ছোট গল্প: ছেলেটি ও মেয়েটি
ছেলেটি ও মেয়েটি
এক
ছেলেটি কলেজে পড়ে
মেয়েটি স্কুলে পড়ে
ছেলেটি এ পার্শ্বের জানালায়
মেয়েটি ও পার্শ্বের বারান্দায়
ছেলেটি এপার্শ্বের জানালা হতে ওপার্শ্বের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে
ছেলেটি ওপার্শ্বের বারান্দা থেকে এপার্শ্বের জানালায় বসে থাকা ছেলেটিকে দেখে
অজানা একটা আকর্ষণে তাড়িত ওরা।
ওরা
একে অন্যকে দেখে। শুধুই দেখে। কথা বলে না। আর বললেও মনে মনে বলে।
একে
অন্যের কথা শোনে না।
ছেলেটি এপার্শ্বের দোতলার জানালায়
মেয়েটি ওপার্শ্বের দোতলার বারান্দায়
মাঝখানে তিনশো গজের ব্যবধান।
তিনশো গজ জুড়ে প্রশ্বস্থ লন ও একটি কমিউনিটি সেন্টার। লনটি এপার্শ্বের দ্বিতল দালানের পেছনে,
উত্তরে। কমিউনিটি সেন্টারটি ওপার্শ্বের দ্বিতল দালানের সামনে, দক্ষিণে। কমিউনিটি সেন্টারের এ পাঁচটায় প্রশ্বস্থ পীচ-ঢালা কালো রাস্তা।
রাস্তার এপার্শ্বে এ পার্শ্বের দালানের বাউন্ডারি ওয়াল। বাউন্ডারি ওয়ালের কাছ ঘেঁষে ঘন সবুজ সুঁচালো পাতার ঝাউ গাছের সারি। সুদৃশ্য। মনোরম।
বিস্তৃত স্থান জুড়ে কমিউনিটি সেন্টার
- এ
বাড়ি ওবাড়ির মাঝ বরাবর পশ্চিম দিকে প্রসারিত। এপার্শ্বে বাউন্ডারি-ওয়াল ঘেঁষে ঘন ঝাউয়ের সারি।
এ
বাড়িটিকে ও বাড়ীর মানুষের দৃষ্টির অন্তরাল করে উচু কমিউনিটি সেন্টারের পশ্চিমের অর্ধেক জুড়ে লাইব্রেরী দোতালায়।
পুবের অর্ধেকে প্রশ্বস্থ ছাদ। ছাদের উপরে দুটি বড় বড় পানির ট্যাংকি।
দুই ট্যাংকির মাঝখানে দু’ফুট পরিমাণ ফাঁকা। ছেলেটির জানালা হতে মেয়েটির বারান্দায় দৃষ্টির একমাত্র প্রবেশ পথ। এ পথ দিয়ে ছেলেটির দু’চোখ মেয়েটির দু’চোখের সাথে সরল রেখা টানে।
মেয়েটি দেখে ছেলেটিকে। ওরা শুধু একে অন্যকে দেখে।
কথা
বলেনা। আর বললেও মনে মনে বলে। একে অন্যের কথা শোনে না।
ঝাউয়ের শাখার ঝুলন্ত ঘন সবুজ তোরণের নিচ দিয়ে ছেলেটি মেয়েটিকে দেখে।
মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। স্থির, মৌন। পরনে সাদা জামা। বুকে কালো ওড়না। রেলিং ধরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে।
মাথার দু’পার্শ্বে ফোলানো ফাঁপানো কালো চুল।
পাঁজা পাঁজা কালো চুলের মাঝখানে শুভ্র-
হলদে গোলাকার মুখমন্ডল। ফর্সা, উজ্জ্বল। আকর্ষণীয়,মায়াবী।
মেয়েটি দেখে ছেলেটিকে।
দুই
ট্যাংকির ফাঁক দিয়ে। ছেলেটি বসে আছে স্থির, তন্ময়।
গায়ে সাদা শার্ট। মাথায় কালো চুল।
ছেলেটি মেয়েটির মুখখানাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে।
মেয়েটিও তার দৃষ্টির নোঙ্গর ফেলে ছেলেটির অস্পষ্ট মুখের আদল খোঁজে। দু’জনের মাঝখানে তিনশো গজের ব্যবধান।
পরস্পরে দেখাদেখির তৃপ্তি পায় না ওরা। তবুও মগ্ন হয়ে একে অন্যকে দেখে। একটা অজানা আকর্ষণে। দুজনের মাঝখানে স্বচ্ছ বাতাসের জমাট আস্তর।
এপার্শ্বে ছেলেটি ওপার্শ্বে মেয়েটি।
মেয়েটি বুঝি একটু নড়ে উঠলো।
নড়ে নয়, দুলে উঠলো। বারান্দার রেলিং ধরে মেয়েটি দুলে উঠলো।
ছেলেটিও জানালার মোটা রড মুঠি করে ধরল।
একটু দুলে মেয়েটির দোলার উত্তর দিলো।
মেয়েটি যেনো একটু লজ্জা পেলো।
ঠোঁট চেপে হাসি চাপালো মেয়েটি ।
ছেলেটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
জানালার রড ধরে মুখ খানাকে সামনে এগুলো। লোহার রডে ধাক্কা লেগে কপালে আঘাত পেলো।
আঘাতপ্রাপ্ত কপালে হাত বুলানো। মেয়েটিও কপালে হাত বুলানো।
ঝুলে থাকা চুল গুলোকে এপার্শ্বে ওপার্শ্বে সরালো।
হাসলো ছেলেটি
হাসলো মেয়েটি
দুজনের মনে আনন্দের প্লাবন এলো।
একটি অজানা কারণে ওরা চঞ্চল হলো।
মেয়েটির পার্শ্বে তড়িৎ কে যেনো এসে দাঁড়ালো।
হতচকিত দৃষ্টি দিয়ে মেয়েটি পেছনে ফিরে তাকালো। অতঃপর বিনয়-ভীত পদে বারান্দা থেকে প্রস্থান
করলো ।
ছেলেটি বিরহী হলো।
আগত
মহিলাটির দিকে তীর্যক তাকালো। মহিলাটি তাকিয়ে আছে তারই দিকে।
একটানা, তীব্র দৃষ্টিতে।
ছেলেটি জানালা থেকে সরে দাঁড়ালো।
ওপার্শ্বে ছেলেটির শূন্য জানালায় সমান্তরাল লোহার রড। রডের মাঝখানগুলোতে অন্ধকারের কাল কাল লোহার
ফালি । সারি সারি, সমান্তরাল।
দুই
শীতের সকাল। মেয়েটির বারান্দায় পাঁজা
পাঁজা নরম সোনালী রোদের লুটোপুটি।
ধূসর বারান্দা। সোনালী হলুদ ।
মেয়েটি এসে দাঁড়ালো রেলিং ধরে।
বাম
পার্শ্বে রেলিং ঘেঁষে দাঁড় করানো হার্ডবোর্ডের মুভিং বেড়া
। বেড়াটির পশ্চিমপ্রান্ত পুবপার্শ্বের
পানির ট্যাংকীকে আড়াল করে রয়েছে।
ছেলেটির চোখের কোণে লুকোচুরির অভিপ্রায়!
ছেলেটি সরে এলো জানালার এক্কেবারে বাম প্রান্তে।
ঘাড় বাঁকিয়ে মেয়েটিকে দেখতে চেষ্টা করলো। দৃষ্টির বলয়ে মেয়েটির ডান বাহু
গোচরে এলো ছেলেটির।
মেয়েটিও ঘাড় বাঁকিয়ে উঁকি দিলো । জানালায় দাঁড়িয়ে ছেলেটি। বারান্দায়
দৃষ্টি প্রসারিত করে মুখ সরিয়ে আবার আড়ালে এলো মেয়েটি।
ছেলেটি ঘাড় বাঁকিয়ে আবার মেয়েটিকে
দেখার চেষ্টা করে
মেয়েটিও আবার উঁকি দিয়ে
দৃষ্টি লুকিয়ে আবার পালালো
ছেলেটির অভিমান হলো।
দুটো জানালা আধা আধি বন্ধ করে মাঝখানের ফাঁক দিয়ে মেয়েটির খোলা বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
মেয়েটি ব্যস্ত হলো।
উজ্জ্বল মুখে আঁধারের তমাশা জমলো। দু ট্যাংকির ফাঁক বরাবর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো।
ছেলেটির জানালায় অপলক তাকিয়ে উদ্রিব হলো।
ছেলেটির জানালা খুলে
গেলো। মেয়েটির মুখের তমাশা ছাড়িয়ে হাসির দীপ্তি ছড়ালো।
ছেলেটি আবারো অভিমান দেখাতে চাইল।
ডান
বাহু বাড়িয়ে পশ্চিমের জানালা বন্ধ করার অভিপ্রায় দেখালো।
মেয়েটি দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো।
মুখ
নেড়ে ইনিয়ে বিনিয়ে মিনতি জানালো।
ছেলেটি আঙ্গুল মুঠি করে কিল দেখালো।
মেয়েটি ডান হাত প্রসারিত করে বুড়ো আঙ্গুল দেখালো।
মুক্ত দাঁতের ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে অট্টহাসিতে শরীর দুলালো। বুকের মাঝখানে চঞ্চলা
তরঙ্গ তুলে দৌড়ে পালালো।
ছেলেটি ব্যথিত হলো।
জানালার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে মেয়েটির জন্য উতলা হলো। অধিকক্ষণ অপেক্ষার পর ব্যথাতুর অনুভূতি নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো।
একসময়ে পর্দাটি নড়ে উঠলো।
নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে পর্দা ঠেলে মেয়েটি বারান্দায় আসলো।
প্লেট থেকে নাস্তা নিয়ে মেয়েটি তার মুখে পুরলো।
ছেলেটিও জানালায় বসে নাস্তার প্লেট
হাতে নিলো
মেয়েটি বারান্দায়
দাঁড়িয়ে নাস্তা খায়, আর হাসে
ছেলেটিও এপাশ থেকে সাড়া দেয়
উভয়ে উভয়কে নাস্তা সাধে।
উভয়ে উভয়ের পানে তাকিয়ে হাসে।
জানালার বাইরে হাত দিয়ে মেয়েটিকে ডাকে ছেলেটি
চঞ্চল হেসে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় মেয়েটি
মেয়েটিকে বুকে জড়ানোর ভাব করে জানালার রড জাপটে ধরে ছেলেটি
লজ্জায় দৌড়ে পালায় মেয়েটি
ছেলেটি ঠান্ডা জানালায় বসে থাকেমেয়েটির
আগমনের আশায়। কনকনে ঠান্ডা বাতাস। মেয়েটির বারান্দা শূন্য।
ছেলেটির দৃষ্টি আটকে থাকে দোলায়িত পর্দায় ক্যানভাসের সাদা জমিনে। কালো প্রিন্টের পর্দা।
উপর
থেকে নীচ পর্যন্ত বিস্তৃত। মেয়েটির চলে যাওয়া দরজার মুখোমুখি।
তিন
শীতের সূর্য্য অনেক উপরে।
নীল
আকাশের গা বেয়ে বেয়ে সূর্য্য রশ্মি সোনালী হলদে থেকে রুপালি।
মেয়েটির বারান্দায় সাদা শাড়ি লাল ব্লাউজ পরিহিতা মহিলাটি এসে দাঁড়ালো।
মহিলাটি বারান্দার দড়িতে একটি সাদা শাড়ি শুকোতে দিলো। শাড়িটি ঝুলতে ঝুলতে দু’ট্যাংকির মাঝখানের ফাঁকাটিকে দখল করে নেয়।
ছেলেটির দৃষ্টি ঝুলন্ত শাড়ির এ পার্শ্বে আটকে গেলো।
ছেলেটি বিষন্ন হলো।
মনে
মনে মহিলাটিকে সাত পাঁকে ডুবালো। চোখের দৃষ্টির খোঁচা দিয়ে শাড়িটিকে শতচ্ছিন্ন করলো।
অবশেষে ব্যর্থ হয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করলো।
এক
সময়ে উৎফুল্ল হয়ে দেখলো, শাড়ির এক কোনা সরিয়ে মেয়েটি উঁকি দিলো।
ছেলেটি উল্লাসে নেচে উঠলো
শাড়ির কোনাটি ছেড়ে দিয়ে মেয়েটি আবার লুকিয়ে গেলো।
ছেলেটির জেদ হলো। জানালাটি বন্ধ করে দু’জানালার
ফাঁক দিয়ে একটি চোখ স্থাপন করলো।
মেয়েটি শাড়ি সরিয়ে পুনরায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো
মেয়েটি হেসে দিয়ে তার জবাব দিলো
ছেলেটি মেয়েটিকে হাত ইশারায় কাছে ডাকলো
মেয়েটি হাসতে
হাসতে কিল দেখিয়ে প্রস্থান করলো
ছেলেটির বুকে কাঁপন
ধরলো
চার
বিকেলের মিষ্টি মিষ্টি হলুদ রোদে মেয়েটির বারান্দা ছেয়ে গেলো।
বারান্দায় মেয়েটি ছেলেটির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো। ছেলেটি কলেজ থেকে এসে জানালায় দাঁড়ালো।
ছেলেটিকে দেখে মেয়েটি উৎফুল্ল হলো। মুচকি হেসে সম্ভাষণ জানালো।
ছেলেটি আবেগে আপ্লুত হলো। মেয়েটির জন্য গভীর মায়া অনুভব করলো।
মেয়েটি অকস্যাৎ ঝটপট পেছনদিকে তাকালো।
বুকের ভেতর হাত দিয়ে চিঠির মতো কি একটা কাগজ বের করলো। হাত উঁচিয়ে কাগজ খানাকে ছেলেটিকে দেখালো।
ছেলেটির বুকে কাঁপন জাগলো।
কম্পিত হাতে ছেলেটিও তার টেবিল থেকে মেয়েটিকে লিখা পত্রখানা নিলো। সংকোচে সংকোচে হাত উঁচিয়ে মেয়েটিকে তা দেখালো।
মেয়েটির হাতের কাগজ-খানা নড়ে উঠলো
ছেলেটির পত্রখানাও দোল খেলো
মেয়েটি ছেলেটির অনুভূতিতে মিশে গেলো
ছেলেটি মেয়েটির দৃষ্টির গভীরতায় ডুবে গেলো
মেয়েটি
হঠাৎ করে পেছনে তাকিয়ে নতোমুখি হলো। হাতের কাগজ খানাকে বুকের মধ্যে লুকালো।
ছেলেটি ভয়ে প্রমাদ গুনলো।
সাদা শাড়ি লাল ব্লাউজ মহিলাটি মেয়েটির পার্শ্বে এসে দাঁড়ালো। তীর্যক দৃষ্টি দিয়ে ছেলেটির জানালায় আগুন ঝরালো।
অতঃপর কর্কশ কন্ঠে মেয়েটিকে কি যেনো বললো ।
মেয়েটি নতমুখে দাঁড়িয়ে রইলো।
ছেলেটির করুণা হলো।
মেয়েটির জন্য হৃদয়ে হুহু কান্নার রোল উঠলো।
ছেলেটির জানালায় মহিলাটি আগুন দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলো।
জানালার কাছে ছেলেটি একাকী বসে রইলো।
হাতের পত্র খানা মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো। মেয়েটির বারান্দাটিকে বড় বিষন্ন মনে হলো।
সাদা শার্ট পড়া একটি লোককে নিয়ে মহিলাটি আবার বারান্দায় এলো।
হাতের আঙ্গুল উঁচিয়ে ছেলেটির জানালা দেখালো। লোকটি অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে জানালাটি দেখলো।
অতঃপর এদিক ওদিক তাকিয়ে মহিলাটিকে নিয়ে প্রস্থান করলো।
পাঁচ
দুটো কবুতর বসে আছে ঝাউ এর শাখায়।
পায়রীটি গলা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। পায়রাটি পায়রীর গলায় ঘন নরম পালকে চঞ্চু ঢুকায়ে পায়রীটিকে উষ্ণ আদর দিচ্ছে।
ওদের ভালোবাসার সবুজ কণিকা ঝাউয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসার উষ্ণ আবেগ ছেলেটির মনে পুলক ছড়িয়ে দিচ্ছে।
পায়রা আদর দিচ্ছে পায়রীটিকে। পায়রী দিচ্ছে পায়রাটিকে।
জানালা
হতে পায়রা পায়রীর নিচ দিয়ে ছেলেটি মেয়েটির বারান্দায় দৃষ্টি বুলালো। মেয়েটি স্কুল থেকে ফিরে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো মাত্র।
মেয়েটি দেখলো, ছেলেটি বসে আছে খোলা জানালায়। আনন্দে মেয়েটির বুক নেচে উঠলো।
হাতের স্কুল ব্যাগ দুলিয়ে ছেলেটিকে সে স্বাগত জানালো।
হাত নেড়ে ছেলেটি তার উত্তর দিলো
রেলিং এর উপর ব্যাগ রেখে মেয়েটি তার ব্যাগ খুললো
। সাদা-পত্র খানা বের করে ছেলেটিকে দেখালো।
ছেলেটিও তার প্যান্টের পকেটে হাত রাখলো।
নীল পত্র খানা বের করে মেয়েটিকে দেখালো।
মেয়েটি বাঁ হাত উঁচিয়ে পত্রখানা এগিয়ে ধরলো।
ডান
হাতের ইশারায় পত্রখানা নিয়ে যাবার জন্য ছেলেটিকে ডাকলো।
ছেলেটি জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলো
মেয়েটি হাত মুঠি করে ছেলেটিকে কিল দেখালো
ছেলেটি হাত মুঠি করে মেয়েটিকেও কিল দেখালো
মেয়েটি দুই হাতের তালু এক করে ক্ষমা চাইলো
ছেলেটি হাতের তালুতে আদর খেয়ে হাতখানা মেয়েটির উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারলো
মেয়েটি লজ্জা পেলো।
নরম
হাতের তালু দিয়ে লজ্জা রক্তিম অধরখানাকে ঢেকে নিলো
সাদা শাড়ি লাল ব্লাউজ মহিলাটি ঝড়ের বেগে মেয়েটির পার্শ্বে এসে দাঁড়ালো।
ক্ষিপ্ত হাতে মেয়েটির মাথায় ধাক্কা দিয়ে মেয়েটিকে ভর্তসনা করলো।
মাথা নত করে ধীর পায়ে মেয়েটি বারান্দা ত্যাগ করলো।
মহিলাটি এদিকের জানালাটি দেখলো।
লাল
পানির ট্যাংকির দিকে সন্ধানী দৃষ্টি বুলালো। জানালায় বসা ছেলেটির দিকে আর একবার তাকিয়ে প্রমাদ
গুনলো । অতঃপর ক্ষিপ্ত পদে বারান্দা ত্যাগ করলো।
ঝাউয়ের শাখায় বসা পায়রাটি এখনো পায়রীটিকে আদর দিচ্ছে। ওদের ভালবাসার সিঞ্চনে ঝাউয়ের পাতারা সবুজে সবুজে সিক্ত হচ্ছে।
ছেলেটি মেয়েটির শূন্য বারান্দায় তাকালো।
মেয়েটির জন্য একটা অজানা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। ছেলেটির দৃষ্টি মেয়েটির বারান্দায়। মেয়েটির বারান্দায়
ও ছেলেটির জানালার মাঝের বদ্ধ বাতাসে ঘন অন্ধকারের নিঃশব্দতা। একসময়ে আনমনে মেয়েটিকে ঘিরে ছেলেটি
রঙিন সুতোয় স্বপ্নের জাল বুনতে থাকলো।
ছয়
খুব ভোরে ওঠে ছেলেটি তার জানালা খুললো। দুই টাংকির মাঝ দিয়ে মেয়েটির বারান্দায় চোখ রাখল। ত্রস্ত মনে শিউরে ওঠে দেখলো, মেয়েটির বারান্দা অদৃশ্য হয়ে গেছে!
বারান্দার পূর্ব পার্শ্বের বেড়াটিকে পশ্চিম পার্শ্বে সরিয়ে আনা হয়েছে। একেবারে দুই ট্যাংকির ফাক বরাবর।
ছেলেটি প্রমাদ গুণলো। সাদা শাড়ি লাল ব্লাউজ পরিহিতা মহিলাটিকে মনে মনে অভিশপ্ত করলো। মেয়েটির বিরহে বিরহী হলো। হৃদয়ের মধ্যখানে সংকোচন ব্যথা অনুভব করলো। বিস্তৃত পৃথিবীতে নিজের পরিসরের স্বল্পতা টের পেলো।
নিজেকে বড় একাকী মনে হলো। হৃদয় রাজ্যে শূন্যতার হাহাকার ধ্বনি শুনতে পেলো। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় শরীর জুড়ে স্থবিরতা এলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালো
ছেলেটি।
শূন্য আকাশ ।এক চিলতে মেঘ নেই কোথাও
নীল আকাশটাকে বড় বিষন্ন মনে হলো
সাত
চঞ্চলা মেয়েটি নিশ্চুপ হয়ে গেলো।
কৈশোরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মেয়েটি অনুভব করলো, তার ভাবনার সমস্ত রাজ্য জুড়ে ছেলেটির মুহুর্মুহু বিচরণ। পড়ার টেবিল থেকে বারান্দার পূর্ব পার্শ্বে এসে দাঁড়ায় মেয়েটি।
এখানে বদ্ধ শীতল হাওয়া। সকালের মিষ্টি নরম রোদে আগের মত গা গরম হয়ে উঠে না। পূর্ব পার্শ্বের ট্যাংকিটি ছেলেটির জানালাটিকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে। ওপার্শ্বে ঘন ঝাউ শাখার গাদাগাদি।
ঝাউয়ের পাতায় মেয়েটির করুন দৃষ্টি মিনতি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বারান্দার পশ্চিম পার্শ্বে স্থাপন
করা
হার্ডবোর্ডের বেড়াটি নিষ্ঠূর
পাহারাদারের মতো পাষান হয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির ইচ্ছে হলো বেড়াটিকে ও পার্শ্বে সরিয়ে দেয়!
আহা, যাদুবিদ্যা জানত যদি মেয়েটি ! তা হলে বাতাসে তুলো তুলো করে উড়িয়ে দিত সে বেড়াটিকে। বেড়াটির স্থানে রেলিং ধরে ঘাড় কাত করে দাঁড়াতো সে! ওপার্শ্বের জানালা থেকে হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়াতো ছেলেটি!
ছেলেটির উজ্জ্বল চোখ দুটো মুগ্ধ হয়ে দেখতো মেয়েটিকে। মেয়েটিও দেখতো ছেলেটিকে।
অপলক ডাগর ডাগর চোখ দু’টি দিয়ে। দু’জোড়া চোখে আনন্দের ফোয়ারা বইতো! চোখের ভ্রমর দুটি কেঁপে উঠতো! বুকে শিহরণ বইতো
!
কচি বুকে নিঃশব্দ ঝড়ের শব্দ শুনলো মেয়েটি। বুক চেপে ধরে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলো সে। খাতার শূন্য পাতায়
হাতের কলম দিয়ে ছেলেটির অজানা নামের আঁকি-বুকি আঁকলো । এক সময়ে টেবিলে মাথা রেখে ছেলেটিকে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরলো মেয়েটি ।
বোর্ডের বেড়াটি বারান্দার পশ্চিম পার্শ্বে স্থাপন
করা, যেখানে দাঁড়িয়ে মেয়েটি ছেলেটির জানালা দেখতে পেত!
বাদামী রঙের উঁচু বেড়া । ছেলেটি ও মেয়েটির মাঝখানে পাষান দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে। প্রভাতের মিষ্টি মিষ্টি রোদ একটু একটু করে উজ্জ্বল হয়ে বারান্দার পূর্ব পার্শ্বের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে।
তা
দেখলো না মেয়েটি। ছেলেটিকে নিয়ে সে এখন অন্য এক জগতে। স্বপ্নের জগৎ। বিস্তৃত। ব্যাপ্ত। মেয়েটির সাড়া হৃদয় জুড়ে!
আট
বারান্দায় রেলিং। বেড়ার ওপার্শ্বে নিচের থেকে উপরে ওঠার সিঁড়ি। বাড়তি বাসনকোষণ রাখার চৌকিটি বেড়া ও সিড়ির মাঝখানে আগের মত স্থাপন করা গেলো না। অসুবিধায় পড়লো গৃহকর্ত্রী, সাদা শাড়ি লাল ব্লাউজের মহিলাটি।
গৃহকর্তার পরামর্শে তাই বেড়াটিকে পূর্বস্থানে স্থাপন করলো।
সিঁড়ির ওপার্শ্বে বারান্দাটুকু আবার মুক্ত হলো।
মেয়েটির বারান্দায় প্রভাতের নরম রোদ আবারো মিষ্টি হয়ে ফিরে এলো।
আগে পিছে তাকিয়ে চুপি চুপি রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো মেয়েটি।
ও দালানের বন্ধ জানালার নীল রংটুকু মেয়েটির দু’চোখে অশ্রুর বাষ্প জড়ালো। খোলা জানালা দেখার মানষে অধীর আগ্রহে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো
মেয়েটি । ছেলেটির বন্ধ জানালায় গাঢ় নীল রঙের পালিশ। ওপারে ঘন ঝাউয়ের সারি।
সবুজ ঝাউয়ের পাতারা দুলে দুলে হেসে হেসে মেয়েটিকে উপহাস করছে যেনো! ভারী শীতল নিঃশ্বাস ফেললো মেয়েটি। অতঃপর ক্লান্ত পদে বারান্দা থেকে প্রস্থান
করলো।
নয়
না পাওয়ার ব্যথা নিয়ে প্রতিদিনের মতো ছেলেটি তার জানালা খুললো।
ঝাউয়ের ডালে বসা কবুতরগুলোকে বড় বিষন্ন মনে হলো।
কবুতর দু’টির নিচ দিয়ে মেয়েটির বারান্দায় অলস দৃষ্টি ফেললো ছেলেটি।
আচমকা ছেলেটির ভেতর একটা প্রানচাঞ্চল্য ফুটে উঠলো।
চোখ
দু’টো কচলিয়ে পরিষ্কার করলো সে। তীক্ষ্ণভাবে মেয়েটির বারান্দায় দৃষ্টি
বুলানো। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হার্ডবোর্ডের বেড়াটি আর নেই!
আনন্দে উচ্ছল চোখ দু’টি বড় চঞ্চল হয়ে উঠলো তার। হারানো মানিক খুঁজে পাবার আনন্দে পাগল হয়ে উঠল সে। সুখের কাঁপন বয়ে চলল তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত।
মেয়েটির আগমনের প্রত্যাশায় উদগ্রীব হয়ে রইলো ছেলেটি। দূরবীনের মত চোখ দুটিকে এপাশ ওপাশ করলো সে ।
অবশেষে দৃষ্টির আলোয় মেয়েটি এসে থমকে দাঁড়ালো।
অপলক নেত্রে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলো মেয়েটি
তৃষ্ণার্ত চোখ দু’টি তুলে ছেলেটিও তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে।
চার
চোখের মাঝখানে বয়ে চলা বাতাসের উপরে একটা অদৃশ্য সেতু তৈরি হলো । সে সেতুর উপর দিয়ে ওদের দু’টি সবুজ মন মিলিত হয়ে এক হয়ে একাকার হয়ে গেলো।
আনন্দে বিষন্ন ছেলেটি প্রসন্ন হলো
খুশিতে গম্ভীরা মেয়েটি চঞ্চলা হলো
হাত নেড়ে একে অন্যকে স্বাগত জানালো।
হারানো মানষীকে খুঁজে পাবার আনন্দে ছেলেটির অন্ধকার মুখে হাসির দীপ্ত প্রভার দ্যুতি ছড়ালো।
প্রফুল্ল চিত্তে মেয়েটির চোখে আনন্দ বাস্প জড়ালো। উপচে পড়া হাসিতে মেয়েটির বারান্দায় সর্বত্র পরিতৃপ্তির জোয়ার এলো।
অবিরত হাত নেড়ে নেড়ে ওরা স্বচ্ছ বাতাসে উল্লাস ছড়াতে লাগলো।
ঘন ঝাউয়ের চিকন শাখায় পায়রা পাইরীকে আদর দিচ্ছে।
পাইরী পায়রার আরো কাছে ঘেঁষে এসে সোহাগ নিচ্ছে। ওদের ভালোবাসার সবুজ রঙে ঝাউয়ের পাতায় সবুজ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ঝাউয়ের পাতারা উজ্জ্বলতর থেকে আরো উজ্জ্বলতর হচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই
50