Header Ads

বড় গল্প: কাগুজে ফানুস


 কাগুজে ফানুস

 

এক

অফিসে আসার আধঘন্টা পর রায়হান দেখলো, কে একজন মহিলা তার চেম্বারের দরজার পর্দা সরিয়ে একবার উঁকি দিয়ে তড়িৎ বেগে আবার চলে গেলো

অনেকদিন আগে দেখা কোন অপসৃয়মান মুখের আদল, যা রায়হানের স্মৃতি যন্ত্রে ঝিক করে একবার বেজে গেলো মাত্র । রায়হান মহিলাটির মুখের অদলটি স্পষ্ট করে বুঝতে পারলো না।

কিন্তু এভাবে একটি মহিলার উঁকি দেয়াটাকে রায়হান তার ভাবগম্ভীর ব্যাক্তিত্বের উপর অপমানজনক বলে মনে করলো।  ক্রোধে নিজের অফিস রুমের মস্ত বড় টেবিলের এক প্রান্তের একটি সুইচ টিপে বেল বাজালো । বেলের বিকট শব্দ শুনে হুড়মুড় করে ভীত সন্ত্রস্ত পিয়ন এলো এবং সালামঠুকে আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো।

বিকট স্বরে রায়হানের কণ্ঠে গরল বেরিয়ে এলো ….

থাকো কোথায়? চাকরিটা কি হারাতে চাও ?

হিমসিমিয়ে চুপসে গেলো পিওন …

মাফ করবেন স্যার ।  এমনটি আর হবে না । উনি আজাদ সাহেবের আত্মীয়া । তাই কিছু বলতে পারিনি স্যার

আজাদ সাহেবের আত্মীয়া ? কি হয় আজাদ সাহেবের ?

তাতো জানি না স্যার । তবে আজাদ সাহেবের সাথে মাঝে মাঝে দেখি । আবার মাঝে মাঝে একই গাড়িতে করে বাড়িতে ফেরে। কিছুদিন আগে হিসাব শাখায় জয়েন করেছে শুনলাম।

আজাদ সাহেবের কথা ভাবল রায়হান । পিএম সেকশনের এক্সেসিউটিভ । রায়হানদের কলেজের প্রাক্তন প্রফেসর । গম্ভীর রাগী স্বভাবের । বোটানির প্রফেসর ছিলেন আজাদ সাহেব । কট্টর নীতিবাজ বলে ছাত্ররা ওনাকে ঈশ্বরের ঢাক বলে অপবাদ দিতো । কয়েক বছর আগে পরীক্ষার হলে কোন এক নেতাকে অসৎ উপায় অবলম্বনের অপরাধে অকস্মাৎ এক্সপেলট করলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় । সে আন্দোলনের জের সহ্য করতে পারেনি আজাদ স্যার । চাকরি ছেড়ে দেন এবং এই অফিসে উনিই এখন নির্বাহী এক্সিকিউটিভ । বর্তমানকার আজাদ সাহেব এবং পূর্বেকার প্রফেসর আজাদ সাহেবের নৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে রায়হান । ক্ষণিকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে রায়হান যে চাকুরীর পসিশন ও পরিবেশের কারণে আজাদ স্যারের নৈতিক অধঃপতন হয়েছে । তা না হলে অফিসের একজন সোমত্ত মহিলা অফিসারকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বেড়ানোর কারণই বা কি? রায়হানের মেজাজে আগুন ধরে যায় এবং সে আগুনে পিয়নকেই পোড়াতে থাকে ….

দেখো, চাকরি যদি করতে হয় তাহলে ঠিক মত ডিউটি দিতে হবে । নতুবা ডিসমিস করে দেব । আজাদ সাহেবের আত্মীয় হোক আর যেই হোক, এ ধরনের উঁকিঝুঁকি আমি ট্রলারেট করব না । যাও!

রায়হানের কথা শেষ হতে না হতেই টেলিফোন বেজে ওঠে । টেলিফোনের রিসিভার তুলে ওপাশের কণ্ঠটিকে বুঝে উঠতেই কন্ঠে একটা ঘেন্নার সুর মিশে যায় রায়হানের । গম্ভীর কন্ঠে রায়হান ওপাশের কণ্ঠ টির সাথে কথা বলতে থাকে ….

জি, আমি রায়হান চৌধুরী বলছি । হ্যাঁ, আমাদের সেকশন এক্সেকিউটিভের কথা বলছেন তো ! উনি আসলে আমি পাঠিয়ে দেবো । না, আমি সুস্থ আছি । না না, আপনার উদ্বেগের দরকার নাই । আমি সুস্থ, ধন্যবাদ । না, আমি  এখন আসতে পারবো না । বললাম তো, আমার কাজ পড়েছে । হাতে কাজ আসতে পারবো না । আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে, আসবো একবার । ও কে।…

ওপাশের কণ্ঠটি রিসিভার রেখে দিতেই রায়হান ভাবে - আজাদ স্যারের এমন অধঃপতন কেমন করে হলো ? কেমন করে ঈশ্বরের ঢাকের উপরে ময়লা জমে জমে ঢাকটি শয়তানের মণ্ডপে পরিণত হলো?

রিসিভার হাতে রেখেই রায়হান কলেজ ক্যাম্পাসের পুরনো স্মৃতির ময়লাটে পাতা উল্টোতে থাকে। … শ্যামল সবুজে ঘেরা সরকারি কলেজ । বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে সবুজ মাঠ । পিচঢালা রাস্তা বর্নালি পুষ্পিত উদ্যানগুলোকে নিয়ে অপরূপ সোভায় শোভিত কলেজ ক্যাম্পাস । বোটানিতে অনার্স নিয়ে সে কলেজে পড়তো রায়হান । রীতিমতো সম্মান নিয়ে আগের ক্লাস গুলো ডিঙিয়ে এসেছে । অনার্সেও ফার্স্ট ক্লাস পাবার চেষ্টা করছে । অবসর সময়ে ক্লাসে না-বোঝা পড়াগুলো বুঝতে স্যারদের কাছে যেতো সে রীতিমতো ।  স্যারেরা ডিকটেশন দিতেন ।  আর রায়হান খাতায় নোট রাখতো ।   আজাদ স্যার ছিলেন সাইটোলজির অধ্যাপক।  সিটোলজি খুবই কঠিন সাবজেক্ট।  এ কারণে আজাদ স্যারের কাছেই যাওয়া হতো তার ঘন ঘন। স্যারের মুখে সাইটোলজির কঠিন কঠিন তত্ত্বগুলোকে রায়হানের আরো কঠিন বলে মনে হতো।  তবুও পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট পাওয়ার মানসে রায়হান সময় পেলেই আজাদ স্যারের চেম্বারে গিয়ে হাজির হতো। ভয়ে ভয়েই আজাদ স্যারের রুমে যেতো। নিরানন্দের মধ্য দিয়ে ডিক্টেশন নিতে থাকতো।

একদিন আজাদ স্যারের চেম্বারের সামনে এসে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো রায়হান ….

মে আই কাম ইন স্যার !

একটি মেয়ে কন্ঠ ভেসে এলো, আব্বু নেই , বাথরুমে গেছে।  ভিতরে আসুন । ভিতরে ঢুকে রায়হান দেখে, গোলগাল মুখওয়ালা ডাগর চোখের ফর্সা একটি মেয়ে বসে আছে স্যারের পাশের চেয়ারটিতে । অভিবাদন করে একটি চেয়ার দেখিয়ে মেয়েটি রায়হানকে বসতে বলে চেয়ারে । পরোক্ষনেই আজাদ স্যার চেম্বারে ঢুকেন । রায়হান উঠে দাঁড়ায়..

মাই বয় !  তোমার মনে হয় আসতে একটু লেট হয়ে গেলো ! কাল থেকে একটু আগে আসার চেষ্টা করো । প্রতিদিন রেনু মাকে আমার বাসায় নিয়ে যেতে হয় । ও স্যরি, তোমার সাথে তো পরিচয়ই করানো হলো না । দিস ইজ মাই অনলি ড’টার । এডমিটেড ইন দিস কলেজ দিস ইয়ার  ইন বেঙ্গলি অনার্স । তার ক্লাস একটা বাজতেই শেষ হয়ে যায় । প্রবলেম হলো, আমাকে ছাড়া সে বাসায় যাবে না । বলতো, একমাত্র মেয়ের আবদার ! মেয়েটির দিকে মুখ করে আজাদ স্যার রায়হানকে রেনুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, …. ও হচ্ছে রায়হান । এবার বোটানির লাস্ট ইয়ারে । উই এক্সপেক্ট দ্যাট, হি উইল সিকিউর ফার্স্ট ক্লাস ইন দা ফাইনাল এক্সাম ।

ক্ষণিকে চঞ্চলা মেয়েটি আরো চঞ্চলা হয়ে ওঠে । চট করে উঠে দাঁড়িয়ে রায়হানকে সালাম জানায় এবং বসেই স্যারকে আদুরে ভাসায় ভর্তসনা করতে থাকে । আব্বু, তুমি কি আমার সাথেও ইংরেজিতে কথা বলবে ? ইংরেজিতে কন্ঠস্থ করার জন্যই কি আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিল । আব্বু, তোমার ইংরেজি বলার ঝাল মিটাতেই আমি কিন্তু বাংলায় ভর্তি হয়েছি । তোমার ইংরেজিকে আমার বাংলার যাঁতাকলে পিষিয়ে পিষিয়ে মারবো।

আজাদ স্যার গমগম হাসিতে ভেঙ্গে পড়লেন । অনলি চাইল্ড !  তোমার যাতা কলের পিটুনিতে আমার মুখ থেকে যে আর্তনাদ বেরুবে, সেটাও কি ইংরেজিতেই হবে না !

সবাই হেসে উঠলো। 

আজাদ স্যার ডান হাতের তর্জনী তুলে রেনুকে  বললেন, আমি এখন রায়হানকে ডিকটেশন দেব, তুমি চুপটি করে বসে থাকো। এরপর আজাদ স্যার রায়হানের দিকে ফিরলেন এবং বললেন মাই বয়

রায়হান ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করতে করতে রেনুর দিকে তাকালো । দেখলো এক অদ্ভুত মুখভঙ্গিতে রেনু স্যারকে ভেংচি কাটছে । মনের অজান্তেই রায়হান হেসে ফেললো । স্যার তখন বইয়ের পাতায় সাইকোলজির কঠিন কঠিন তত্ত্বগুলোকে আওড়ায়ে বেড়াচ্ছেন। এ ফাঁকে রেনু স্যারের টেবিলের উপর হতে খবরের কাগজ খানা নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতো। কাগজের টুকরোগুলোকে একসাথে একত্র করে ডান হাতে উঁচিয়ে বাতাসে ছড়িয়ে দিতো। কি এক আকর্ষণে রায়হান তাকিয়ে থাকতো রেনুর দিকে। রেনু তখন ছোট্ট বালিকাটির মত কাগজ ওড়ানোর খেলায় মত্ত।

রায়হানকে ডিক্টেশন দেয়া শেষ হলে প্রতিদিনকার মতো স্যার রেনুকে নিয়ে বাসায় ফিরেন। একদিন রায়হান অনুভব করে, রেনুর ছড়িয়ে দেয়া কাগজ উড়ে উড়ে রায়হানের মনের সবুজ মাঠে একটা একটা রঙিন ফানুস হয়ে উঠছে রায়হান কলমের ডগা দিয়ে কাগজের উপর স্যারের দেয়া ডিকটেশন লিখে চলত । আর মনের চোখ দিয়ে রেনুর উড়িয়ে দেয়া ফানুষগুলোকে মুগ্ধ হয়ে দেখতো। সাইটোলজির কঠিন তত্ত্বগুলো রায়হানের কাছে আর কঠিন মনে হতো না । প্রতিদিন সাইটোলজির কঠিন কঠিন তত্ত্বগুলোকে সহজ করে নেয়ার তাড়নায় স্যারের চেম্বারে এসে হাজির হতো । অবশেষে স্যারের সাইটোলজিতত্ত্বের ভান্ডার একদিন খালি হয়ে গেলো । স্যার তাকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দিলেন।

লুকিয়ে লুকিয়ে রেহানাকে দেখার সুযোগ হারিয়ে রায়হান চিন্তায় পড়ে গেলো এবং বুদ্ধি করে সাইটোলজির কঠিন কঠিন তত্ত্বগুলোকে বোধগম্য করানোর অজুহাতে মাঝে মাঝে স্যারের চেম্বারে গিয়ে হাজির হতো । স্যার প্রতিদিন এক একটি তত্ত্বের ব্যাখ্যা করতেন আর রায়হান সে সুযোগে স্যারের জগৎ ছেড়ে চলে যেতো অন্য জগতে। যেখানে রেনু তার কাগজের টুকরোগুলোকে উড়িয়ে চলেছে, আর রায়হান সে টুকরোগুলোকে দিয়ে রঙ্গিন রঙ্গিন ফানুস বানিয়ে আকাশের উঁচু নীলিমায় ঊড়িয়ে চলেছে।  কিন্তু একদিন রায়হানের সে সুযোগও ফুরিয়ে এলো এবং পরীক্ষার পরপর রায়হান রেনুর মাঝে কাগজ উড়ানো এবং ফানুস বানানোর খেলাখেলির সমাপ্ত হল।

টেলিফোনের রিসিভারটি নামিয়ে রাখে রায়হান । রায়হান ভাবে, এরপরে কতগুলো বছর কেটে গেলো। রেনুর কথা আর মনে রাখেনি রায়হান। আজ পরিবেশের খপ্পরে পড়ে শ্রদ্ধাবান প্রফেসর তার নিজের মেয়ের মতো আর একটি মেয়েকে নিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে বেলেল্লেপনা করে । মনে মনে রায়হান টেলিফোনের কণ্ঠটিকে ভর্তসনা করতে থাকে ।

 

দুই

টেবিলের উপর রাখা গাদা গাদা ফাইল হতে রায়হান একটি ফাইল টেনে নেয়। ফাইলটিতে চোখ বুলাতে রায়হান তার অফিসের সামনে পিওনের কণ্ঠের একটি আকুতি শুনতে পায়, …. সাহেবের বিনা পারমিশনে আপনাকে ভেতরে যেতে দিলে স্যার আমার চাকরি খাবে । আর মহিলার জেদ হলো, বিনা পারমিশনেই সে রায়হান সাহেবের সাথে দেখা করবে। এক পর্যায়ে পিয়নকে ঠেলে দিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ে মহিলাটি । ডাগর চোখা মহিলাটি রায়হানের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং বিকট চিৎকারে ফেটে পড়ে ….

রায়হান চৌধুরীর বিনা পারমিশনে তার অফিসে ঢুকলে কি শাস্তি হবে, তা আমি এখনই স্বচক্ষে দেখতে চাই । বলেই মহিলাটি আগুন ঝরা চোখে তাকিয়ে থাকে রায়হানের দিকে । পরিস্থিতির আকস্মিকতায় রায়হান বিমূঢ় হয়ে উঠে দাঁড়ায় । মহিলাটিকে কি বলবে ভেবে পায় না রায়হান ।  মহিলাটির আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়েই রায়হান তার চোখ দুটো নিবদ্ধ করে মহিলাটির মুখের উপর । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে মহিলাটির মুখের দিকে । মহিলাটির কন্ঠ আবার ঝাঁপিয়ে ওঠে ……….

জানি, রায়হান চৌধুরীর কিছুই করার সাহস নেই । করা তো দূরের কথা, কিছু বলার সাহসও হারিয়ে ফেলেছেন উনি । বোবা রায়হান চৌধুরীর জন্য এটাই তো স্বাভাবিক ……

মহিলাটি দ্রুত অফিস ত্যাগ করে । রায়হান তাকিয়ে থাকে তখনও মহিলাটির গমন পথের দিকে । মোটা ক্যানভাসের পর্দাটি এখনো নড়ছে।  থমথমে বাতাস । নিঃশব্দ পরিবেশ। কোথাও কোন কোলাহল নেই । রায়হান দাঁড়িয়ে থাকে আহত শরবিদ্ধ পাখির মতো ।

একটু পরেই ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকে পিওন কদম । কিছু একটা বলার চেষ্টা করে । জড়িত বাষ্পালু কণ্ঠে গদ গদ করে কিছু বলার চেষ্টা করে। কথা বলতে ব্যর্থ হয়ে হাত দুটো জোর করে রায়হানের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে । রায়হান চেয়ারে বসে শান্ত হবার চেষ্টা করে । রিভলভিং চেয়ারে একবার দোল খেয়ে কদমের দিকে ফিরে তাকায় এবং শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ….

গত পরশু উনিই কি আমার পর্দা ঠেলে উঁকি দিয়েছিলেন ? ….

জি স্যার।  এই  মহিলাই আজাদ সাহেবের সাথে ঘুরে বেড়ান । বড় চরিত্রহীনা স্যার।

চেয়ার থেকে স্প্রিং এর মত লাফ দিয়ে উঠে রায়হান  ….

আর একবার বলেছো তো তোমার জিভ কেটে দেব । গেট আউট !

বিব্রতকর পরিস্থিতির তোড়ে কদম বেরিয়ে যায় । অফিস রুমে থম থমে পরিবেশ । রায়হান দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ নিঃচুপ হয়ে, আনমনে । উড়ে যায় দূর দূরান্তে বলাকা হয়ে । খুঁজে পেতে চেষ্টা করে তার অতীতকে, নীল দিগন্তের অসীমে, যেখানে রেনুর ফানুষগুলো তখনও নীল আকাশে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।

টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে চমকে ওঠে রায়হান । রিসিভারটি হাতে তুলে নেয় । ওপারের মানুষটিকে একটি সালাম দিয়ে চেয়ারে বসে কথা বলতে থাকে ….

ভালো স্যার,  আপনি কেমন আছেন স্যার । না না, আমার স্বাস্থ্য ভালই ছিল স্যার । একটু মানসিকভাবে অন্যরকম ছিলাম স্যার।  না স্যার । অন্যরকম ব্যাপার স্যার।  না, বলা যাবে না স্যার। ওই দিনের ব্যবহারের জন্য আমি বিশেষভাবে দুঃখিত স্যার। হ্যাঁ অবশ্যই দেখা করব স্যার। আগামী দিনই । টিপিন পিরিয়ডে স্যার । আসসালামু আলাইকুম।

 

তিন

আজাদ সাহেবের রুমে ঢুকেই একটু থেমে দাঁড়ালো রায়হান । দরজার দিকে পিঠ রেখে রেনু নিঃচুপ বসে আছে । ধীর গতিতে টেবিলের কাছে এগিয়ে যায় রায়হান । রেনুর পাশের চেয়ারটিতে চুপচাপ বসে পড়তেই রেনুর সাথে একবার চোখাচোখি হয়ে যায় তার । আজাদ সাহেব টেলিফোনে কার সাথে যেন আলাপ করছেন । রায়হান বসে থাকে । রেনুও চুপচাপ বসে থাকে । উভয়েই আজাদ সাহেবের টেলিফোনের কথোপকথন শুনতে থাকে । এজন্যই আসা যেন উভয়ের এই অফিস রুমে ।

রিসিভার রেখেই আজাদ সাহেব রায়হানের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান

আরে রায়হান, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি । এমডির সাথে ফ্যাক্টরি ইনসেনটিভ এর ব্যাপারে জরুরী আলাপ হচ্ছিল । আগামীকালই গভর্নিং বডির মিটিং বসবে । তা তোমরা চুপ করে এতক্ষণ বসে থাকলে কেন । তোমরা তো কথা বলতে পারতে !

এর উত্তরে কি বলতে পারে রায়হান কিছুই খুঁজে পেল না । তার বাম পাশের মহিলাটিই প্রথম কথা বলে…..

আমার সাথে তো ওনার পরিচয় হয়নি আব্বু । কথা বলব কেমন করে । একটা অচেনা লোকের সাথে কথা তো বলা যায় না।

আশ্চর্য হয়ে পড়েন আজাদ সাহেব । ভ্রু কুঁচকে উভয়ের দিকে একবার চোখ বুলান ….

বলিস কিরে ! রায়হানকে তুই ভুলে গেলি?  আরে, আমার ছাত্র রায়হান, মনে নেই ? ওই যে তোর সাথে একদিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম ! হ্যাঁরে তুই যখন সবেমাত্র অনার্সে ভর্তি হলি, তখন সে ফাইনাল দিচ্ছিল। ওই তো ওই বার আমাদের কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল । কিরে মনে পড়ে না? …

তুমি থামোতো আব্বু । এক পক্ষ চিনলে কি হয়? উনার তো আমাকে চিনতে হবে !

বলিস কি,  রায়হান বুঝি তোকে চেনেনি ! কি রায়হান, তুমি নাকি ওকে চিনতে পারোনি । আরে তোমাকে যতক্ষণ ডিকটেশন দিতে থাকতাম,  ততক্ষণ আমার পাশে বসে থাকতো । আমাকে ছাড়া কিছুতেই বাসায় ফিরতে চাইতো না । মনে নেই তোমার ?

রেণু মিথ্যে বলেছে স্যার । আমরা উভয়ে উভয়কে চিনি।  কত বছরই বা হল । আসল কথা হচ্ছে, আমি জানতাম না, উনি যে এখানে জয়েন করেছেন ।

সে কি কথা ! কেন তুমি জানতে না ? রেনু জয়েন করেছে এক মাস তো প্রায় হলো।

গত পরশু আমি ব্যাংকক থেকে ফিরেছি স্যার । দু মাসের একটা ট্রেনিং প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম । আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন স্যার।

ও!  আই এম স্যরি । আমি সেটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম । রেনু কবে থেকে এখানে চাকরির প্রসেসিং করেছিল আমি তা জানতাম না । জয়েন করে তবে আমাকে জানিয়েছে । তাহলে এখনই কি তোমাদের প্রথম দেখা ?

না আব্বু । আর একবার হয়েছিল । তখন উনি বোবা ছিলেন ।

উভয়ের দিকে একবার সস্নেহ দৃষ্টি বুলালেন আজাদ সাহেব । অতঃপর মুখে উদ্বেগ ফুটিয়ে বললেন …. তোমাদের মাঝে ঝগড়া হয়নি তো কোনো ?

না ঝগড়া হবে কেন ? সমস্বরেই বলল রায়হান ও রেহানা। একই সাথে, একই সুরে । উভয়ের কথা দুটি একসাথে বেজে উঠলো বলেই হয়তো উভয়ে উভয়ের প্রতি দৃষ্টি বুলালো একবার । সোল্লাসে  বিকট শব্দ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন আজাদ সাহেব …

তা বলো রায়হান, কি খাবে, গরম না ঠান্ডা ?

না স্যার, কিছুই না । আমাকে চলে যেতে হবে এক্ষুনি । এক্ষুনি এক্সিকিউটিভ সাহেবের সাথে মিটিং আছে । দুটোর পর।

সে কি, তুমি না গতকাল আমার সাথে কমিটমেন্ট করলে যে আজ আসবে । তাই এসেছ, রেনু মাও আছে । ভাবলাম, অফিস আওয়ার পার করে দিয়ে একটু আলাপ করব । আর তুমি এক্ষুনি চলে যেতে চাচ্ছ?

তা তো কমিটমেন্ট দিয়েছিলাম স্যার । এদিকে পারচেস সেকশনের অডিটে বিরাট একটা গোলমাল দেখা দিয়েছে । তা নিয়ে সাংঘাতিক রকমের হৈচৈ পড়ে গেছে ।  মিটিংটা একেবারেই জরুরী । আর প্রোগ্রামটা হঠাৎ করেই হয়েছে স্যার । ভাবছিলাম স্যার, না এসেই টেলিফোনে আপনাকে জানাই,  সাহস হলো না । তাই একটু বলে যেতে আসলাম।

তা না হয় হলো।  কিন্তু একটা প্রোগ্রাম করে রেখেছিলাম যে, আমি তোমাকে নিয়ে আজকে আমাদের বাসায় সবাই মিলে একসাথে খাব । ব্যাপারটা কেমন হলো ?

তা আরেকদিন স্যার, আজ নচেৎ আসি স্যার ।

তা কি আর করার ! আসো।

রায়হান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় । রেহানার দিকে ফিরে তাকিয়ে ইতস্তত করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে । মনে পড়ে, সে কখনো রেনুর সাথে কোনদিন কোন কথা বলেনি । রেনুই বলেছে দু একটা টুকিটাকি । কি বলবে ভেবে পেল না রায়হান । কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে ব্যস্ততার ভান দেখিয়ে ছোট্ট একটা ধোনি বের করে রায়হান - আসি । ক্যানভাসের মোটা পর্দা ঠেলে বেরিয়ে আসে রায়হান ।  

আজাদ সাহেব চোখের চশমাটি খুলে রেহানার দিকে একবার ফিরে তাকান এবং রুমাল দিয়ে খুব দ্রুত চশমার কাঁচ মুছতে থাকেন।

 

চার

অফিস আওয়ার শেষ হয়ে গেছে একদম । সমস্ত ফাইল সামনে নিয়ে কাজের মধ্যে ডুবে আছে রায়হান । কাজ করতে করতেই অনুভব করল সে, পর্দা ঠেলে কে একজন টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে । জরুরী ফাইল । রায়হান কমেন্ট লিখে দিয়েই দর্শনার্থীর প্রতি মনোযোগী হবে । একটু ওয়েট করুক দর্শনার্থী । একটু দূরে দাঁড়ানো দর্শনার্থী একটি চেয়ার দখল করে বসে পড়লো । রায়হান স্বস্তি পেল । আর মাত্র এক মিনিটের মধ্যেই তার ফাইল ওয়ার্ক শেষ হয়ে যাবে।

দর্শনার্থীর এক মিনিটও অপেক্ষা করার সময় নেই হয়তো । উঠে এসে সামনে এসে দাঁড়ালো । রায়হান ফাইল হতে দৃষ্টি তুলে দর্শনার্থীর প্রতি দৃষ্টি দিলো । মুহূর্তে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো ….

আরে রেনু যে ! আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি । কাজের ব্যস্ততায় ফাইলের ভেতর ডুবে ছিলাম । আপনি এসেছেন বুঝতে পারিনি। এক মিনিট বসুন প্লীজ, মাত্র এক মিনিট।

রেহানা চুপটি করে টেবিলের উপর রাখা নথি গুলোর উপর চোখ বুলাতে থাকে । ফাইল ওয়ার্ক শেষ না করেই রায়হান রেহানাকে জিজ্ঞেস করে ….

তা ছুটি হলো কখন ? যাননি এখনো?

রেহানা মাথা দোলায়, যায়নি

নিশ্চয়ই কোন দরকার?

রেহানা মাথা দোলায়, হ্যাঁ । দরকারি কাজে সে এখানে এসেছে । স্মিত হাসে রায়হান । রেহানার মলিন মুখের উপর দৃষ্টি মেলে রায়হান ব্যস্ততা ফুটিয়ে তোলে …..

তা বলুন, আপনার জন্য কি করতে পারি ? …….কোন কথা বলে না রেহানা । চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে মুক হয়ে বসে থাকে । হাতে ঘড়ি দেখে রায়হান । আর মাত্র পাঁচ মিনিটে ফাইল ওয়ার্ক শেষ করে বাসায় ফিরতে পারে সে । মুখে কমনীয়তার সুর এনে বিনয়ের সাথে রেহানাকে বলে ….

এক্সকিউজ মি, মাত্র পাঁচটা মিনিট আপনার কাছে ধার চাচ্ছি । আগামীকাল ফাস্ট আওয়ারে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের কাছে ফাইলগুলো পাঠাতে হবে । প্লিজ আপনি বসুন ! মাত্র পাঁচ মিনিট । একদমেই কথাগুলো বলেই ফাইলের উপর কলম চালাতে থাকে রায়হান । কাজ করতে করতেই অনুভব করে, দুটি করুন চোখের দৃষ্টি তার মুখের উপরে লেপটে আছে। রেহানার ডাগর চোখের চাহনি কতদিন ধরে দেখেনি রায়হান । ডাগর দুটি চোখে এক সাগর নীলের শান্ত সৌন্দর্য । রেহানাকে দুচোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে হলো রায়হানের । মুহূর্তে কি থেকে কি হয়ে যায়, চকিতে রেহানা উঠে দাঁড়ায় । পর্দা ঠেলে বেরিয়ে যায় । রায়হান উঠে দাঁড়িয়ে একবার ডাকারও সুযোগ পেলো না ।  মুক-বিমূঢ় রায়হান বসে থাকে জড়ো পিন্ডের মত । রেহানার অসামঞ্জস্য ব্যবহারের প্রেক্ষিতটি রায়হান ভাবতে থাকে । ভাবনার যেন সমাপ্তি নেই… তল নেই..

 

পাঁচ

অফিসে এসে রেহানা মৌন পদক্ষেপে সামনে এসে দাঁড়ায় রায়হানের । রায়হান আশ্চর্য হয় । রায়হানের চোখে চোখ রাখে রেহানা। রেহানা একটি চেয়ার টেনে নেয় এবং চেয়ারে গা এলিয়েই দিয়ে কন্ঠ খুলে …..

আমি চা খাব

অফকোর্স, সিউর ! রায়হান বেল বাজায়। চায়ের অর্ডার দেয়।

তা এত সাত সকালে ! আরো একদিন তো এসেছিলেন । আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে আপনাকে সেদিন সময় দিতে পারিনি । তা বলুন , কি কাজে লাগতে পারি ?

কেন, এখানে কি দরকার ছাড়া আসতে নেই ? রেগে যায় রেহানা।

রেগে যাচ্ছেন কেন?  কেন, একশ বার আসবেন । আপনি আসলে তো আমি খুব খুশি হই !

আপনি খুশি হন?  কথাটা রায়হান চৌধুরীর মুখে শুনছি না তো ? আমি আসলে আপনি খুশি হন ? আর একবার বলুন তো ? …..অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ে রেহানা । রায়হান হতোভম্ব হয়ে যায়। প্রত্যুত্তরে কি বলবে ভেবে পায় না । হাসি থামলে রায়হানকে বলে রেহানা …..

পিয়নকে তো বলে রাখেননি আবার রুমে ঢুকতে বাধা দিতে ? তা আর পারবেন না ? পিওন বেটা জেনে ফেলেছে যে আমি আজাদ সাহেবের একমাত্র কন্যা । আমাকে সালাম দিতে একটু দেরি করলেই তার চাকরি চলে যাবে ।

কথাগুলো একদমেই বলে ফেলে কাঁচভাঙ্গা হাসিতে ফেটে পড়ে রেহানা? হাসির রেশ কাটতে না কাটতেই রায়হান কিছু একটা দেখিয়ে হাত তোলে  …..

এই যে, চা এসে গেছে,  চা খান

কেন তাড়াতাড়ি চা খাইয়ে তাড়াতে চান বুঝি?

ছি ছি, কি যে বলেন !

কেন মিথ্যে বলেছি ?

সত্যতারই বা প্রমান কি ?

আপনার মনকে জিজ্ঞেস, করুন না !

তা দেখা যাবে, আগে চা নিন।

থ্যাংকস, তাওতো আমার চেয়ে নেয়া

যেচে যে খাওয়াতামনা না প্রমাণ করবেন কি দিয়ে?

কেন দরকার চাওয়া দিয়ে !

স্যরি, আসেন না তো কখনো !

দরকার হয়নি বলে !

আজ বুঝি দরকার পড়লো?

কেন, চা খাওয়ার জন্য ?

আর লজ্জা না দিলেই কি নয় !

কেন সত্য বলেছি বলে লজ্জা পেলেন ?

শুধু কি চা খাওয়ার জন্য কেউ কারোর কাছে আসে ?

কেন ? রায়হান চৌধুরীর কাছে রেহানার কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে ? কাপুরুষ রায়হান চৌধুরীর কাছে ?

রাগে কাঁপতে থাকে রেহানা । তড়িৎ উঠে সবেগে প্রস্থান করে । ভেবে উঠতে পারে না রায়হান । কি থেকে কি হয়ে গেলো । টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে হাত বাড়ায় রায়হান । রিসিভারটি হাতে তুলে নেয় । ওপারের মানুষটির সাথে কথা বলে ……

আসসালামু আলাইকুম স্যার । ভালো স্যার, আপনি কেমন আছেন স্যার ? কি দরকারে স্যার ? কিসের ইন্টারভিউ স্যার । ক্যানডিডেট সিলেকশন এর জন্য ? কিসের জন্য স্যার ? আচ্ছা, তা আমাকে কেন স্যার ? বাট হাউ ক্যান আই হেল্প হার ? স্যার আজাদ সাহেবের অনুরোধেই কি আপনি ইন্টারভিউ বোর্ডে আমাকে সদস্য হিসেবে রেখেছেন ? না না স্যার, উনার নীতির উপরে আমার বিশ্বাস আছে স্যার। ঠিক আছে স্যার,আসসালামু আলাইকুম।

চেয়ারে বসেই পুরো ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করে রায়হান । যুক্তরাষ্ট্রে সেলস ম্যানেজমেন্ট এর উপর ছয় মাসের একটি ট্রেনিংয়ে সেলস সেকশন থেকে একজন উপযুক্ত ক্যান্ডিডেট বাছাই করবে কর্তৃপক্ষ । পাঁচজন ক্যান্ডিডেটের মধ্যে রেহানা একজন। রেহানা আজাদ সাহেবের মেয়ে। তাকেই । তাকেই বাসায় করবেন বলে ইচ্ছে কর্তৃপক্ষের । রায়হান যে আজাদ সাহেবের একজন ছাত্র, এখানকার বসরা জানেন তা । রেহানার ফেভারে যাতে ডেসিশন আসে, সে কারণেই ইন্টারভিউতে রায়হানকে রাখা।  আগামীকালই ইন্টারভিউর ডেট । তাহলে আজ রায়হানের সাথে রেনুর দেখা করতে আসার কারণই কি তদবির করতে আসা ?  নিশ্চয়ই তা । উপযুক্ত পরিবেশ পাইনি বলেই রেনু কথাটা  তুলার সাহস পায়নি হয়তো । আর পাইনি বলেই এটাসেটার অবতারণা । রায়হানু দেখে নেবে, ইন্টারভিউ বোর্ডে রেনু কিভাবে সাকসেস হয় !

ঠিক এই মুহূর্তে রায়হানের মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা যেন স্বার্থের ঘড়ি ।মহাশূন্যের পরিমণ্ডলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করার জন্যই চারদিকে অন্যান্য গ্রহের সাথে এই ঘূর্ণন । এই ঘূর্ণনের কি আর শেষ হবে না ? এ প্রতিযোগিতার কি আর অবসান হবে না ? কোনো এক দিন মহাপ্রলয়ের দিনে পৃথিবী ধ্বংস হবে সেদিন ধ্বংস হবে রেহানাও ? তাহলে কেন এমন স্বার্থের অন্বেষণে ছুটাছুটি ? রায়হানের মনে হয় তার চতুর্দিকে নিঃসীম মহাশূন্য সে যেন মহাশূন্যের ঘূর্ণন বলয়ের মধ্যে ঘুরছে প্রতিনিয়ত । এ ঘূর্ণনের যেন শেষ নেই। নিঃসীম মহাশূন্যের মধ্যে নিজেকে একটি উপগ্রহ বলে মনে হল রায়হান চৌধুরীর।

 

ছয়

ইন্টারভিউ শেষ হলে গলদঘর্ম হয়ে নিজের অফিস কক্ষে এসে প্রবেশ করে রায়হান । এয়ারকন্ডিশনে নিজেকে সোপর্দ করে চেয়ার জুড়ে গা এলিয়ে দেয় সে । কেমন ধাতের মেয়েরে বাবা ?  প্রশ্নের বানে বানে রেহানাকে জর্জরিত করে দেবে, এটাই ছিল রায়হানের উদ্দেশ্য। নিজের জানা সমস্ত জ্ঞানের আওতায় যত কঠিন ধরনের প্রশ্ন তার মনে এসেছিল,  সব কয়টাই একটি একটি করে অ্যাপ্লাই করেছিল সে । পরাস্ত করতে পারেনি সে রেহানাকে । একের পর এক প্রশ্ন করতে করতে রায়হানের জ্ঞানের ভান্ডে যখন আর একটি প্রশ্নও বাকি নেই, তখনই রায়হান বুঝলো, কত কমই না জানে সে রেহানার চাইতে ! ট্রেনিং এর জন্য যোগ্য প্রার্থী দিয়েছে ইন্টারভিউ বোর্ড । সে আজাদ সাহেবের কন্যা বটে । ইন্টারভিউ বোর্ডের পূর্ব মুহূর্তে রেহানার উপরে যে রোষ ছিল রায়হানের,  অনুভব করল - পানি হয়ে তা মধু ছড়াচ্ছে রায়হানের মনে । রেহানাকে পাবার অযোগ্য অযোগ্য মনে করছে সে নিজেকে। মনে মনে  হাজারবার রেহানার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় রায়হান ।  রায়হান অনুভব করে - হৃদয়ের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রেহানার ছবিটি এতদিন ধরে অস্পষ্ট ছিল । তাই যেন ক্রমে ক্রমে আজ জীবন্ত হয়ে আশ্চর্য মহিমায় রায়হানের মনের আয়নাতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে ।  চোখ দিয়ে সে ছবিটাকে দেখতে থাকে। আর ভাবে, এত মায়া এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল হৃদয়ের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ!  হৃদয়ের সম্পূর্ণ অনুভূতি দিয়ে রায়হান বহুদিন পরে আবার রেহানাকে অনুভব করে …..  বড় বড় ডাগর দুটি চোখ দিয়ে রেহানা তাকিয়ে আছে রায়হানের দিকে । চোখের নীলে এক সাগর মায়া ।  সে মায়ায় আপ্লুত হতে থাকে রায়হান চৌধুরী।

রেহানার মায়ার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে রায়হানের ভালোলাগা মুহূর্তগুলো এগিয়ে চলতে থাকে । নিঃসীম মহাশূন্যের ঘূর্ণন বলয়ে পাক খেতে খেতে ।  একটি উপগ্রহের মতো যেনো ।  রেহানার চার দিকে।  রেহানকে কেন্দ্র করে।

 

সাত

অফিসের কোলাহল শুরু হবার আগেই রেহানা এসে রায়হানের চেম্বারে ঢুকে। রায়হান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মুখে উজ্জ্বল্য মেখে মিষ্টি হাসে ….

আসুন, মিস রেহানা, কংগ্রাচুলেশন ফর ইওর সাকসেস !

থ্যাংক্স

বসুন ..

রেহানা একটি চেয়ার টেনে রায়হানের পার্শে বসে পড়ে । ব্যাগটি খুলে একটি বাক্স বের করে ।  বাক্সের ডালা খুলে বাক্সটি রায়হানের সামনে এগিয়ে ধরে …..

মিষ্টি খান

মিষ্টি কেন?

মিষ্টি খাবেন না ? ছি আপনাকে মিষ্টি খাওয়াবো না ?

! সিওর সিওর । একশো বার খাব ।  পিয়ন ডাকি ? ব্যবস্থা করুক ….

না, কোন থার্ড পারসনকে এখানে আশা করি না ।  একটি মিষ্টি তুলে নেয় রেহানা ।  

মিষ্টিটি রায়হানের মুখের কাছে নিয়ে উঁচিয়ে ধরে

প্লিজ,  হা করুন । মিষ্টিটা খান ।

আমি নিজেই তো খেতে পারব

আহ, যা বলছি তা শুনুন, হা করুন

রায়হান হা করে মিষ্টিটি মুখে নেয় ।  রেহানা মিষ্টি হাসে ।  মিষ্টির বাক্সটি রায়হানের সামনে রেখে বলে .. এবার ভালো মানুষটির মতো একটা একটা করে সমস্ত মিষ্টিগুলো খেতে থাকুন। আমি এখানেই বসে থাকবো এবং দেখবো

পাগল নাকি এতগুলো মিষ্টি আমি একা খাব? তা সম্ভব নাকি?

যতগুলো সম্ভব, প্লিজ !

রায়হান মিষ্টি খেতে থাকে ।  রেহানা তাকিয়ে থাকে রায়হানের মুখের দিকে ।  দৃষ্টির গভীরে স্বপ্নলোকের আচ্ছন্নতা ।  অধরে না বলা কথার ব্যাকুলতা ।  রায়হান অনুভব করে রেহানাকে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না সে।  কথাগুলো এক একটি ঢেউ হয়ে রেহানার গোল রক্তিম অধরে গিয়ে আছড়ে পরে রেহানার অধর ছুঁয়ে রায়হানের কাতর চাহুনি লেপ্টে যেতে থাকে আবেশিত হয়ে । তন্ময় হয়ে রেহানার দিকে তাকায় রায়হান। ভালোবাসার জোয়ারে রায়হানের হৃদয়ের নদী প্লাবিত হতে থাকে ।  রায়হান ছোট্ট করে ডাকে …

রেহানা !

আকস্মৎ রেহানা চঞ্চল হয়ে ওঠে ।  রায়হানের চোখে কি যেন দেখতে পে সে। টেবিলের উপর থাপ্পড় মেরে সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে

জানেন,  আজকে আমার কিসে খুশি লাগছে ? আমি আমেরিকা যাচ্ছি ! কতদিন পর আমার একটা স্বাদ পূর্ণ হবে । কতদিন পর ওকে দেখব !

রায়হান তড়িৎ জিজ্ঞেস - কাকে দেখবেন ?

স্বপনকে, স্বপন তো আমেরিকাতে থাকে ।  ওরিগনে।  ওরিগন স্টেট্ ইউনিভার্সিটিতে ও পিএইচডি করছে !

স্বপনকে ? আপনার কি হয় ?

আমার হাজব্যান্ড ।  আপনাকেতো ওর কথা বলা হয়নি।  আমাদের বিয়ের পরের বছরই ও আমেরিকাতে চলে যায়।

নিমেষে রায়হানের চোখ জুড়ে অন্ধকার ঘিরে আসে ।  পৃথিবী জুড়ে প্রবল ঘূর্ণন অনুভব করে রায়হান। শক্ত করে চেয়ারের হাতল ধরে । কষ্ট করে মুখে কৃত্রিম হাসি টানে …..

ফাইন ! শুনে খুব খুশি হলাম ।  মে ইওর কংজুগাল লাইফ বি হ্যাপি দেয়ার !

হ্যাঁ, তা তো হবে ! বি হ্যাপি এখনো পড়ে আছে, শেষ করুন!

ইম্পসিবল, আর নয় । আপনার জন্য চা আনতে বলি ?

নো থ্যাংক্স।   আপনি বরঞ্চ বেসিনে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিন । সময় পেলে আবার আসবো। ও আচ্ছা, সেটা কি বলুন তো বিয়ে থাকি করবেন না ? যদি বলুন তো আমার একটি নোনোদিনী আছে । লাল টুকটুকে । থাকে আমেরিকাতেই ।

তা তো বহু আগেই গুছিয়ে ফেলেছি ।  ও স্যরি ! আপনাকেতো বলাই হয়নি। আমাদের মেয়ের বয়স এক পড়লো । লাল টুকটুকে । দেখতে এক্কেবারে পুতুলের মত ! যা দুষ্টুমি করে !

আপনি বিয়ে করেছেন ? বিয়ে করেছেন আপনি ?

……..রেহানার হাসির উবে যায় ।  অন্ধকার এসে হলদে মুখখানা কে ছাইয়ে ফেলে ।  একটু হাসি টেনে রায়হান জবাব দেয় ….

কেন ? শুনে কি আশ্চর্য হলেন ? আপনার নোনোদিনীকে না হয় অন্য কোনো বন্ধুর ঘাঁড়ে চাপালেন …

তা কি হয় ? আমরা সবাই মনে মনে আপনার কথা ভেবে রেখেছিলাম । আসি, ধন্যবাদ ।

দ্রুত পা ফেলতেই রেহানা হুমড়ি খেয়ে একটি চেয়ারের উপর পড়ে যায় । রায়হান চেয়ার ছেড়ে উঠে রেহানাকে ধরতে যায় । গা ঝেড়ে রেহানা উঠে দাঁড়ায় ।  রায়হানের দিকে দৃষ্টি বুলায়। অতঃপর ধীর গতিতে পর্দা ঠেলে রায়হানের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ।

 

আট

অফিসে এসেই রায়হান আজাদ সাহেবের টেলিফোন পেল । আজাদ সাহেব বড় বিপদে পড়েছেন । রায়হানের সাহায্য না পেলেই নয় ।

রায়হান দ্রুত আজাদ সাহেবের অফিস রুমের দিকে দৌড়ে চলে । চুপচাপ বসে আছে আজাদ সাহেবের পাশে। কি যেন বলে বোঝাচ্ছেন আজাদ সাহেব রেহানাকে। রায়হানকে দেখেই আজাদ সাহেব ব্যস্ত হয়ে পড়েন ….

এসেছো রায়হান ? বসো বসো । দেখতো রেনু কি পাগলামিটাইনা করছে । তিন দিন বাদে ওর ফ্লাইট ।  অথচ গতকাল অফিসে একটি ইনএবিলিটি লেটার দিয়ে বড় হাঙ্গামায় ফেলেছে

বলেন কি স্যার, সত্যি ?

হ্যাঁ সত্যি । ওপর থেকে বেশ প্রেশার আসছে । স্বল্প সময়ে অন্য ক্যান্ডিডেটের ব্যবস্থা করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয় । আর তা ছাড়া ইডির ইচ্ছা রেনুকেই ট্রেইন্ড আপ করে। তাছাড়া কয়টা মাসের ব্যাপার ! বলতে বলতেই তো কেটে যাবে !  যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায় বেরিয়ে আসা ! সে কি কম ভাগ্যের কথা ! তুমি বাবু ওকে একটু বুঝিয়ে নাওতো, আমি আর পারছিনা ।

সত্যি, এত সুন্দর ট্রেনিংটা মিস করতে চাচ্চে রেহানা। ভাবতেই পারে না রায়হান । রায়হান জানে, রেহানার মত মেয়েকে বোঝানোর জ্ঞান বুদ্ধি তার নেই । যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে রায়হানের যুক্তিকে খন্ডন করবে রেহানা । মনে মনে রেহানার কাছে এর আগেই আত্মসমর্পণ করে নেয় রায়হান। আজাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে ….

স্যার, উনাকে বুঝানোর মত সাহস বা ঔদ্ধত্য আমার নেই । যতটুকু মনে করি, ট্রেনিংটা এভেইল করাটার ওনার প্রয়োজন রয়েছে । যতটুকু আমি জানি, কোয়ালিফাইড অফিসারকেই অ্যাসিস্ট্যান্ট সেলস এক্সিকিউটিভ পোস্টে প্রমোট করা হবে । এটাই সেলসের প্রজেক্ট পলিসি । চাকুরী যদি উনি করেন, তাহলে আমার মনে হয় ট্রেনিংটা মিস করা সেমিসাইডেরই নামান্তর হবে । আর ওখানে গিয়ে যে ওনার মন বসবে না, তা তো নয় । ওনার ট্রেনিং তো অরিগনেই । ওখানেতো উনার হাজবেন্ডই আছেন । না যাওয়ার পেছনেতো কোন যুক্তি থাকতে পারে না ।

রায়হানের কথা শুনেই আজাদ সাহেব চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠেন, বলছো কি রায়হান ! কার হাজবেন্ড থাকে ওরিগনে ?

কেন ? উনার হাজবেন্ড না ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছে ?

কে বলেছে তোমাকে এসব, আজগুবি খবর ?

কেন স্যার, উনিই তো আমাকে বললেন ..

আজাদ সাহেব স্তম্ভিত হয়ে পড়েন ।  কি বলবেন ভাবতে পারছেন না । রায়হানের উপর থেকে দৃষ্টি তুলে রেহানার উপর দৃষ্টি ফেললেন আজাদ সাহেব । আর দৃষ্টির প্রখরতায় নিজের একমাত্র মেয়েটিকে চিনার চেষ্টা করলেন তিনি । মুহূর্ত গড়িয়ে চলল । পিতার দৃষ্টির প্রখরতার তেজ রেহানার মেজাজে আগুন ধরিয়ে দেয় যেন। রেহানা গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ তোলে …. একশোবার বলবো । বলবো, তাতে কার কি হয়েছে ? …

রুম ত্যাগ করে রেহানা ।

আজাদ সাহেব তাকিয়ে থাকেন মেয়ের গমন পথের দিকে, অবিরত, দিধান্বিত । সম্বিত হলে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলেন । একরাশ হাসি আনেন । গদগত কন্ঠে প্র প্রলাপ বকেন,বয়স হয়েছে, রেনু এখনো খুকিটিই থেকে গেছে’ ।

 

নয়

দুদিন পরের কথা । রায়হানের বাসর রাত । একটি কাগজ এনে রায়হান এগিয়ে যায় রেহানার দিকে । হাত বাড়িয়ে রেহানার দিকে উঁচিয়ে ধরে কাগজখানা । কাগজখানা হাতে নিয়ে রেহানা বলে ….

কাগজ দিয়ে কি হবে ?

কেন ? টুকরো টুকরো করে বাসর ঘরে উড়িয়ে দাও । আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি ..

পবিত্র লজ্জায় রেহানার টিম টিম অধর ।  রেহানা  রায়হানের বুকের কাছে ঘেঁষে আসে । রায়হান রেহানাকে আরো কাছে টেনে নেয় । চোখ বুজে দেখতে থাকে - রেনুর ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলো এক একটা ফানুস হয়ে নীল আকাশের অসীম শূন্যতায় ছন্দে ছন্দে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । উড়ন্ত ফানুষগুলোতে রায়হান মুগ্ধ হয়ে রেহানার প্ৰতিচ্ছবি দেখতে থাকে। সস্নেহে, ভালোবাসার রঙিন চোখ দিয়ে। 

কোন মন্তব্য নেই

50

Blogger দ্বারা পরিচালিত.