা ছিল আমার ব্যাবসায়িক স্টান্টবাজি। … তারানা আবারো মিষ্টি করে হাসে।
তারানার খুব ধনী হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি জেনে আমি যেন কেমন চুপসে গেলাম। বিশেষ করে অতি সম্পদশীল একটি স্ত্রীর স্বামী হতে চাইনি আমি কখনো। হয়তোবা কোনো স্বামীই তা চায়না। হীনমন্যতার অদৃশ্য আবরণে আমার মনটা আরো চুপসে যেতে থাকলো।
হীনমন্যতার আবরণ হতে বের হয়ে আসার জন্য আমি তারানার উদ্দেশ্যে বলি, ….
তারানা, যদি মনে কিছু না নাও …
আমি জানি তুমি কি বলবে।
কি?
তুমি কক্ষনো চাওনি যে তোমার বউ তোমার চাইতে ঐশ্বর্যশালী হোক।
তা সব স্বামীরাই
তো
চায় তারানা !
আমি জানি। আর এ সময়টুকুর জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম। সম্পদের কানাকড়িও আমি নেবো না। শুধু তোমার
তারানা হয়েই থাকবো। মাসুদ এস্টেটের সমস্ত সম্পত্তি আমি তারিদের সমাজের মানুষদের কল্যাণের জন্য দান করে দেবো। তবে তাতে একটা শর্ত আছে।
..
কি?
তোমাকে মাসুদ
এস্টেট পরিচালনার ভার নিতে হবে।
মানে ম্যানেজিং ডিরেক্টর?
হ্যাঁ
কেন, তুমি?
বাবার
সাথে এ রকমটি যে শর্ত ছিলো! বাবা যখন আমাকে স্টেট লিখিয়ে দিতে চাইলেন, তা নিতে আমি অস্বীকার করলাম। কিন্তু বাবা কোন ভাবেই
তার পুরো সম্পদ আমাকে না দিয়ে ছাড়বেন না। আমাকে
বললেন, মারে! এতিমখানার একটি শিশু জীবনে অনেক কষ্টে প্রতিষ্ঠিত হয়েও একটি সন্তানের
অভাবে সুখী হচ্ছিলো না। তোকে যখন এ সংসারে
নিয়ে এলাম, তুই তো এ সংসারটাকে সুখ দিয়ে ভরিয়ে দিলি ! অতি কষ্টে অর্জিত এ সম্পদ মা
! তোকে দিয়ে যেতে পারলে আমার মনে আর কোনো দঃখ থাকতো নারে মা!.... আমি বললাম, তাহলে
একটি ট্রাস্ট করে উইল করে যাওনা বাবা ! পরকালে তোমার আত্মার শান্তি হবে! … বাবা বললেন,
নারে মা, আমার মন চাইছে তোকে সব কিছু আমি দিয়ে যাই। তুইও তো আমার মতো এতিম ছিলি। আমি মরে গেলে আবারও এতিম হয়ে যাবি। একটা এতিম আর
একটা এতীমকে তার সবকিছু দিয়ে গেলে আল্লাহ পাক যে বেশি সন্তুষ্ট হবেন ! আমার মনটা যে
তাই বলছে ! রাজি হয়ে যা মা। তবে তোর কোন শর্ত
থাকলে আমাকে বলতে পারিস। ….
অগত্যা বাবার সাথে আমার দুটি শর্ত
হলো। এক, বাবার মৃত্যুর পর আমি এ সম্পদ যাকে ইচ্ছে দান করতে পারব। তবে, তার ভাবি জামাতার মতামত সাপেক্ষে। দুই, এস্টেট পরিচালনার ভার আমি বেঁচে থাকতে অন্য কাউকে দিতে পারবো না। কেবল মাত্র তার ভাবি জামাতা ছাড়া।…কিছুক্ষন চুপ থেকে তারানা আবার বলে চললো,… তবে চিন্তার কোন কারণ নেই। তোমার ঠিকাদারীর চাইতে এখানে মাসিক আয় কম হবে না। পারিশ্রমিক স্বরূপ মাসুদ এস্টেটের
ডিরেক্টরকে বাবা তার ঢাকার দুটি ফ্যাক্টরির মালিকানা দিয়ে গেছেন। আর তুমি রাজি থাকলে বাবার বাকি সব সম্পত্তি আমি বাবার নামে একটি
ট্রাস্ট গঠন করে সে ট্রাস্টে দান করে দেবো।
তাহলে তোমার থাকলো টা কি, তারানা?
কেন? তুমি!
আমি যে তোমাকে
পেয়েছি সুমন! জীবনে এর চাইতে বেশি আমার আর কিছুই চাওয়ার ছিলো না? আল্লাহ
যে তোমাকে আমায় পাইয়ে দিয়েছেন, তাতে
আমার হাজার শোকর! আর লিটা হলো আমাদের দুটি জীবনের পরিপূর্ণতার আইকন!
তারানার কন্ঠ ভারী হয়ে আসে।
তারানার
প্রাপ্তিকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য আমি তারানাকে
আদর দিতে হাত বাড়ালাম। তারানার সত্যি এখন অনেক অনেক আদর দরকার।
আমার
আদর পেতে তারানা আমার কাছে আরো ঘন হয়ে ঘেঁষে আসে।
কোন মন্তব্য নেই
50