বড় গল্প: নয়ন তারা
নয়ন তারা
মোটর
সাইকেলটি গাছের নিচে রেখে দিলো সোহেল। বেশ বড় গাছটি। সবুজ পাতাদের কালো ছায়া নিচের জমিনে গোল বৃত্ত তৈরী করে। গাছের তলায়।
অনেক স্থান জুড়ে। উপরে ঘন পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো কেঁপে কেঁপে জমিনে আছড়ে পড়ে। কাগজের অগণিত
টুকরোর মতো হয়ে।
বেলা এগারোটা
এখন। প্রখর
সূর্যের কিরণ। দুজন মানুষ সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছে। একজনের হাতে দু’আঙুলের
মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট। আরেকজনের হাতে একখানা আয়না। আয়নাখানা গোল। আয়নার
উল্টো পিঠে কোন এক অর্ধনগ্না যুবতীর ছবি। এরকমই একটি আয়না আছে সোহেলরও।
সোহেলের নিজের আয়নাতেও একটা ছবি আছে। প্রখ্যাত চিত্র নায়িকা নার্গিসের ছবি।
নার্গিসকে ভালো লাগে সোহেলের। গোল উজ্জ্বল ফর্সা মুখখানা।
মুখমন্ডলের উপর ডাগর ডাগর দুটি চোখ। চোখের মাঝখানটায় কপালে কালো তারার টিপ্। আয়নাতে নিজের ছবি দেখতে গিয়ে প্রায়ই
নার্গিসকে দেখে সে।
শিরিষ
গাছের অদূরেই কলেজের গেইট। শহরের স্থানীয় একটি কলেজ। এখানেই নীলা পড়ে। নীলার সাথে একটা দফা রফা করতেই এসেছে সে এ কলেজ
চত্বরে। কপালে যাই থাক, নীলার সাথে আজ কথা
বলবেই সোহেল। গেইটের অদূরে শিরিষ গাছের ছায়ায়
দাঁড়িয়ে নীলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে সোহেল। ওই
যে নীলা এগিয়ে আসছে এদিকে হেটে হেটে। আরো দুটি মেয়ের সাথে। কথা বলতে বলতে। কলেজের লাল তোরণওয়ালা গেইটের দিকে। হাসি হাসি মুখ করে। মাঝখানে নীলা। মেয়েগুলো আরো এগিয়ে আসছে।
তিনটি মেয়ে। বাকিরাও সোহেলের পরিচিত। রপ্তানি মেলায় দেখেছিলো ওদের সোহেল।
একটি যুবকের সাথে। লম্বা কুঁচকানো চুলওয়ালা যুবক।
কাল সন্ধে
রপ্তানি মেলার সেরিকালচার বোর্ডের স্টলে প্রথম দেখেছিলো সোহেল মেয়েটিকে। মেশিনে রেশম পোকার গুটি থেকে সুতা বের করে আর একটি মেশিনে কাপড় বুনা হচ্ছিল। পার্শ্বেই শেলফে সাজানো ছিলো রেশমি সুতায় বোনা হরেক রকম বিভিন্ন রঙের
ব্যবহার্য বস্ত্রাদি।
বেশ ভীড় স্টলটির সেই কোণে। সোহেল ঘাড় লম্বা করে সামনে ঝুঁকে মেশিনটি দেখার চেষ্টা করে।
ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির উপর।
মেয়েটি বিস্ফোরিত নেত্রে পিছন ফিরে তাকায়। কিছু
একটা বলার জন্য ঠোট কাঁপে মেয়েটির। ক্রোধ ও দ্বিধায় বলতে পারেনা কিছুই। শুধু দাঁড়িয়ে দু’চোখে ক্রোধের আগুন ঝরায়। অনুতপ্তের ভঙ্গিমায়
সোহেল বলে, ….
আই এম সরি ম্যাডাম! বললো সোহেল, অনুতপ্ত হয়ে।
আশেপাশের কতগুলো লোক মুখ টিপে হাসে। মেয়েটি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মেশিন দেখার হয়তো আর ইচ্ছে
রইলো না তার। সাথে তার আরো দুটো মেয়ে। সাথে থাকা যুবকটি তখনও মনোযোগ সহকারে মেশিনে সুতা পাকানো দেখছে। আশপাশ হতে দু’একটি প্রশ্নও হচ্ছে মেশিন চালককে। মেয়েটি অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকে ডাগর ডাগর
চোখ
দুটোকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে। ক্ষণিকে সোহেলের অবস্থান দেখছিলো মেয়েটি। স্টলটি হতে বের হওয়ার
চেষ্টা করছিলো যেনো মেয়েটি। সোহেলেরও আর সেই স্টল দেখার ইচ্ছে থাকলো
না যেনো। কিন্তু নিজে নিজে স্টলটি হতে বের হয়ে আসলে মেয়েটির কাছে ছোট হয়ে যাবে সোহেল।
তাই
দাঁড়িয়েই রইল সেখানে। মেয়েটির গা থেকে একটা দূরত্ব বজায় রেখে। মেশিনটি দেখার ব্যর্থ চেষ্টাও করলো কয়েকবার।
ওদের তখন মেশিন দেখা শেষ হয়েছে। সোহেলকে লক্ষ্য করে মেয়েটির কর্কশ কণ্ঠ
ভেসে এলো, …
এই যে পথ ছাড়েন!
…
পথ করে দেয় সোহেল।
ওরা এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
আরো স্টল দেখবে বলে।
সোহেল একপার্শ্বে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটির ব্যবহারে আঘাত পায় সোহেল। মন খারাপ হয়ে যায় তার। নিজেকে অতি হীন মনে হয় সে মুহূর্তে।
সোহেলের
প্রতি মেয়েটির এ উপেক্ষা মেনে নিতে পারেনা সোহেল। স্বাভাবিক ঘটনাকে মেয়েটি অস্বাভাবিকভাবেই নিলো। চোখ দিয়ে ঘৃণা ঠিকরে পড়ছিলো মেয়েটির। কণ্ঠে ছিলো প্রবল ঘৃণা মিশ্রিত ঝাঁঝালো তেজ!
মেয়েটি এগিয়ে যায় ত্রস্ত পদে। একসময়ে বেরিয়ে গেলো সেরিকালচার বোর্ডের
স্টল থেকে।
ভারাক্রান্ত মনে সোহেলও আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো।
মেলার
বৃত্তাকার স্টলগুলোর সম্মুখে পথের ওপার্শ্বে প্রশস্ত মাঠ। মাঠের বুকের উপর সবুজের আস্তরণ। জায়গায় জায়গায় ধাতব দণ্ডের মাথায় আলোর ঝাড়।
অনেক অনেক আলোর ঝাড় বাতি। মাঠের সর্বত্র, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মাঠটিকে আলোময় করে।
সবুজ
মাঠের উপর এখানে ওখানে আড্ডায়রত যুবক যুবতীর দল।
হাসি ঠাট্টায় মগ্ন সবাই । স্বতঃস্ফূর্ত
হয়ে ।
শহরের
এ মাঠটির নাম শনির মাঠ। শনির মাঠের এক পার্শ্বে এসে দাঁড়ালো সোহেল
।
মেয়েটির দল তখন বাংলাদেশ চা বোর্ডের স্টলে।
নিজেকে বড় অপমানিত মনে হলো সোহেলের। কোন অপরাধ করেছিল
সে?
বড়ো অপমানিত ও অসহায় মনে হলো তার সে ক্ষণটিতে। কেনই বা এমন হলো? জানেনা সে ।
চা বোর্ডের স্টলটির
প্রবেশপথের এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। যেনো কাউকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে। টিউব
লাইটের উজ্জ্বল আলো লেপ্টে যাচ্ছে মেয়েটির পুরো
মুখমণ্ডলে। মেয়েটির দু’টি ডাগর ডাগর চোখ। উজ্জ্বল ফর্সা অবয়ব। কপালের
মাঝখানে একটি সোনালী টিপ। একটু মিষ্টি হাসির রেশ যেনো ছড়িয়ে রয়েছে মেয়েটির রসালো অধরে। গোলাপি রঙের পেলব
গালে রুপালি বাতির চিকিমিকি। জ্বালাময়ী চোখ দু’টি আর নেই মেয়েটির।
চোখ
দুটো হাসছে - যেনো আকাশের পূর্ণ চাঁদের মতো করে। শান্ত দুটি চোখের উপরে পাতলা একজোড়া ভ্রু। শান্ত চাহনি, সৌম্য মূর্তি।
খুবই
ভালো লেগে যায় মেয়েটির চোখ দুটোকে সোহেলের। কালো চুল, মাথার দুপার্শ্বে দুটো ফুল। বেগুনি রঙের।
লালচে বেগুনি। গায়ে চকলেট রঙের কামিজ ও বুকের উপর একই রংয়ের ওড়না
জড়ানো।
মেয়েটিকে
খুব ভালো লেগে গেলো সোহেলের। কি থেকে কি হয়ে গেলো
যেনো। শরীরে কেমন যেনো কাঁপন অনুভব করলো সোহেল। বুকটা কাঁপতে থাকে সোহেলের। বুঝছেনা সে, কেন
এমন হচ্ছে তার। স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে সে।
ভার্সিটি পড়ুয়া দূরান্ত সোহেলের কি হলো আজ!
অদূরে মাঠের পার্শ্বে রং-বেরঙের
ঝাড়বাতি। লাল নীল হলদে ও সাদা রংয়ের বাতিগুলো। সোহেল যায় সেদিকে।
ছোট ছোট অসংখ্য পতঙ্গ উড়ছে বাতিগুলোর
উপর। বাতিগুলোর উপরে হালকা মেঘের মিথ্যা আবরণ সৃষ্টি করছে পতঙ্গগুলো।
ঝাড়বাতির স্ট্যান্ডের ও পার্শ্বে একটি নয়ন তারা ফুলের গাছ। গোল শাখাময়ী নয়ন তারা ফুলের গাছ। অনেকগুলো প্রস্ফুটিত ফুল গাছটিতে। নীল-বেগুনি রঙের
ফুল। মেয়েটির দুচোখের মতোই। গোল, উজ্জ্বল, মায়াময়ী।
মেলায়
মাইকে ভারতের বাংলা গান বাজছে। সামনের রাস্তা দিয়ে উৎফুল্ল দর্শকদের আনাগোনা। মাঠের পার্শ্বে পথের ওপারে বাংলাদেশ চা বোর্ডের স্টলটি। স্টলটির উত্তর নির্গমন গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে দর্শকরা। পুরুষের সংখ্যাই বেশি।
বেরিয়ে আসা দর্শকদের
সবার দিকে তাকায় সোহেল । লম্বা চুলওয়ালা যুবকটি বেরিয়ে এলো। মুখে উল্লসিত হাসি। তার পেছনে পেছনে মেয়েটিও বেরিয়ে এলো। মুখে
উল্লসিত হাসি। টোল পড়েছে মেয়েটির দ’গালের মধ্যখানে। মুক্তোর মতো মেয়েটির দাঁত। মুখে উচ্ছল হৃদয়-ছোঁয়া মিষ্টি হাসি। মেয়েটির হাসিতে প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পায় সোহেল। হাসির কাপুনিতে একসময়ে মেয়েটির বুকের ওড়না পড়ে যায়। ওড়নাটিকে
মাটি হতে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয় সে। এদিক সেদিক তাকায়। মাঠের
দিকে তাকাতেই সোহেলের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় তার। থমকে দাঁড়ায় মেয়েটি। অপসৃয়মান
হাসিটি মুহূর্তেই উবে যায় মেয়েটির। দুচোখে আবার আগুন জ্বলে উঠে। একরাশ বিতৃষ্ণা ঠিকরে
পড়ে রক্তিম অধরখানাতে। চোখ দিয়ে আগুন ঝরে। সোহেলের মুখের উপর হতে চোখ ফিরিয়ে দলের সাথে সামনে পা বাড়ায় মেয়েটি।
দুটো কালো লম্বা বেণী ঝুলছে মেয়েটির মাথা থেকে। পায়ে কালো রঙ্গের এক জোড়া স্যান্ডেল
সু জুতা। জুতার তলায় পেন্সিল হিল।
লম্বা দোয়ারা গোছের শরীর। ভারী নিতম্ব। ভালো লাগে সোহেলের তাকিয়ে দেখতে। মেয়েদের অতি কাছ থেকে দেখে
এতো
নেশা অনুভব করেনি সে এর আগে। এগিয়ে যায় সামনে আরো কতটুকু।
মেয়েটি ঢুকলো পিপলস সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের স্টলে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের পার্শ্বেই স্টলটি। অনুসরণ করে সোহেল মেয়েটিকে। আরো নিকট থেকে দেখবে সে তাকে।
বিভিন্ন ধরনের চিনেমাটির বাসনকোসন ও তেজষপত্রের
স্টল। মেয়েটি দেখছে একটার পর একটা। দু একটা পছন্দও করছে। দামও জেনে নিচ্ছে কোন কোনটার।
কাছ ঘেঁষে
দাঁড়ানোয় মেয়েটির কণ্ঠ স্পষ্টই শুনতে পায় সোহেল।
মেয়েটির কণ্ঠ বড়ই মিষ্টি। অগ্নি চাহনি নেই এখন
আর।
অধরে একরাশ হাসি। বড়ু অপূর্ব লাগছে মেয়েটিকে। মেয়েদের চেহারায় এত নিষ্পাপ ছাপ আর দেখেনি কখনো সোহেল। অতি কাছের একজন মনে হচ্ছে মেয়েটিকে।
শেলফে
রাখা তৈজসপত্র দেখতে দেখতে মেয়েটি এগিয়ে আসে সোহেলের
আরো কাছে অবচেতন মনে। ডানের শো’কেসটা এখনো দেখেনি সে। এ শো’কেসটার কাছেই সোহেল দাঁড়িয়ে। মেয়েটির
দৃষ্টি এড়াতে মেয়েটির মুখের উপর হতে একটু চোখ ঘুরিয়ে দাঁড়ায় সোহেল। মেয়েটির আরো একটু পেছনে সরে আসে সোহেল। একটি টি’পটের উপর চোখ রাখে
সে।
টি’পটটির উপর একগুচ্ছ ফুলের ছবি।
ডানের
শো’কেসটিতে রাখা সিরামিকসের সেটগুলো দেখতে দেখতে মেয়েটি সোহেলের প্রায় শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালো
যেনো। একসময়ে মেয়েটি সোহেলের একেবারে
সামনে এসে পড়ে। নিবিষ্ট মনে মেয়েটি শো’কেসের সাজানো জিনিসগুলো দেখতে
থাকে। সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে। একের পর। দৃষ্টি বুলায় নিচ হতে উপরে।
আনমনা
মেয়েটি একসময়ে সোহেলের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। প্রায় সোহেলের কাঁধ বরাবর। পাশ থেকেই দেখছে সোহেল মেয়েটিকে। সুউন্নত বুক মেয়েটির। এমন কাছ থেকে
মেয়েদের বুক কখনো দেখেনি সোহেল এর আগে। মেয়েটির উষ্ণ শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছে সোহেল। সুমিষ্ট
ঘ্রাণ মেয়েটির শরীরে। সোহেলের বুক কাঁপতে থাকে। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে সে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় পুনরায় টি’পটটির উপরে। চোখ বুলাতে থাকে টি’পটটির বুকে অঙ্কিত ফুল-গুচ্ছের ওপরে। সোহেলকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস
করে মেয়েটি, …
এ টি’পটটির
দাম
কত? …
উত্তর পেল না মেয়েটি
।
উত্তর পাবার আশায় পার্শ্বের সোহেলের প্রতি তাকালো মেয়েটি। তাকিয়েই ভুত দেখল যেনো সে। ভয়ে ত্রস্তে
দু’পা পিছিয়ে গেলো মেয়েটি।
ধাক্কা যেনো সোহেল। অনুতপ্তের
দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালো
সে । মেয়েটি বিতৃষ্ণ।
…… আই এম স্যরি ম্যাডাম!
….
বেরিয়ে এলো সোহেল স্টলটি থেকে।
সোহেল
অনুভব করে - মেয়েটির দু’টি অগ্নি-চোখের দৃষ্টি সোহেলের পিঠের উপরে ক্রমাগত আঘাত হানছে। স্টলের
বাইরে এসে মাঠের কোনায় দাঁড়ায় সোহেল। অগ্নি ঝরা চোখ দু’টি দিয়ে মেয়েটি ঘন ঘন তাকায় সোহেলের দিকে। অস্স্বস্তির ভাব তার চোখে মুখে।
সোহেল নির্বাক। বিহবল, পলকহীন। তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে।
এক সময়ে
মেয়েটির সম্ভিত ফিরে পায়। হতচকিত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। হয়তো তার সাথীদের খুঁজতে থাকে মেয়েটি। আরও একবার তাকায় সে সোহেলের দিকে
।
সোহেল তখনো তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। নির্লজ্জ বেহায়া দুটো চোখ দিয়ে। পলকহীন অবিরত।
ক্রোধে ও আক্রোশে
মুখ বাঁকালো মেয়েটি।
এক সময়ে
সোহেল দেখলো, মেয়েটি স্টলের ভেতরে চলে গেছে।
সোহেলের
মনের গহীনে অন্ধকারের একটি আবরণ পড়লো। সোহেলের মায়া হলো মেয়েটির জন্য। চোখ দুটি নিষ্প্রভ মনে হচ্ছিল ওর। মেয়েটিকে এমন অস্বস্থিকর
অবস্থায় ফেলার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার। চলে আসে সোহেল মাঠের পার্শ্ব থেকে।
নয়ন তারা গাছটি পেছনে রয়ে গেলো। ফুলগুলো হাসছিলো মিটিমিটি।
সামনে মাঠের মাঝখানে বিএডিসির স্টল।
সাজানো গোছানো চতুর্দিকে। কৃষিজাত বিভিন্ন প্রকার গাছ-গাছালি
দিয়ে। স্টলটিতে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপাদনের পদ্ধতি প্রদর্শন। প্রথমেই স্টলটির
প্রবেশ পথ। প্রবেশ পথের উভয় পার্শ্বে
টবে বিভিন্ন প্রকার
শাকসবজির সবুজের মেলা। স্যালারি, চাইনিজ ক্যাবেজ, পার্সলি, লেটুস, পেঁয়াজ, আরো নানারকম সবজির চাষ। বড় জাতের কতগুলো মরিচও ছিলো ক্যাপসিকাম এনাম জাতের। শীতকালীন সবজির একটিও বাদ পড়েনি স্টলটিতে। এক এক করে সবগুলোর নাম জেনে নিলো সোহেল। এক পার্শ্বে গম ও বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে।
মেয়েটি হয়তো তখন অন্য স্টলে। সোহেল এগিয়ে যায় স্টলের ভিতরে। সুন্দর করে বানানো সেলফে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত পণ্য। চাল থেকে তৈরি বিভিন্ন খাবার
দ্রব্যাদি এক পার্শ্বে। অন্য পার্শ্বে একটি সেলফে আনারস, কলা, কাঁঠাল এবং অন্যান্য কিছু মৌসুমী ও অমৌসুমী ফল। সেলফটিতে
রয়েছে সিম ও ডাল জাতীয় আরো কিছু শস্য। মাঝখানে গোল সেলফে রাখা বড় বড় কতকগুলো লাউ ও কুমড়া। ওজন লেখা রয়েছে ওগুলোতে। পার্শ্বে মুরগির খোপে কয়েক জাতের বড় বড় মুরগি। একটি মুরগি ডিমও পেড়েছে। পার্শ্বে ব্রুডারে কতগুলো মুরগির বাচ্চা খেলা করছে।
স্টল চত্বর পার হয়ে নির্গমন পথে পা বাড়ায় সোহেল। প্রবেশ পথের মতোই নির্গমন
পথটি সাজানো । নির্গমন পথের উভয় পাশ সাজানো বিভিন্ন প্রকার সবজির টব দিয়ে।
সোহেল অবাক হলো। নির্গমন পথের এক পার্শ্বে একটি বাঁধাকপির টবের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। তাকিয়ে আছে অদূরে বিএডিসির স্টল হতে চালিত পাওয়ার পাম্পের প্রতি। পাম্প থেকে দ্রুত বেগে বেরিয়ে আসা পানির অবিরত প্রস্রবণধারার প্রতি।
মেয়েটি অপলক হিন তাকিয়ে আছে পানির
প্রস্রবণ ধারার প্রতি। পাম্প থেকে বেরিয়ে আসা প্রবাহমান জলধারার প্রতি। মেয়েটির নয়ন যুগল স্থির। কি যেনো ভাবছে মেয়েটি।
সাথের যুবকটি ও মেয়ে
দুটো নেই। সোহেল দেখে মেয়েটিকে। গোপনে গোপনে। চুরি করে। চুরি করে এর আগে আর কোন মেয়েকে এমনভাবে দেখেনি সে। মেয়েটিকে অদ্ভুত সুন্দরী মনে হলো তার। ইচ্ছে হলো দাঁড়িয়ে থাকে এভাবে হাজার বছর ধরে। সোহেলের
মনে হলো এমন একটি মেয়েকে না ভালোবেসে পারা যায়না। হয়তো মেয়েটিকে ভালোবেসেও ফেলেছে সে। মনের অগোচরে। মনের কাছ থেকে প্রবল
আকর্ষণ অনুভব করে মেয়েটির জন্য। মেয়েটির মনের সাথে দোল খেতে চায় সোহেলের মন - একই বৃত্তে এসে।
মেয়েটি যেনো একটু নড়ে উঠলো। দৃষ্টি
ফিরিয়ে নেয় সোহেল একটি ব্রকলির টবের প্রতি।
আবার স্থির হয়ে দাঁড়ালো মেয়েটি। তাকিয়ে আছে পাম্পের জলের দিকে। নয়ন তারার মতো দুটি চোখ। দুটি সমুদ্র যেনো, সুগভীর।
সেই
গভীরে ডুব দেয় সোহেল। সাঁতার কাটে। জলকেলী করে, আর নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
এক সময়ে নড়ে ওঠে মেয়েটি
।
সম্ভিত ফিরে পায় সোহেল। চুরি করে দেখছিলো সে মেয়েটিকে। মেয়েটি বুঝতে পারলে বিতৃষ্ণ
হয়ে চলে যাবে এখান থেকে। আগুন বেরোবে ওর নয়নতারার মতো মায়াবী দুটো চোখ থেকে।
গোপনে
গোপনে মেয়েটিকে দেখার কারণে নিজেকে অপরাধী মনে হয় সোহেলের। পা বাড়ায় স্টলটির নির্গমন পথের দিকে। মেয়েটির পেছন দিয়ে বেরিয়ে আসে সে বিএডিসির স্টল থেকে। মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হওয়ার ভয়ে বুক কাঁপছিলো সোহেলের।
স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে সোহেল।
মেলার অন্য স্টলগুলো
দেখার ইচ্ছে রইল না আর সোহেলের। চলে যাবে ভাবলো
সে।
এগুলো মেলার গেইটের দিকে। গেইট পেরিয়ে আসতে আসতে এক সময়ে বুকের মাঝখানটাতে কিসের যেনো একটা ব্যথা অনুভব করে সোহেল।
মেয়েটি যেনো টানছে ওকে পেছন থেকে। প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে সে মেয়েটির জন্য। অনুভব করে মনের অজানা স্থানে। এ যেনো প্রিয়জনকে রেখে পালিয়ে আসার বেদনা। ভারী হয়ে আসে পা দুটি তার। মেয়েটিকে আবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
কি করবে ভেবে পেলো না সোহেল।
গেটের এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকে নিবিষ্ট মনে।
দূর থেকেই দেখবে সে মেয়েটিকে। মেয়েটিকে মনের অজান্তে ভালোবেসেই ফেলেছে যেনো সে।
এগুলো সে আবার বিএডিসির
স্টলটির দিকে।
সবুজের সমারোহ স্টলটিতে।
পানির পাম্পটি চলছে কিছুক্ষণ পূর্বের মতোই।
নির্গমন পথের পার্শ্বে মেয়েটি নেই।
হয়তো ভিতরে আছে। সোহেল ঢুকলো স্টলটির ভিতরে।
ভেতরেও
নেই
মেয়েটি।
সোহেল বেরুলো মেয়েটির খোঁজে।
ওর চোখ দুটো বড়ই তৃষ্ণার্ত।
সোহেল মেয়েটিকে এক স্টল থেকে অন্য স্টলে খুঁজতে থাকে। কোথাও পেলোনা সে মেয়েটিকে। অবশেষে
তৃষ্ণার্ত মন নিয়ে এগিয়ে আসে সোহেল মেলার গেইটের দিকে।
মনের চাপা আর্তনাদ শুনতে পায় সে মেয়েটির
বিরহে। মনের আহতস্থানে বেদনা অনুভব করে সে। প্রিয়তমাকে হারানোর বেদনা
যেনো। এক সময়ে বেরিয়ে আসে রপ্তানি মেলা থেকে।
কিন্তু একি! বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। তার সাথের অন্যরাও। মুখে স্মিত হাসি। গোলাপি লালের অধর খানায়
স্মিত হাসির ফোয়ারা বইছে যেনো। চোখ দুটোও হাসছে
যেনো নয়ন তারার মতো, মিষ্টি মিষ্টি
করে।
ওরা এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি পার্কিংয়ের দিকে। সোহেলও এগুলো ওদের পেছনে পেছনে।
পুলিশ ক্যাম্পের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সাথের যুবকটি। একটি কুপন এগিয়ে দেয় পুলিশের একজন লোকের প্রতি।
সোহেল বুঝে
নেয়, ওরা গাড়িতে করে এসেছে।
পুলিশের লোকটি ওদের রিলিজ দেবার অনুমতি দিলো। সোহেলও তার মোটরসাইকেলের কুপনটি এগিয়ে দেয় পুলিশের লোকটির প্রতি।
সোহেল
লক্ষ্য করে, অদূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। তাকিয়ে আছে সোহেলের দিকে। সোহেল
আঁর
চোখে তাকিয়ে দেখে - আগুন ঠিকরে পড়ছে যেনো মেয়েটির দু চোখ থেকে।
পুলিশ
ক্যাম্পের পাশ থেকে তার মোটরসাইকেল খানার জন্য চলে আসে সোহেল।
মেয়েটি এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলো। পেছনের সিটে বাম পার্শ্বে চেপে বসেছে মেয়েটি।
গাড়িখানা এগিয়ে গিয়ে চলতে
থাকে চওড়া রাস্তাটি ধরে। আরো বেড়ে যায় গাড়িটির
গতি।
সোহেলকেও
বাসায় ফিরতে হবে ওই রোড ধরে। এগিয়ে চলে সোহেল তার মোটরসাইকেলে করে গাড়িটির পেছনে পেছনে।
মেয়েটি পিছন ফিরে তাকালো
আর একবার । সোহেলের মোটরসাইকেলটার প্রতি মেয়েটির চোখ দুটো। দেখলো
সোহেলের উৎসুক্য চোখ দুটো।
চওড়া
রোডটি পেরিয়ে উত্তর দিকে মোড় ফিরলো গাড়িটি। মিরপুর রোড ধরেই যাচ্ছে গাড়িটি। সোহেলকেও যেতে হবে সে রাস্তা ধরে।
মেয়েটি পেছন ফিরে তাকালো আবার। মোটরসাইকেলের আলো পড়ে মেয়েটির চোখে। চোখ দুটোতে ঝলসানো আগুন দেখলো সোহেল।
কিন্তু, শ্যামলী গিয়েই পশ্চিম দিকে মোড় নিলো গাড়িটি একটি রোডের দিকে। সোহেলের বাড়িরও রোড সেটি। মেয়েটিকে এ রোডে আর কখনো দেখেনি
সোহেল।
পিছন ফিরে আবারো তাকালো
মেয়েটি। মোটরসাইকেলটিকে দেখে নড়ে উঠল যেনো আকস্মৎ। কি যেনো বলতে চাইলো পার্শ্বের মেয়েটিকে।
খানিকটা পথ যেতে গাড়িটির গতি কমে এলো। ঊনত্রিশ নম্বর বাড়িটির সামনে। দারোয়ান গেট খুলে দিলো।
মেয়েটি বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।
মেয়েটি শেষবারের মতো আর একবার তাকিয়ে ছিলো সোহেলের প্রতি। মেয়েটির চোখ দুটো দেখতে পায়নি
সোহেল এবার। উপহাসে ভিজা ছিলো হয়তো মেয়েটির
চোখ
দুটি।
সোহেলও ফিরে এলো তার বাড়ির দিকে মটর সাইকেল চালিয়ে। অত্যন্ত ধীরগতিতে - ভারাক্রান্ত মনে।
এরপর কেটে গেছে সে রাত। ঘুমোতে পারেনি সোহেল সে রাতে। রাত ধরে সে কল্পনার সাগরে ঘুরে বেড়িয়েছে তার রঙিন ভুবনে। তৈরী
করেছে ভিন্ন জগৎ সে ভুবনে। মুক্তভাবে বিচরণ করেছে সে তার মানসীকে নিয়ে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো। নিজে রাজা হয়েছে। রানী করেছে মেয়েটিকে। মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়েছে তাদের
বাসর ঘর। সে বাসরে আদর দিয়েছে তার নববধূকে। ভালোবাসার ফুল ফুটিয়েছে মেয়েটির
বুকে বুক রেখে।
সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গেছিলো সোহেলের। বেলা তখন নয় টা। মিলন
সাগরে ভাসতে ভাসতে কখন যে সোহেল ঘুমিয়ে পড়েছিল, তা সোহেল বলতে পারে না। ঘুম ভাঙলে দেখে, গনগনে সূর্য্যটা মাথার উপরে উঠে
গেছে।
স্নান
ও নাস্তা সেরে মোটরসাইকেল খানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সোহেল। মোটরসাইকেল খানা থামে ঊনত্রিশ নম্বর বাড়ির গেইটে। অপেক্ষা
করতে থাকে সোহেল মেয়েটির জন্য।
দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আশেপার্শ্বের বাড়িতে লোকদের কাছ থেকে ঊনত্রিশ নম্বর বাড়ির লোকদের সম্বন্ধে খোঁজখবর নেয় সোহেল। একটা পরিচয় পায় সে মেয়েটির।
মেয়েটির নাম নিলা। বাবার প্রথম সন্তান সে। স্থানীয় একটি কলেজের অনার্সের ছাত্রী সে। এ বাড়িতে এসেছে তারা কিছুদিন হলো। আগে থাকতো খুলনায়। একটি
বিদেশি ফার্মের ম্যানেজার ওর বাবা।
সোহেলের তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো মেয়েটিকে খুঁজতে
থাকে। মেয়েটি হয়তো বাড়িতে নেই। এক বুক জ্বালা নিয়ে সোহেল বাড়িতে ফিরে এলো সেদিন।
সেদিন গিয়ে রাত এলো। আজকের প্রভাত এলো। যুদ্ধ করেছে তার মনের সাথে।
বিবেকের সাথে। বাদি সেজেছে। বিবাদী হয়েছে। মন রাজ্যে আদালত গড়েছে। বিচারক হয়ে বিচার করেছে। কিছুতেই রায় পায়নি মেয়েটিকে ভুলে যাবার। একই ধাতু দিয়ে গড়া যেনো নীলা ও সোহেল। পৃথক করতে পারেনি সে নিলাকে তার অস্তিত্বের সত্তা থেকে। যতই ছাড়াতে চেয়েছে, ততই জড়িয়ে পড়েছে।
কিন্তু এর মীমাংসা কোথায়! একা এর মীমাংসা করতে পারেনি সে। তাই ছুটে এসেছে নীলার সম্মুখে এই রাস্তাটিতে নীলার
কলেজের ক্যাম্পাসে। জয়ী হবে সে, না হয় পরাজয়ের গ্লানি বয়ে নিয়ে চিরদিন ভালোবেসে যাবে নীলাকে।
শিরিষ গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে সোহেল। হলদে পাতা উড়ছে গাছটি থেকে। ঝরে ঝরে পড়ছে নিচে। ঘাসের উপরে।
গাছটি থেকে ঝরে ঝরে।
মেয়েগুলো এগুচ্ছে সামনের দিকে। সামনেই কলেজের প্রবেশ তোরণ।
নিচে আরো অনেক মেয়ে দাঁড়ানো। তোরণের
হলদে হরফের নীল জমিন। আকাশি নীল। পার্শ্বের দুটি মেয়েকে চিনে সোহেল। আর একজন ফর্সা। পায়ে ওদের ইনফরমাল
স্যান্ডেল। পরনে শাড়ি। মুখে হাসি। কথা বলছে ওরা পরস্পরে। স্নিগ্ধ মায়া-মাখা গাছের ছায়া।
ওপার্শ্বের গাছটিতে একটি পাখি
বসে। হলদে নীল পাখি। লম্বা পুচ্ছ। বিচরণ করছে পাখিটি এ ডাল থেকে ও ডালে। নিচ দিয়েই আসছিলো ওরা।
উপর
থেকে একটি পাকা পাতা ঝরে পড়ে নিচে। নীলা ধরে ফেলে পাতাটিকে। পার্শ্বের মেয়ে দুটো হাসে একসাথে।
ওরা আরও এগিয়ে এলো। একটু দূরেই শিরিষ গাছের ছায়া।
মেয়েগুলো দাঁড়িয়ে আছে সে ছায়াটিরই কেন্দ্রবিন্দুতে।
সোহেল কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নেয়। নীলারা আরো কাছে এসে যায়
।
শিরিষ গাছের ছায়ার কাছাকাছি। প্রায় আগেই কিছু কথা সাজিয়ে এসেছিলো সোহেল। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় যেনো। বুক কেঁপে ওঠে তার বারবার। এগিয়ে যাচ্ছে সোহেল সামনের
দিকে। মেয়েগুলোর দিকে। আজকে মেয়েটির সাথে কথা বলতেই হবে তাকে। কি যেনো কি অজানা কারণে বুক কাঁপছে
তার। কি বলবে সে ভেবে পায়না সোহেল। তবুও এগিয়ে চলে।
এবারে
মনে
সাহস সঞ্চয় করলো সে। কথাগুলোকে আর একবার গুছিয়ে নিলো সোহেল। কাশি দিয়ে কন্ঠটা পরিষ্কার করে নিলো সে।
কাশির শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালো মেয়েগুলো। নীলা দেখল সোহেলকে। বিস্মিত হলো। বিরক্তও হলো। সব কিছুরতো একটা সীমা থাকা উচিত ! পার্শ্বের মেয়েগুলোর দিকে
তাকালো নীলা। ভাসা ভাসা চোখ দুটি দিয়ে। …
শুনুন প্লিজ! ডাকলো সোহেল।
পার্শ্বের মেয়েগুলো তাকালো নীলার দিকে।
… আমার পরিচিত। তোমরা হাটো। … চোখ দুটোতে বিরক্তি ওর!
নীলা এগিয়ে আসে গাছটির নিচে। সোহেলের একেবারেই কাছে।
…
বেওকুপের মতো আচরণ করে কি পাচ্ছেন আপনারা, উত্তর দেবেন? …
আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে যেনো
নীলার চোখ দু’টো দিয়ে। রাগে কাঁপছে রক্তিম অধর দুটি।
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সোহেল। তবুও চোখ দু’টি নীলার মুখের প্রতি
তার। কিছু একটা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে উঠলো কয়েকবার যেনো।
… উত্তর দিচ্ছেন না কেন? গা কাঁপছে?
…. ‘না মানে… আপনার কোন ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার নেই। রপ্তানি মেলা থেকে বাড়ি ফেরার পর মানুষিক যন্ত্রণায় ভুগছিলাম আমি। অনেক চেষ্টা করেও মানুষিক যন্ত্রণা কাটাতে পারিনি। তাই চলে এলাম আপনাকে একটিবার দেখতে। শুধু দূর থেকে দেখবো। দূর থেকে দেখেই
আপনাকে ভালোবেসে যাবো। এটাই হবে আমার চরম পাওয়া। নীলা, আপনি
আমার নাইবা হলেন! মনের রাজ্যে তো সদা সর্বদাই আপনি থাকবেন। আমি আমার মনের নীলাকে নিয়েই বেঁচে থাকব।…‘ ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে ফেললো
সোহেল।
নীলার চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে আসে। ঠিকরে
বেরিয়ে আসা আগুন ওচোখে আর নেই। সেখানে এক শান্ত মরুদ্যান। শিরীষের নিচের স্নিগ্ধ হাওয়ায় নীলার
তপ্ত মন। অনেকক্ষণ নিঃচুপ থাকে নীলা। চোখ দুটো পিচ ঢালা কালো রাস্তার উপর….
‘ইয়ে মানে…’
ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল নীলার।
মুখখানা উপরে তুলে কোমল দৃষ্টি মেলে ধরে সোহেলের মুখের প্রতি। কোমল দৃষ্টি নিয়ে নীলার কন্ঠ করুন
হয়ে
বেজে ওঠে….
মাফ করবেন আমাকে। ও পিএইচডি করছে ক্যামব্রিজে। আমি দুঃখিত।
…
করুন দুটি চোখ নিয়ে সোহেলের দিকে তাকায়
নীলা। মলিন মায়াবী একখানা মুখ তার। সে মুখের উপরে সোহেলের তৃষ্ণার্ত দুটো চোখের করুন মিনতি।
সোহেলের
করুন দুটি চোখের কাছে হেরে যায় নীলা। দুমড়ে মুচড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায় নীলার মন। নীলা বুঝতে পারে - লোকটির নিখাদ
ভালোবাসের কাছে বশ্যতা শিকার করেছে সে। সহ্য করতে পারে না নীলা। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে মেয়ে
দুটির দিকে। শিরিষ গাছের ছায়া মাড়িয়ে
মাড়িয়ে।
সোহেলের চোখ দুটো নীলার গমন পথে লেপ্টে যেতে থাকে। কলেজ তোরণ পেরিয়ে।
দৃষ্টির গভীর হতে অন্ধকারের অন্তরালে। লাল লাল তোরণের আকাশ নীল জমিন ছাড়িয়ে।
শিরিষ গাছের ছায়ায় একটি পাখি কেঁদে উঠলো। এক ঝটকা দমকা বাতাস
এসে অনেকগুলো হলদে পাতা ঝরিয়ে দিলো। রাস্তার ধুলো উড়িয়ে উড়িয়ে।
সোহেল দাঁড়িয়ে একাকী রাস্তার পাশে। শিরীষের
ছায়াটি যেনো রপ্তানি মেলার মাঠ। সামনেই বিএডিসির স্টল। স্টলের সামনে রাস্তার পাশে নয়ন
তারা গাছটি।
সোহেল
দেখলো, মেলার মাঠের নয়নতারার গাছে দুটি ফুল ফুটে আছে। ফুলগুলো হাসছে মিটিমিটি। নীলার চোখ দুটোর মতো করে। নীল সমুদ্র, গভীর সমুদ্র।
চোখ দুটির গহীনে নীল সমুদ্র যেনো। সে সমুদ্রের গহীনে ডুবতে থাকে সোহেলের অস্তিত্ব,
ভালোবাসার রক্তাক্ত আভা। রক্তের আভা ছড়িয়ে যেতে থাকে নয়ন তারার পাপড়িগুলোয়। একাকার
হয়ে, সোহেলের মনের দেয়াল গড়িয়ে গড়িয়ে।
কোন মন্তব্য নেই
50