ছোট গল্প: একটি মহৎ সিদ্ধান্ত
একটি মহৎ সিদ্ধান্ত
এক
বছরখানেক আগে শীলার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। বিয়েতে শীলার মত ছিলো না। দু’দিন পরেই ছেলেটির দুবাইয়ের ফ্লাইট। শীলার বাবা তাই তড়িঘড়ি করেই সে বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পরেই জানা গেলো যে দুবাই যাওয়া ছিলো
ছেলেটির ভাঁওতাবাজি। সুতরাং, সেদিনই বিয়েটি ভেঙ্গে গেলো।
শীলার বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু তার কুমারীত্ব হারাতে হয়নি।
শীলা বাসার বাইরে
বের
হয় না বেশি একটা। আটটা ও দশটার সময়ে শীলার বাবা টেলিভিশনের খবর শোনেন।
বান্ধবী পরিবৃত্ত হয়ে সে সময়টাতেই সে কলোনির সামনের শুরু রাস্তাটিতে বেড়াতে বেরোয়।
রাস্তার এ পাশটাতে সারি সারি বাসা। একটার সাথে আর একটি সংযুক্ত। বিশটি বাসা নিয়ে একটি ব্লক। প্রতি ব্লকের পরে এক চিলতে মাঠ। কলোনির সামনের শুরু রাস্তার ওপাশে সুয়ারেজের নালা। নালার ওপাশে মেহগনির ঘন সারি। তার ও পাশে প্রশ্বস্থ রাজপথ। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টায় গাড়ি ঘোড়ায় ব্যাস্ত থাকে রাজপথটি। তবে রাজপথের এ পাশের মেহগনির ঘন সারির পর কলোনির এ রাস্তাটি অত্যন্ত নিরিবিলি। রাজপথে বৈদ্যুতিক বাতির উজ্জ্বল আলো থাকলেও মেহগনির ঘন সারি এ পাশের সরু রাস্তায় বেশি একটা
আসতে দেয়না। ফলে রাস্তাটিতে রাতের বেলায় আলো-ছায়ারা অবিরত খেলা করে। নিরিবিলি ও আলোছায়ার সংমিশ্রণে কলোনির সামনের এ সরু রাস্তাটিতে তাই সন্ধ্যার পরে এক মোহনীয়তার আবেশ তৈরী হয়।
বাবা আটটা ও দশটার খবর শুনতে বসলেই শীলা তার বান্ধবীদের নিয়ে কলোনির সরু রাস্তায় হাটতে বেরোয়। কখনো আটটায়, আবার কখনো দশটায়। শীলাই প্রথম বের হয়। শীলাদের এ পাশের দুটি বাসাতেই রত্না ও শেউলীদের বাসা। শীলাই ওদের ডেকে নেয়। প্রতিদিন আধা ঘন্টার জন্য ওরা কলোনির এ রাস্তাটিতে হাটে। কলোনির বাসাগুলোর জানালা হতে ঠিকরে আসা আলো কলোনির রাস্তাটিকে ঈষৎ আলোকিত করে। শীলারা এ আলোয় পাশাপাশি হাটে। হাটতে হাটতে ওরা সারাক্ষণই কথা বলে। একজন বলে, বাকিরা শোনে। আবার কখনো কখনো দুজনের কথা একসাথে শুরু হলে সাংঘর্ষিক শব্দের সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে একজন কথা থামিয়ে আর একজনকে বলার সুযোগ দেয়। তবে শীলা অতি মাত্রায় কম কথা বলে। শীলার এমনি অভ্যাস
যেনো। মিতভাষী শীলা ছোটকাল থেকেই কম কথা বলে।
কলোনির
ত্রিশ নম্বর বাসাটির দ্বিতল ফ্লোরটিতে আর্কিটেক্ট মাসুদ সাবলেট থাকে। সদ্য পাশ করার
পর এখনো সরকারি চাকুরী হয়নি
মাসুদের। একটি কন্সট্রাকশন
ফার্মের আর্কিটেক্ট সে। বড় কোম্পানির কাজও বেশি। অফিসে কাজ করে শেষ করতে পারে না। তাই বাসায় এসেও রাত দশটার পর কোম্পানির দালানের
নকশার কাজে বসে সে। শীলাদের প্রতিদিনকার রাস্তায় হাঁটার দৃশ্যটি মাসুদ উপভোগ করে। প্রায়
রাত দশটার সময়েই মাসুদ জানালা পথে শীলাকে দেখতে পায়। লম্বা স্লিম ফিগারের শীলা। লম্বাটে মুখমণ্ডলের সুদৃশ্য পেলবতায় মুখখানাতে হাসি হাসি রং লেগেই থাকে। সর্বক্ষনেই
শিলাদের হাঁটা পথের মাঝে। মাসুদ এ সময় দুটোতে শীলার আগমনের অপেক্ষা করতে থাকে।
শীলার একটা আজব শখ আছে। হাঁটতে বেরোনোর সময় একটি রাজহাঁসের বাচ্চাকে সাথে নিয়ে বেরোয়
সে।
হলদে তুলো-পেঁজা চঞ্চল রাজহাঁসের বাচ্চাটি। কিচ কিচ শব্দ করে শীলার পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকে। শীলার গতি শ্লথ হয়ে এলে রাজহাঁসের বাচ্চাটি শীলার পায়ের কাছে এসে ঠোকরাতে থাকে। আবার খাবার অন্বেষণের ফাঁকে শীলা খুব বেশি দূরে চলে গেলে রাজহাঁসের বাচ্চাটি কিচ কিচ শব্দ করে চেঁচাতে থাকে। হাঁসের বাচ্চাটির কিচ কিচ শব্দ শুনলে শীলা পেছন
ফিরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাঁসের ছানা তখন কচি দুটো পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে শীলার পায়ের কাছে দৌড়ে আসে। শীলা হাতের উপর তুলে নিয়ে হাঁসের বাচ্চাটিকে আদর দিতে থাকে।
ইদানিং
শীলার একটা ব্যাপার মাসুদের নজরে আসে। মাসুদের জানালা সোজা এলেই শীলা তার বান্ধবীদের আড়ালে চলে যায়। মাসুদের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করার এই প্রচেষ্টা যেনো। মাসুদ বুঝতে পারে, মাসুদের দৃষ্টির আড়াল হতেই শিলার এ প্রচেষ্টা। শীলার এ প্রবণতাটি মাসুদকে শীলার প্রতি আরো আবিষ্ট করে তোলে। মাসুদ বুঝতে পারে, শীলাদের বেড়ানোর সীমানা মাসুদের জানালাকে পরিধি করেই। জানালার সম্মুখে সরু রাস্তা ধরে কিছুদূর গিয়েই শীলারা আবার ফিরে আসে। বিপরীত দিক থেকেও তাই। মাসুদের জানালা হতে ঠিকরে
যাওয়া টিউবলাইটের উজ্জ্বল আলোতে শীলার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মাসুদের জানালা সোজা এলেই
সে ঔজ্জ্বল্যে একটা লজ্জা ছড়িয়ে পড়ে। হাস্যোজ্জ্বল লজ্জামাখা শীলার মুখখানাতে মাসুদ কি যেনো একটা খুঁজতে চেষ্টা করে। তার এ প্রচেষ্টার দীর্ঘ সূত্রিতায় শীলারা মাসুদের জানালার সীমানা অতিক্রম করে।
শীলার
প্রতি মাসুদের এ অস্বাভাবিক টান ও শীলাকে নিয়ে মাসুদের ভাবনা মাসুদের সমস্ত সময়টা ধরেই
চলতে থাকে। কি অফিসে, কি বাসায়, সব জায়গায়ই শীলা মাসুদের সমস্ত মনে বিরাজ করতে থাকে।
মাসুদ দালানের নকশা আঁকতে বসলেই মাসুদের টেবিলের মাঝখানটায় শীলা এসে বসে থাকে যেনো। মাসুদ কাজ করতে পারে না। মাসুদের কাজ এগোয় না। অফিসে সময়মতো কাজের আউটপুট দিতে হবে। না হয় চাকরি থাকবে না। অতএব, অবশেষে মাসুদ ভেবে চিন্তে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন। টেবিলে বসে দালানের নকশা আঁকা ফেলে রেখেই সে বিহিতের কিছু
একটা খুঁজে পেতে মাসুদ ভাবনার অতল তলে তলিয়ে যেতে থাকে।
দুই
মাসুদ একটু চাপা স্বভাবের মানুষ। মনন আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই। অনুভূতি আছে, কিন্তু প্রচেষ্টা নেই। ইচ্ছে আছে, কিন্তু সাহস নেই। মাসুদ ভাবে, শীলাও হয়তো এমনই স্বভাবের। শীলাদের হাঁটা-হাঁটির সময়কালে মাসুদ বুঝতে পারে,মাসুদের প্রতি শীলার প্রকাশ
না করা একটি টান রয়েছে। লজ্জা ও চাপা স্বভাবের কারণে সে - না মাসুদের দিকে ফিরে তাকায়, না মুখে কিছু বলতে পারে। তা নয়তো মাসুদের জানালা অতিক্রম করার সময় শীলার সারা মুখ লজ্জায় ছেয়ে যায় কেন? কেনই বা শীলা মাসুদের মুখের দিকে তাকাতে সাহস পায় না? মাসুদের ইচ্ছে হয়, শীলার পটল চেরা চোখে চোখ রেখে একটু কথা বলে। শীলার জড়তা মাসুদের সে ইচ্ছেটাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। মাসুদ বুঝতে পারে, শীলা কম সাহসের মেয়ে। ভালোবাসার নৌকায় পা রাখতে চায়, কিন্তু হাঁটু জল ভেঙ্গে নৌকায় চড়ার সাহস তার নেই। কথাটি ভেবেই মাসুদ আবার শুধরে নেয়। শীলা তো মাসুদের উদ্দেশ্যেই এ পথে নাও আসতে পারে। একজন অপরিচিত পর পুরুষের উপস্থিতি যেকোনো মেয়ের চলাতেই জড়তা আনে। চলার গতি ও জড়তার প্রকাশই যে আসক্তির প্যারামিটার - মাসুদ তাতে আশ্বস্ত হতে পারে না। সুতরাং সমস্ত ব্যাপারটাই মাসুদ ইস্তফা দিতে চায়। শীলার জানালা অতিক্রম করা, কিংবা মাসুদের টেবিলে বসে দালানের নকশা করা - এসবই যার যার জীবনের ধারা। দুটি ধারা যে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত, তা মাসুদ কোনভাবেই মেলাতে পারেনা। ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভেবেই মাসুদ তার কাজে পুনরায় মনোনিবেশ করে।
শীলা তার দলবল নিয়ে আবারো ফিরে আসে। মাসুদ লক্ষ্য করে শীলাদের দলের মধ্যে যেসব কথাবার্তা হয় তার সবই অন্য মেয়েরা বলে। শীলা মেয়েটি শুধু লাজুক নয়, স্বল্পভাষীও বটে। মৃদু গুঞ্জন করতে করতে শীলাদের দল আবারো মাসুদের জানালা অতিক্রম করতে থাকে। শীলা ছাড়া অন্য মেয়েরা মাসুদের দিকে তাকালো
একবার। আলাপরত মুমুখমন্ডলগুলোতে হাসি ছড়িয়ে শীলাদের দল আবার
মাসুদের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। শীলা কিন্তু একটিবারের জন্যও মাসুদের জানালায় তাকায়নি। কেবল প্রকাশ করেছে তার জড়তা। চলনে ও শরীরে। নিজের শরীরকে সম্পূর্ণ আড়াল করার প্রচেষ্টা শীলার ছিলো কিনা মাসুদ জানেনা। তবে শীলার সে প্রচেষ্টা থাকলেও সে সফল হতো না। কেননা অন্য মেয়েদের চাইতে সে অনেক লম্বাটে। তাই মাসুদ শুধু শীলার সংকোচ ও জড়তাকেই বারে বারে প্রত্যক্ষ করে।
ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জ্ঞান করে কাজে প্রবৃত্ত
হয় মাসুদ। শীলার
জড়তার ব্যাপারটি নিশ্চিত হলেও মাসুদ বারবার এর সম্ভাব্য কারণগুলোকে খুঁজতে থাকে। শীলার এই জড়তার কারণ নানাবিদ হতে পারে। এক, মাসুদের প্রতি শীলার দুর্বলতা। দুই, শীলার
বিবাহ ভেঙে যাওয়ার অপবাদে মাসুদের সামনে তার হীনমন্যতায় কাতর হয়ে থাকা। এ দুটি প্রেক্ষাপট ছাড়া মাসুদ শীলার জড়তা কে আর কোন ভাবেই ব্যাখ্যা করার অবকাশ পায়না। অন্য মেয়েরা যেখানে স্বাভাবিক থাকে, শীলার সেখানে জড়ো সড়ো হয়ে
থাকার আর কোন কারণ মাসুদ ভেবে পায় না। শীলার উপর দুর্বলতার চাইতে শীলার জড়তার কারণ অন্বেষণে মাসুদ অধিকতর তৎপর হয়ে ওঠে। দালানের নকশা আঁকা রেখে দিয়ে মাসুদ শীলাদের ফিরে আসার জন্য আবারো প্রতীক্ষা করতে থাকে।
শীলাদের দল আবারো মাসুদের জানালা
অতিক্রম করতে থাকলো। অন্য মেয়েরা মাসুদের দিকে তাকিয়ে এ ওর দিকে কথার সুড়সুড়ি দিয়ে হাসছে। মাসুদ কিন্তু শীলার দিকেই তাকিয়ে। শীলাদের দলের মেয়েগুলো শীলাকে লক্ষ্য করে কি যেনো বলে সমস্বরে হেসে উঠলো। শীলা সবাইকে ধমক দিয়ে এক টুকরো হাসলো মাত্র। মাসুদ
দেখলো, শীলার হাসিতে সমস্ত পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে উঠছে। শীলার মুখ থেকে মাসুদ তার দৃষ্টি সরালো না। এক দৃষ্টিতে শীলার মুখশ্রীকে প্রত্যক্ষ করতে থাকলো। একসময়ে শীলাদের দল মাসুদের জানালার আড়াল হয়ে গেলো। শীলার মায়াবী মুখবদনও অন্তর্হিত হলো। একসময়ে মাসুদ আশ্চর্য হয়ে দেখলো, শীলার রাজহাঁসের বাচ্চাটি মাসুদের জানালা সোজা এসে আর এগোচ্ছে না। রাজহাঁসের বাচ্চাটি
কিচ কিচ করে চিৎকার করতে করতে শীলার মনোযোগ আকর্ষণের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মাসুদ মুখখানা জানালার শিকের ভেতর গলিয়ে দিয়ে শীলার দূরত্ব অনুমান করতে চাইলো। মাসুদ দেখলো, শীলা দৌড়ে এসে রাজহাঁসের বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো এবং মাসুদের দিকে এক পলক তাকিয়ে হেঁসে
হেঁসে দৌড়ে পালালো। মুহূর্তে ঘটে যাওয়া মুহূর্তটি মাসুদের কাছে মধুময় মনে হলো। আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনাটি মাসুদের মনে পুলক ছড়িয়ে দিলো। এমনি আরো পুলক পাবার ইচ্ছেয় মাসুদ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে শীলাদের ফিরতি আগমনের জন্য আবারো প্রতিক্ষা করতে থাকলো। কিন্তু শীলাদের দল মাসুদের জানালার সামনে আর ফিরে এলো না।
তিন
শীলার দৌড়ে এসে হাঁসের বাচ্চাটিকে কোলে নেয়া এবং মাসুদের দিকে এক পলক তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে দিয়ে দৌড়ে পালানোর স্মৃতিটিকে মাসুদ তার মনের আঙিনায় নানা ভাবে নাড়াচাড়া করলো। দালানের নকশা বানানোর মতো শীলাকে নিয়েও মাসুদ তার জীবনের অনেক নকশা গড়লো। যতবারই শীলার স্মৃতিকে স্মরণ করছিলো, ততবারই মাসুদ তার অনুভূতিতে ভালো লাগার পুলক অনুভব করলো। আজ টেবিলে বসে মাসুদের মনে হলো - ঘড়ির আটটার কাটা খুব কম গতি নিয়ে ঘুরছে। বুকের টিপ-টিপানি ও উৎকণ্ঠা নিয়ে মাসুদ জানালার কাছ ঘেঁষে বসলো। মাসুদের
মনের কোন এক অজানা স্থান থেকে উঠে আসা একটা উৎকণ্ঠা মাসুদের মনে উঁকি দিতে থাকলো। শীলা আসবে তো? অবশেষে শীলাদের দল এলো।
শীলাদের দল নানা রকম গুঞ্জন তুলতে তুলতে মাসুদের জানালা বরাবর এগিয়ে আসছে। মাসুদ তন্ময় হয়ে শীলার কমনীয় মুখমণ্ডলের প্রতি তাকিয়ে থাকলো। অতি আশ্চর্য হয়ে মাসুদ আজ লক্ষ করলো যে শীলা আজকে নিজেকে আর লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা করছে না। মাসুদের জানালা বরাবর এসে শীলা মাসুদের প্রতি এক পলক তাকালো এবং মিষ্টি করে একটু হাসলো। মাসুদ দেখলো, সে হাসির সাথে সাথে কেমন যেনো স্বাভাবিকতা হারাচ্ছিল শীলা। শীলার চোখে মুখে একটা লজ্জার সঞ্চালন মাসুদ অনুভব করলো। মাসুদ আরো অনুভব করলো যে শীলারা যখন তার জানালা অতিক্রম করছিলো, তখন মাসুদের সারা দেহে কেমন যেনো একটা অচেনা চঞ্চলতা ছড়িয়ে যেতে থাকলো। কি এক অজানা
কারণে মাসুদের সারা শরীর কাঁপতে থাকলো। কম্পিত চোখে মাসুদ শীলাদের গমন পথের দিকে চেয়ে থাকলো। শীলার হাসের বাচ্চাটি শব্দ করতে করতে শীলাদের গমন পথের অনুসরণ করতে থাকলো। মাসুদের ইচ্ছে হলো, দৌড়ে গিয়ে অথবা মন্ত্র পড়ে হাঁসের বাচ্চাটির গতি থামিয়ে দেয়। তাহলে শীলা দৌড়ে এসে তার হাঁসের বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আদর করতো, আর একটুক্ষণের জন্য হলেও শীলা মাসুদের দিকে এক পলক তাকাতো ।
মাসুদ স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো এবং ভাবলো, এ ঘটনাপঞ্জীর শেষ কোথায়? প্রতিদিন শীলারা আসে, আর শীলাকে এক নজর দেখার জন্য মাসুদ তার জানালার কাছে এসে পাগল হয়ে বসে থাকে। দালানের নকশা আঁকতে আঁকতে মাসুদ শীলার কথা ভাবতে থাকে। দালানের নকশা আঁকা আর শেষ হয় না। মাসুদের তৈরি দালানের নকশার প্রতিটি প্রকোষ্ঠে মাসুদ শীলার দীপ্ত মুখমন্ডলটুকুকে দেখতে পায়। মাসুদের সব ভাবনাগুলো গুলিয়ে যেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে মাসুদ বুঝতে পারে যে এ নাটকের শেষ হওয়া দরকার।
আগে ও পরের সমস্ত ঘটনাগুলোকে জোড়া দিয়ে ব্যাখ্যা করতে করতে মাসুদ আশ্বস্ত হতে পারলো যে মাসুদের প্রতি শীলারও প্রবল আকর্ষণ রয়েছে। আর মাসুদ নিজের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করে মেনে নিতে বাধ্য হলো যে সে শীলাকে সম্পূর্ণ ভালোবেসে ফেলেছে
সে।
শীলাও যে সারাদিন ধরে শুধু মাসুদের কথাই চিন্তা করে, সেটাও মাসুদ অনুমান করে নিলো। আর মাসুদের সমস্ত মুহূর্তগুলো যে শীলার পরশে মধুময়
হয়ে উঠে, মাসুদ তা অনুভব করে নিলো। আর, তাই মাসুদ সিদ্ধান্ত নিলো যে এভাবে চলতে থাকলে তা কেয়ামত পর্যন্তই চলবে। এর অবসান হওয়া দরকার। শীলা মাসুদকে ভালোবাসে। মাসুদও শীলাকে ভালোবাসে। ওরা একে অন্যের। শীলার মাঝে যেমন মাসুদের ভাবনা, মাসুদের মাঝেও তেমনি শীলার অস্তিত্ব! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে শীলাকে মাসুদের খুব আপন মনে হলো মাসুদের।
সারাদিনের বাকি সময়ে শীলার অনুপস্থিতি কল্পনা করে মাসুদ শীলার জন্য প্রচন্ড মায়া অনুভব করতে থাকলো। আজ সন্ধে আটটার পরে জানালার কাছে বসে মাসুদ আবারো শীলাদের কথাবার্তার গুঞ্জনের শব্দ শুনতে পেলো। শীলারা ধীরে ধীরে মাসুদের জানালার নিকটবর্তী হতে থাকলো। মাসুদ চিন্তা করলো, কিছু একটা করা দরকার। এ বিরহ বেদনার সমাপ্তি দরকার। শীলাদের দল মাসুদের জানালা বরাবর এসে গেলো। মাসুদ উঠে দাঁড়ালো। ওপরের জানালা হতে শীলার উদ্দেশ্যেকিছু একটা বলতে চেয়েও মাসুদ ব্যর্থ হলো। মাসুদ দেখলো, শীলা তার জানালা ঘেঁষে যেতে যেতে মাসুদের দিকে বারে বারে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। মাসুদ আবারও ভাবলো, কিছু একটা করা দরকার। সময় যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ বিরম্বনা আর কত? আকস্মৎ কেন যেনো মাসুদ অনুভব করলো, শীলা তো তারই। শীলা তো এমন করে পুরো একটি দিনের জন্য হারিয়ে যেতে পারে না! কিছু একটা করা দরকার। সময় যে শেষ হয়ে যাচ্ছে!
মাসুদ আর অতিরিক্ত কোন কিছু ভাববার অবকাশ পেলো না। দরজা খুলে রাজহাঁসের বাচ্চার পেছনে পেছনে শীলাকে অনুসরণ করতে থাকলো।
কোন মন্তব্য নেই
50