উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব পাঁচ - সুপ্রিয়া
পড়ুন উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব পাঁচ - সুপ্রিয়া (ছবিটির নিচে)
নিবেদন: উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট
আশির দশকের প্রথম ভাগ। তখনও মোবাইল ফোন আসেনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিফোনও ছিল না। তখন চিঠির মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতো সবাই। আর গ্রাম-গঞ্জে ও পাহাড়ি অঞ্চলে বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল না। এরকম সময়-পরিবেশে যাপিত জীবনের কল্পকাহিনি নিয়ে গড়া এ উপন্যাসটি। আশির দশকের সময়-পরিবেশ অনুধাবন করে উপন্যাসটির সকল পর্ব পড়তে থাকলে নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে। এটি পঞ্চম পর্ব । প্রথম পর্ব থেকে পড়ার অনুরোধ রইলো। প্রথম পর্বের লিংকটি এখানে দিয়ে দেয়া হলো https://bengali.pratilipi.com/series/supriya-priyatma-porbo-ek-anuprabesh-by-iqbal-jafu-abmqnd4trcwo
উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা
পর্ব পাঁচ - সুপ্রিয়া
সেদিন শনিবার। অফিস আওয়ার শেষ হয়ে এসেছে। মিলি এসে বললো, …. পলাশ ভাই আগামীকাল নদীর ওপারে বেড়াতে যাবো। ওপারে ফরেস্ট্রির বন দেখবো। … আমি বললাম,…. ঠিক আছে, এসো।….
তারও আগে একদিন মিলি এসে বললো,- স্যার দেখেছেন বাগানে কত সুন্দর ফুল ফুটেছে?.... ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে আমাকে দুটো গোলাপ ফুল দিলো। লাল রক্ত গোলাপ। ফুল দুটি হাতে নিয়ে নাকের কাছে নিয়ে বললাম….. মিস মিলি, আমাকে আপনি স্যার না ডেকে পলাশ ভাই ডাকবেন। স্যার স্যার আর ভালো লাগেনা।….
মিলি আনন্দে ঠোঁটে ঢেউ তুলে বললো ….
তাহলে আপনি আর আমাকে মিস মিস বলে ডাকতে পারবেন না। আর আমাকে তুমিই বলতে হবে।…
….কিন্তু আর একটা ব্যাপার তো ভাবতে হবে। অফিসের স্টাফদের সামনে হঠাৎ করে এমন পরিবর্তন ! কেউ কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে। … ও একটু লজ্জা পেলো যেনো। ওর লজ্জা ভাঙিয়ে বললাম,---- ঠিক আছে অফিসে কারো সামনে না হয় আগের মতোই থাকবো। কেউ না থাকলে আমি তোমাকে তুমিই বলবো।….
মিলির মুখখানা আনন্দে ভরে উঠলো। জোৎস্না-স্নাত যেনো। ওর মুখ দেখে মনে হলো,- আনন্দে ও এত উদ্বেল হয়ে পড়েছিল যে, আমাকে একটা ধন্যবাদ দেবার শক্তিটুকুও যেনো হারিয়ে ফেলল। অনেকক্ষণ বসে বসে কি যেনো ভাবলো। পরে বিনয় কন্ঠে বললো……
পলাশ ভাই, চলুন না একদিন আমাদের বাড়িতে? বাবা বড় খুশি হবেন।
আরে এ ব্যাপারে ভেবো না। তোমাদের দেশে চাকরি করি। তোমাদের বাড়ি যাবো না তো কাদের বাড়ি যাবো! আর এখানে তোমরা ছাড়া আমার আর কেইবা আছে?...
ওর মুখে আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো যেনো। তড়িৎ হেসে বললো,…
তাহলে চলুন না আগামী রবিবার?
আরে এত ব্যস্ত হবার কি আছে ! লেট দা টাইম এন্ড ফ্যাসিলিটিজ কাম !
কেন? আপনি তো রোববারে একা একা বাংলায় পড়ে থাকেন। সময় হবে না কেন? ফ্যাসিলিটিসের কথা বলছেন? তাতো শার্টটা গায়ে দিয়ে মোটরসাইকেলে উঠলেই হলো। - জিজ্ঞাসু দুটি চোখ নিয়ে তাকালো ও।….
ও ভালো কথা পলাশ ভাই। আমার ছোট বোন, রুবি। আগে ঢাকাতে পড়তো। এখন এখানেই পড়ে। ও একবার আমাদের ফার্ম দেখতে আসতে চায়।
ওয়েলকাম! তোমার সাথেই নিয়ে এসো?
কিন্তু অফিস টাইমে?
কেন? এনি ট্রাবল?
ট্রাবলই তো ! অফিসের কাজ ফেলে ওকে নিয়ে ঘোরাফেরা...
তাহলে রোববারেই নিয়ে আসো। আমিসহ ঘুরে-ফিরে দেখাতে পারবো।….. ও যেনো তাই চাইছিলো। আনন্দে গদগদ কন্ঠে বললো, ….
ঠিক আছে। তাই হবে স্যার।
…..আহা আবার স্যার?...ও হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো
….ও! আই এম স্যরি। বাই বাই!
বাই!....
সেদিন থেকেই আমাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে গেলো। আমি ওকে মিলি ডাকতাম। আর ও আমাকে পলাশ ভাই। তবে তা অবশ্যই আর সবার অনুপস্থিতিতে।
রোববারে মিলি ও রুবি এলো। মাহবুবকে আগেই বলে রেখেছিলাম। ও ওদেরকে উপরে নিয়ে এলো। আমি সোফায় বসে সাপ্তাহিক ‘পূর্বদেশ’ পড়ছিলাম। মিলির পেছনে পেছনে রুবি এসে ঢুকলো। আমার দিকে তাকিয়েই অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়লো …..
আরে আপু এটা তোর বস? ভারী শয়তান! …. মিলি আশ্চর্য হয়ে ঘৃণায় চোখদুটি উপরে তুললো…….
কি সব যা-তা বলছিস? অসভ্য কোথাকার। ছি ছি! তোকে কেন আনলাম এখানে?....... আমার দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছিল না যেনো মিলি। নিচের দিকে তাকিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বললো,…..
আমি দুঃখিত স্যার। আমাকে ক্ষমা করবেন।….
রুবি কিন্তু মোটেই বদলালো না। হাসিতে লুটিয়ে পড়লো। বুকের ওড়না খসে মেঝেতে পড়ে গেলো। ওটা তুলে বুকের উপর জড়িয়ে বললো,….
জানিস আপা? দুমাস আড়াই মাস আগে। আমি একদিন স্কুলে আসছিলাম? ঐযে স্কুলের পশ্চিম পাশে রাস্তার দক্ষিণ ধারে একটা ঝোকরা মেহগনি গাছ আছে না? উনি হোন্ডায় চড়ে ওখানে এসে এমন জোরে হর্ন বাজালেন যে- আমি পেছন ফিরে অল্পের জন্য উনার হোন্ডার উপরে পড়লাম না ! উনি দারুন অসভ্য!....
কথাগুলো বলে হেসেই চললো রুবি। থামছে না যেনো। মিলি কি বলবে ভেবে না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাতের নখ খুঁটতে লাগলো। রুবির কথাতে আমি মনে কিছুই নেই নি - এরূপ ভাব দেখিয়ে বললাম,…..
আরে তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো !
না আমরা যাই। এই দুষ্টটাকে বাড়িতে নিয়ে এমন শিক্ষাটাই দেবো না !
আরে ! ওকে শিক্ষা দেবে কি ! ঘটনা তো সত্যি। ওতো সেদিন রাস্তা জুড়ে হাটছিলো ….
রুবি চোখদুটো বড় করে আশ্চর্য হয়ে বললো, - এই যে সাহেব ! মিথ্যে বলবেন না কিন্তু। আমি রাস্তার ডান ধার ধরে হাঁটছিলাম………..
আমি হাসলাম। রুবিও হেসে দিলো। মিলির দিকে তাকিয়ে বললাম,…..
আরে তুমি বসো না ! আমি মনে কিছু নেই নি ! আসলে ও আদতেই দুষ্টু !....
মিলি আমার বিপরীত সোফায় বসলো। রবি দাঁড়িয়ে মুখখানা কে ফুচকা বানিয়ে বললো,…. আর আমাকে বুঝি বসতে দেবেন না! ঠিক আছে আমি যাই…
ও যেতে উদ্যোগী হলো। আমি উঠে গিয়ে ওর হাত ধরে বললাম,- না ভাই, তুমি আসো। আমার পাশেই বসবে।
আমার পাশে বসেই ও বললো, ….
এহ ! মুখে বললেই চলে গেলাম আর কি ! আমার বোনকে একা ওনার এখানে রেখে চলে যাবো, - আর কথা পেলেন না উনি !...
দুষ্টু হাসি মুখে টেনে মিলি বললো,….
কি যে অসভ্য একটা ! লজ্জা বলতে যদি কিছু একটা থাকতো ওর !...
….. দেতো আপু, বাক্সটা দে।… টেবিলের উপরে রাখা একটা বাক্স খুলতে খুলতে রুবি আমার পেটের দিকে তাকিয়ে বললো, … বাপরে বাপ ! কত বড় পেট ! ওনার এ পেট ভরাবো কি দিয়ে আপু ! এই মিষ্টিটা তো হবে না। উনিতো মনে হয় গরুর মত খেতে পারবেন !....
মিলি ও আমি একসাথে হেসে দিলাম। আমি বললাম,
…. আরে ! আবার এ সমস্ত কি এনেছো ! আমি তো তোমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করেই রেখেছিলাম !...
রুবি স্বর টেনে টেনে বললো,-
…. আরে সাহেব, ভয় পাবেন না। দোকান থেকে আনিনি । এগুলো আপু নিজে বানিয়েছে। বুঝেছেন? নিজে বানিয়েছে আপনার জন্য !
ও তাই নাকি?
মিলির মুখ লজ্জায় ছেয়ে গেলো। রুবি বাক্স থেকে একটা মিষ্টি তুলে এনে আমার মুখের সামনে ধরলো।…. দেখি, হা করুন তো !
আহ ! করছো কি তুমি ! আমি নিজেই তো খেতে পারবো। তুমি খাওনা আগে?
আরে এত বেশি কথা বলেন কেন সাহেব ! তাড়াতাড়ি হা করেন…
আমি হা করলাম। ও মিষ্টিটা আমার মুখে পুরে দিয়ে বললো…..
এই নিন। আজ থেকে আমি আপনার ছোট বোন হয়ে গেলাম। আর আপনি আমার দাদু ভাই হয়ে গেলেন !
তাহলে তো তোমাকেও আমার খাইয়ে দিতে হয় !
ওরে বাপ ! আমি আপনার সামনে হা করতে পারবো না। আমার লজ্জা করে।
আর আমার বুঝি লজ্জা ছিল না?...
……কি হয়েছে খা-না একটা ! এত লজ্জা কিসের?... মিলি বললো।
রুবিকে একটা মিষ্টি খাইয়ে দিলাম। মিলি বললো,…..
জানেন পলাশ ভাই? বাড়িতে ওকে যখন বললাম,…. কিরে তুই খা-না দু'চারটে? ও কি বললো জানেন?
কি বললো?
বললো,- এখন নয়। ওখানে গিয়ে ওনার সাথে একই প্লেটে বসে খাবো। বরঞ্চ তুই চার-টে খেয়ে নে। ওখানে গিয়ে তো আমাদের জন্য ভাগ পাবিনা।
তাই নাকি?...
রুবি বললো, তবে কি ! একটা প্লেট দিন । আপু, তুই কি আমাদের সাথে খাবি? না একা খাবি?
তোরা প্লেটে খা। আমি বরঞ্চ বাক্সো থেকেই খাবো।
আরে এই যে বসে আছেন কেন? একটা প্লেট দেন। আর তিনটি চামচ নেন।….. রুবি ধমকের স্বরে আমাকে বললো।
আমি উঠতে যাচ্ছি এমন সময়ে মাহবুব ট্রেতে করে কিছু লিচু, আনারস, গরম সিঙ্গারা ও ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এলো। ট্রেটা তার হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রাখলো মিলি। মাহবুবকে বললো, …
চাচা, দুটো পিরিচ আর তিনটে চামচ নিয়ে আসো তো?... মাহবুবকে দেখে রুবি বললো,….
এটা কে রে আপু? একেবারে রসূল ভাইয়ের মতো দেখতে। তাই না?..
কোন রসুল ভাই?
তোর মনে নাই? ওই যে আমাদের মুরগি চুরি করেছিল?
একটা থাপ্পর মারবো। এত বড় হয়েছিস এখনো বুদ্ধি শুদ্ধি হয়নি?....
মাহবুব লজ্জায় মুখ লাল করে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি বললাম,…. মাহবুব, তুমি কিছু মনে করো না। ও ছোট মানুষ।….
মাহবুব চলে গেলে রুবি বললো,…
আমার এমন করে বলা উচিত হয়নি। নারে আপু?
এ বুদ্ধিটা মাথায় এখন এলো?...
রুবি তার ব্যবহারের জন্য সত্যি সত্যি লজ্জিত হলো।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মিলি কাপে চা ঢাললো। রুবি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে থু থু করে মুখ থেকে মেঝেতে চা ফেলে দিলো। মুখে বললো,….. ছি ! বাজে চা। এই যে চাচা ! কি চা বানিয়েছেন?...
মাহবুব দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মিষ্টি খাচ্ছিল। থতমত খেয়ে আমার দিকে তাকালো। রুবি বললো,…
আপু ওনাকে চা করা শিখাবি। আর এই যে চাচা! আপুর কাছ থেকে চা বানানো শিখে নেবেন। …
আমার দিকে তাকিয়ে বললো,… জানেন? আপু যা সুন্দর চা করে না !...
মাহবুবের সাথে পরের রোববারেই রুবির বেশ মিল হয়ে গেলো।
সেদিন আকাশে মেঘ জমেছিল। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ধুলোবালি ধুয়ে মুছে নির্মল পরিবেশ রচনা করে গেলো। মিলিরা যখন এলো তখনও আকাশের মেঘ কাটেনি। গুড়া গুড়া বৃষ্টি গায়ে মেখে মিলি ব্যালকনিতে আমার দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। রুবি দরজার কড়া নেড়ে ডাকলো,… এই যে দাদু ভাই, আমরা এসেছি। দরজা খুলুন।…. দরজা খুলে দিতেই রুবি আমায় সারপ্রাইজ দিলো। হাতে একটা কেরোসিন-চুলা। বাম হাতে বড় একটা টিনের বাক্স। এগুলো ভেতরে এনে রাখলো। মিলির হাতে দুটো বাক্স ও কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ। রুবি বললো,…. আজকে আপনাকে আপুর হাতের চা খাওয়াবো। সাথে পিঠা ও মিষ্টি।… আমার পেটের উপর ডান হাতখানা বুলাতে বুলাতে আমাকে বললো,…. ঠিক আছে তো? নাকি আবার ল্যাট্রিনের পাশে বিছানা করে দিতে হবে?... আমি বললাম, … না, তা আর দরকার হবে না। যা কিছু এনেছো, তা আমার পেটের এক কোনায় পড়ে থাকবে। …..
রুবি চোখ দুটিকে কপালে তুলে বললো, …. বলে কি ভোটকা পেটুক !.....
পিঠা ও মিষ্টি খাওয়া শেষ হলে রুবি বললো,…..
দেখুন আমি হিসেব করেছি, আমি আর আপু খেলাম ছয়টি, আর আপনি খেয়েছেন ক’টি জানেন?
ক’টি?
আঠারোটি ! …. কপালে হাত তুলে বললো,….. এরপরে আবার সতেরো খানা পিঠে ! বাপরে বাপ ! এতকিছু কোথায় রাখলেন সাহেব?...
ও পাশ থেকে মিলি চেঁচিয়ে উঠলো,……এই রুবি ! এই অসভ্য জানোয়ারটার নজর-ই লেগে যাবে। …
আমাকে অসভ্য জানোয়ার বলিস? আর উনি যে জানোয়ারের মত খায় ! তাকে কি বলবি?.....
হাসিমুখে কথাটি বলেই রুবি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো,
…… মাহবুব চাচা ও মাহবুব চাচা! শুনুন ! এই আপনার পিঠে ! আর আমাদের জন্য আপনার চায়ের সব সামগ্রী নিয়ে আসুন। আজ আপু চা করবে। আপনি ভালো করে শিখে নেবেন।….
রুবির কলকাকলির মধ্য দিয়ে যখন চা পর্ব শেষ হলো, রুবি এসে আমার পাশে বসলো। আমার বাঁ-হাত খানা হাতে নিয়ে মিষ্টি করে বললো, …… দাদু ভাই আপু আপনার জন্য আরো একটা জিনিস এনেছে। … মিলির দিকে তাকিয়ে বললো, …. কিরে আপু, দেনা !...
আমি বললাম, …. কি এনেছো মিলি?
মিলি কথা বললো না। কি যেনো কিছু একটা বলতে গিয়ে ঠোট দুখানা কেঁপে কেঁপে উঠল মিলির। হাত থেকে ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে চেইন টানলো রুবি । একটা বকুল ফুলের মালা। মালা খানা হাতে নিয়ে জোর করে মিলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, …. দেনা গলায় পরিয়ে দে ।…. মিলি কাঁপছিলো। ওর চোখ দুটির কোন ভিজে উঠলো। হাত থেকে মালা খানা পড়ে যাচ্ছিল । রুবি বললো,…. আঃ এত কষ্ট করে মালাটি বানালি । আর এখন না দিয়ে ফিরিয়ে নিবি? তা হবে না। উঠতো, উঠ !....
মিলিকে জোর করে উঠিয়ে দার করালো রুবি। ওর বুড়ো আর তর্জনীর মাঝখানে মালার দুই প্রান্ত সাজালো। ওকে ধরে এনে আমার সামনে দাঁড় করালো।
আমি শিউরে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। …… একি পাগলামি করছো রুবি !
আপনি চুপ করুন তো সাহেব ! আরে কি হলো? দে, পরিয়ে দে !... মিলিকে ধমককালো রুবি।
আমার গলায় মালা খানি পরিয়ে দিয়ে মিলি আড়ালে ব্যালকনিতে চলে গেলো। রুবিও তাকে অনুসরণ করলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আমাকে চুপি চুপি বললো, … দাদু ভাই! আপু কাঁদছে।…
এর পরের ক’দিন ধরে মিলি আমার সামনে আসতে লজ্জা পেতো। আমাকে দেখলে এড়িয়ে যেতো। পরের রোববারে মিলিদের রিকশা এসে আমার বাংলোর গেইটে থামলো। কাঠের সিঁড়িতে দবদব শব্দ করে রুবি উপরে উঠে এলো।…….
দাদুভাই ! ও দাদু ভাই ! জব্বর খবর আছে।
কি?
আমি যে আপনাকে বলছি - তা আপুকে বলবেন না যেনো
আচ্ছা বলবো না
তাহলে শুনুন। আপু একখানা রুমালে সুন্দর একটা ফুল তুলেছে। নিশ্চয়ই আপনার জন্য?....
আমি হাসলাম। কিন্তু মিলি ততক্ষণে এসে পৌঁছে নি। মিলির পৌঁছুতে দেরি দেখে রুবি ব্যালকনিতে গেলো।…..
কিরে আপু দাঁড়িয়ে আছিস যে !.....
আমাকে ডেকে বললো, দাদু ভাই আপু দাঁড়িয়ে আছে। আসছে না।…. আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, ….
মিলি, আজ আমি তোমাকে সারপ্রাইজ করব। তোমার সুপারিশ অনুসারে সবাই বোনাস পেয়েছে। আর আমার প্রমোশন হয়েছে।
সত্যি ! ……
মিলি আনন্দে চেচিয়ে উঠলো….. সত্যি বলছেন? আপনি কার কাছে শুনলেন?
এসো, বড় সাহেবের চিঠি এসেছে। টেবিলে পড়ে আছে। পড়ে দেখো।….
মিলি দৌড়ে এলো। চিঠিখানা এক নজরে দেখে চঞ্চল হয়ে আমাকে বললো,….
দিন, আমার পুরস্কার দিন। মিলি হাত বাড়ালো। ….. কই, দিন না ! আমাকে কিছু একটা প্রেজেন্ট করতে হবে। নতুবা ছাড়ছি না।….
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। হতভম্বের মতো। কি দেবো? কিছুই যে আমার দেবার নেই ! একসময় মনে পড়লো, মিলির বকুল ফুলের মালাটা তাকে ফিরিয়ে দেই। শিয়রের কাছে আমার ফটোর সাথে ঝুলানো ছিল ঐ মালা। তাই এনে ওর হাতে দিয়ে দিতে গেলাম। ওমনি রুবি এসে বাঁধ সাধলো।…
জিনা। এভাবে হবে না। গলায় পরিয়ে দিতে হবে।..
আমাকে তা-ই করতে হলো। পবিত্র লজ্জার আবরণে মিলির মুখ। আনন্দের আতিশয্যে রুবিকে কাছে টেনে রুবির গাল টিপে দিলো মিলি।
আর এক দিনের কথা। বাংলোর ব্যালকনিতে বসে বসে আমি ও মিলি কথা বলছিলাম। রুবি ভেতরে গিয়ে অনেকক্ষণ কি নিয়ে যেনো নাড়াচাড়া করলো। একসময় চেচিয়ে বললো, ……
আপু, উনি যে বউয়ের জুতা-পেটা কত খান,- তার কোন শেষ থাকবে না। আরে দেখ না, সেটের ভিতর ব্যাটারি ব্যারেলে ব্যাটারিগুলো পঁচে-গলে একাকার হয়ে গেছে । কোন খোঁজখবর নেই । এক্কেবারে ভোদাই চরণ !....
লজ্জায় হয়তো আমার মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করেছিল। মিলি বললো,…
পাগলের মত কি যে বলিস মুখে - তার ঠিক নেই !...
রুবি দৌড়ে এসে আমার চেয়ারের হাতলের উপর নুয়ে মুখখানা আমার কানের কাছে এনে বললো, …
আপু গিটারে সুন্দর রবীন্দ্র সংগীত গাইতে জানে । শুনবেন?
তাই নাকি ! তাহলে তো অবশ্যই শুনতে হয় !
….. হ্যাঁ… গান না ছাই জানি।…. মিলি বললো। …..
তা শুনলেও তো মনে হয় মন্দ হবে না।…. আমি বললাম।
লজ্জায় মুখখানা লাল করে মিলি বললো,….
আমি পারবো না । ঠোঁট নেড়ে নেড়ে আপনার সামনে গান গাইতে । আমার লজ্জা লাগবে ।…..
চট করে রুবি বললো,….হ্যাঁ ঢাকাতে কালচারাল ফাংশনে গাইতে পারিস, আর দাদু ভাইয়ের সামনে লজ্জা লাগে !....
মাথা নেড়ে বললো ….. ফাঁকি দেয়া চলবে না । আগামী রোববারই....
রুবিকে রাস্তায় যেমন দেখেছিলাম, সে রুবির সাথে এই রুবির কোনো মিল খুঁজে পেলাম না । উচ্চতায় মিলির চাইতে একটু কম । সামান্য মোটা । গোলগাল শরীর । প্রশস্ত কপাল । ডাগর আয়ত চোখ । ঈষৎ মোটা নাক । অধরের মাঝখানে ছোট্ট একটু ভাঁজ থাকলেও চেহারায় মিলির আভাস মেলে । মিলি গম্ভীর। রুবি চঞ্চলা । রুবি বাক-পটু । মিলি নির্বাক থাকতে ভালোবাসে ।
পরের রবিবার সকাল আটটায় মিলিরা এলো ।
রুবির কলকাকলিতে আমার বাংলো মুখর হয়ে উঠলো । মিলির ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে চারটি ব্যাটারি বের করে রুবি ক্যাসেট প্লেয়ারে ভরলো । টেবিলের উপর ক্যাসেট প্লেয়ার রেখে নতুন ক্যাসেট ভরে সুইচ অন করলো । আমি সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে একটা ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিলাম । রুবি আমার গা ঘেঁষে সোফার হাতলের উপর বসে বললো,…শুনুন আপুর গান । …. মিলির কন্ঠে রবীন্দ্র সংগীত । কন্ঠের সাথে গিটারের সুর । মনে হলো পাপিয়া সারোয়ারকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে মিলির কন্ঠ ও সুর। মিলির কন্ঠ ও সুর আমার অনুভূতিতে তন্ময়তার আবরণ তুলে দিলো । আমি ডুবে গেলাম কণ্ঠ ও সুরের অপূর্ব মূর্ছনায় ! মিলির কন্ঠের অপূর্ব মূর্ছনায় মিলির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে অবচেতন মনে আমিও গাইতে থাকলাম... সেদিন দুজনে দুলে ছিনু বনে....
একে একে এ পিঠের আটটি গান শেষ হলো । ক্যাসেটের ও পিঠও শেষ হয়ে গেলো । রুবি ঝট করে আমার হাত ধরে বললো,…
দাদু ভাই ! আপনারও সুন্দর কন্ঠ ! আমাদেরকে একদিন গান শোনাতে হবে ।
আরে ! আমি আবার গান জানিনা কি !
হ্যাঁ, এই যে গাইলেন গুনগুন করে? আপুর গানের সাথে সাথে !....
মিলি হাসে । মিটিমিটি । আমি বলি ….
ও ! এ-তো বাথরুম সিঙ্গারের মতো ?
হয়েছে হয়েছে । শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না । জেনে রাখুন, রুবি আপনার কন্ঠের গান শুনেই ছাড়বে । আগামী রোববার । আপুর গিটার নিয়ে আসবো ।….
মিলির দিকে তাকিয়ে বললো,… কিরে আপু । কি বলিস?
অবশ্যই ।…
মিলি হাসলো অধর টেনে ।
কলেজ লাইফে একবার গান শিখার বাতিক উঠেছিল । গেলামও এক গানের স্কুলে ভর্তি হয়ে । স্বরলিপির বত্রিশ মাত্রা আয়ত্তে আনতেই আমার গলা ব্যথা শুরু হয়ে গেলো । কেউ কেউ বললো, - তোমার টনসিল বেড়েছে । কেউ বললো ফ্যারিনজাইটিস হয়েছে । আবার কেউ বললো - এই একটু ঠান্ডা লেগেছে, সেরে যাবে । গিয়েছিলও সেরে । তবে সেরে যাবার পরে আর গানের স্কুলের পথ মাড়াইনি । এক বন্ধু বিনা পয়সায় হারমোনিয়ামটা কিনে নিয়ে গেলো ।
গা ঝাড়া দিয়ে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালাম । রুবির মাংসল গালে ছোট্ট একটা থাপ্পড় দিয়ে বললাম, ….
থাক থাক আর উৎসাহ দেখাতে হবে না । তাড়াতাড়ি চলো । বেলা বেড়ে চললো ।
বাংলোর ঘাটে আগেই ছোট্ট একখানা ডিঙ্গি নৌকা বাধা ছিল । মাহবুব আমাদের অপেক্ষায় নৌকায় বসা ছিল । রুবি আগে গিয়েই মাহাবুবের পাশে বসে পড়লো । চঞ্চলা প্রমোদনীর মতো বললো,…..
মাহবুব চাচা, আপনি ওখানে গিয়ে বসুন । আমি নৌকা বেয়ে নেবো ।
আরে খালাম্মা, তুমি কি যে বলো ! নৌকা চালানো এত সহজ না । তুমি পড়ে যাবে ।
নৌকা চালাতে বসে আমি পড়ে যাবো?
হ্যাঁ । বৈঠার মোড় তোমার হাতে সামলাতে পারবে না ।
আরে, আসলে আপনি একটা গাধা । বসুন গিয়ে দাদু ভাইয়ের পাশে । এই বৈঠাটা রইলো আমার কাছে।…
মাহবুবের চোখ মুখ লজ্জায় লাল হয়ে এলো । আমি বললাম ঠিক আছে মাহবুব, তুমি ওর এই পাশটায় বসো । ও বেয়ে চলুক কতক্ষণ ।
আমার নিজের ছেলেবেলার কথা।…
তখনো প্রাইমারি ডিঙ্গাতে পারিনি । আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে তেতুলিয়া নদী । বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তর দিকে উত্তাল তরঙ্গের জোয়ার বয়ে চলে তেতুলিয়াতে । প্রস্থ ছয় থেকে দশ মাইল । নদীর মাঝ বরাবর সাত মাইল দৈর্ঘ্য ও দুই মাইল প্রস্থ একটি চর । নাম সবুজ চর । সেই চরে আমাদের মহিষের খামার । দশ একর জমিতে সোনালী ধান । ধান পেকেছে । কৃষাণ যাচ্ছে নৌকা-করে ধান কাটতে । তাদের সাথে আমিও যাচ্ছিলাম । নৌকার হাল ধরেছিল কিষান-সরদার হামিদ মিয়া । পাড় থেকে পাড়ি দিয়ে নৌকা বয়ে চললো দক্ষিণে চরের দিকে । এগিয়ে যেতে হবে তিন মাইল দক্ষিণে । তারপর সবুজ চর । কচি ঘাসে সাজানো সবুজ চরের কাঁদামাখা সৈকত । বুকে বাতাসে নৃত্যরত সোনালী ধানের চিকন লম্বা শীষ ।
নৌকা নদীর মাঝ বরাবর এলো । নদীতে জোয়ার । দক্ষিণা বাতাস শান্ত । সে শান্ত বাতাস ও নদীর পানিতে খন্ড খন্ড ঢেউয়ের মিছিল । একের পর এক বয়ে এসে আমাদের নৌকা খানাকে মৃদু দোলা দিয়ে আবার চলে যায়। দৃষ্টির আঙ্গিনা পেরিয়ে । অসীমে । হঠাৎ করে নৌকা খানা ঘুরে গেলো । নৌকার হাল পানির স্রোতের সাথে মোড় ঘুরে হামিদ মিয়াকে এক ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিলো । সবাই একই সাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো, …আরে হামিদ মিয়াকে ধরো, হামিদ মিয়াকে ধরো । এক পেট পানি খেয়ে হামিদ মিয়া নৌকার ডাল ধরে নৌকায় উঠলো। নসু চাচা বলে উঠলো, … কিরে হামিদ ! এমন ঠান্ডা নদীতে বৈঠা সামাল দিতে পারলি না?... হামিদ মিয়া লজ্জায় জড়োসড়ো । ভিজে জুবুথুবু ।
রুবি তার ওড়না খানা গলায় পেচিয়ে নিলো। হাত দুখানা কে শক্ত করে হালের হাতল চেপে ধরলো। হালের মাথা স্বচ্ছ পানিতে ঢুকিয়ে নিমজ্জিত অংশ-সংলগ্ন পানি পেছনে ঠেলে দিলো । পানি কেটে কেটে নৌকা খানাকে সামনের দিকে এগিয়ে দিলো । পানির উপরে বুক লাগিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নৌকা এগিয়ে চললো পশ্চিম দিকে। কিছুদূর গিয়েই নদীর মোড়ে মোড় ঘুরাতেই হালসহ রুবি নদীতে পড়ে যাচ্ছিলো। কোনক্রমে তাল সামলে নৌকাতেই পড়ে গেলো। হালখানা নদীতে পড়ে ভেসে যেতে লাগলো । মাহবুব ত্রস্ত হয়ে বলে উঠলো, …. আহা ! বলেছিলাম না মা, তুমি পারবে না ! এখন তো বৈঠাখানাই ফেলে দিলে ! রুবি বললো, …. ইস ! হালের বাঁটটা একেবারেই পিচ্ছিল, তাই হাত থেকে পড়ে গেলো।…
কামিজের এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত টেনে তুলে রুবি আমাদের পাশে এসে বসলো । আমার মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে হেসে দিলো । আমি বললাম, … আজকে পড়ে গেলে কেমন হতো?
আহা ! আমি যেনো সাঁতার জানিনা ! সাঁতরে ঠিকই নৌকায় উঠে পড়তাম ।
তারপরে কি হতো?
তারপর আর কি? নৌকাতে বসতে বসতেই কাপড়-চোপড় রোদে শুকিয়ে যেতো।…
ধমকের স্বরে মিলি বললো,…. হয়েছে হয়েছে । আর চালাকি খাটাতে হবে না। চুপ করে বসে থাক।…
মাহবুব নৌকার ওমাথায় একেবারে সুঁচালো কোণের উপরে বসে পাদু’খানাকে পানির ভিতর ডুবিয়ে দিয়ে পা দিয়ে বেয়ে বেয়ে নৌকা খানাকে হালের কাছে ভাসিয়ে নিলো এবং হাল খানাকে তুলে নিয়ে করাত করাত শব্দ বাজিয়ে নৌকা খানাকে সামনের দিকে বেয়ে চললো ।
নদী দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেছে । দুই পাশে পাহাড়। ও পাশের পাহাড়গুলো অপেক্ষাকৃত নিচু । পাহাড়ের ঢালে ও চূড়ায় সেগুনের সারি । পশ্চিমের পাহাড়গুলো একটু উঁচু । তামাটে মাটি ও বন-জঙ্গলে ছাওয়া । সামনে আরো কতটুকু বেয়ে গেলেই বন বিভাগের বাংলো । বাংলোর সামনেই নৌকা হেলে দুলে থেমে গেলো । আমরা নেমে পড়লাম ।
বাংলোর সম্মুখকার সরু রাস্তা দিয়েই এগিয়ে গেলাম । দক্ষিণে পাহাড়ের কোল বেয়ে ঘন সেগুনের ফাঁকে ফাঁকে পায়ে চলা শুরু রাস্তা দিয়ে। সারি সারি লম্বা সেগুন গাছ । ঢালের মত প্রশস্ত পাতা ছড়িয়ে সেগুন পাতারা আকাশের দিকে তাকিয়ে পাখা ঝাপটাচ্ছে যেনো। সেগুনের সবুজ কচি গুটানো কুঁড়ি সুউচ্চ চূড়ায় সবুজের মুকুট পড়িয়েছে। স্বল্প সংখ্যক শাখা-প্রশাখারা বাতাসে নেচে নেচে আনন্দ ছড়াচ্ছে। উপরে পাতারা উপর-নিচ হয়ে নীল আকাশের নিচে সবুজ শামিয়ানা গড়েছে। সামিয়ানার ওপার্শ্বে উজ্জল সূর্য হাসছে। সে হাসি আমাদের চোখের অন্তরালে পাতাদের বক্ষদেশে আনন্দ চুম্বন করে ভালোবাসা ছড়াচ্ছে।
মিলি এসে আমার পাশে দাঁড়ালো, …পলাশ ভাই ! সত্যি খুব সুন্দর ! তাই না?...
সম্মতি জানিয়ে মৃদু হাসলাম আমি। রুবি ছোট্ট একটা সেগুন চারার পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে পেছনে পড়ে গেছে। পাতাটাকে পাকিয়ে বাঁশির মত করে ছিড়ে ছিড়ে দূরে ফেলে দিচ্ছে। আনমনা হয়ে গান ধরেছে, …..আমি মেলা হতে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি…..
সত্যি কেমন নির্জনতা! তাই না?... মিলি বলে।
হোঁ !
আচ্ছা আপনার কাছে নির্জনতা ভালো লাগে পলাশ ভাই?
হ্যাঁ, কেন নয়?
জানেন? যখন কোন নির্জন জায়গায় এসে পড়ি, তখন আমি যেনো আপন বলয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে আমার অস্তিত্বকে খুঁজে পাই। সে বলয়ের মধ্যে একান্তে চুপি চুপি আমি নিজের কথা ভাবি। আপনার কথা ভাবি। ভবিষ্যতের অনাগত আনন্দ-দীপ্ত দিনগুলোর কথা ভাবি। তখন এই দেহে এক অনাবিল প্রশান্তি বয়ে যায়। আমি মোহিত হয়ে যাই।…..
রুবি এসে বললো, ….. আপু আমার এসব গাছ-গাছালি ভালো লাগেনা। তোরা ঘুরে-ফিরে আয়। আমি বরঞ্চ মাহবুব চাচার কাছে গিয়ে বসি।
রুবি চলে গেলো। আমি বললাম, …… চলো পাহাড়টার চূড়ায় ওঠা যাক। মিলি মাথা কাত করে সায় জানালো।
পাহাড়ের চূড়ায় সেগুন গাছের একটি শাখা ধরে দাঁড়ালাম। দক্ষিণের পাহাড়টায় মেহগনি গাছের সারি। পুবের পাহাড়টায় গর্জন গাছের উঁচু ঘন সবুজ দেয়াল। পশ্চিমে ও উত্তরে ঘন সেগুনের সবুজের সমারোহ। বন বিভাগের বাংলো অনেক উত্তরে। আমরা পাহাড়ের চূড়ায়। অনেক নিচে তিন পাহাড়ের সন্ধিস্থলে সেগুন গর্জনের মিশ্র বাগান। পাহাড়ের চূড়া থেকে অনেক নিজের গাছগুলোকে ছোট্ট একেকটা ঝোপের মত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমরা যেনো অনেক উপরে আকাশের কাছাকাছি। আর ছোট্ট লতাগুল্ম ঘেরা বন-বাদার অনেক নিচে। পৃথিবীর মাটি ঘেঁষে। মিলি পাশে এসে দাঁড়ালো ….
দেখলেন? নিচের ওগাছগুলোকে কেমন ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগে ! এত নিচের দিকে তাকাতে পিলে চমকে ওঠে ! আবার না তাকালেও চোখে তৃপ্তি আসে না !....
আমি মুগ্ধ চিত্তে বললাম, …. সত্যিই দারুন সুন্দর ! একেবারে হৃদয় ছুঁয়ে যায় !...
মিলি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। একেবারে মুখোমুখি। সেগুনের একটি শাখাতে আমি আমার হাত রেখে দাঁড়িয়েছি। সে ডালে আমার হাতের পাশে মিলির হাত। চোখেমুখে আনন্দের দীপ্তি। হঠাৎ করে মিলি কেমন যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলো। চোখে মুখেও ম্লানতার চাপ পড়লো। ম্লান হেসে মিলি আমাকে বললো, …..
একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। উত্তর দেবেন?
কেন নয়? কোনদিন কি উত্তর না দিয়েছি?
না, তা নয়। তবে সে উত্তরগুলো আর এ উত্তরের মাঝখানে বড় একটা দূরত্ব আছে। সে-সব উত্তরের পেছনে না থাকে কোনো শ্লেষ বা আবেগ। আর এই উত্তরের পেছনে আছে একটা ইতিহাস। বলতে পারেন আবেগের ইতিহাস। একটি সহজ-সরল কিশোরীর সংবেদনশীল কচি মন ও একটি ভীতু যুবকের পরিপক্ক মনের লুকানো ভালোবাসা ভালো-লাগার ইতিহাস !
প্রশ্নটা একটু সহজ করেই বলো।
আমাকে আপনার প্রজেক্টের অফিসে দেখার আগে আর কোথাও দেখেছিলেন, মনে পড়ে?....
আমি দুচোখে আশ্চর্যের কাজল ছড়িয়ে ঝটপট উত্তর দিলাম, … কই নাতো?...
মিলি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। অনুসন্ধিতসার দৃষ্টি নিয়ে অনেকক্ষণ পরে শীতল শান্ত কন্ঠে ধীরে ধীরে বললো, ….. সত্যিই কি আপনি আমাকে কোথাও দেখেননি?...
আমি মাথা নাড়লাম, ….. না দেখিনি।
মনে পড়ে? ঢাকার একটি কলোনি একটি বাজার। সে বাজারে অনেকগুলো দোকানের ভিড়ে একটি দোকান। দোকানে একটি কিশোরী দোকানি সন্ধ্যার পরে কিছুক্ষণের জন্য বসতো। দোকানি দোকানে বসলে একটু পরে একটি যুবক আসতো। একটি সিগারেট কিনার জন্য। সিগারেটটি হাতে নিতে নিতে যুবকটি তাকাতো কিশোরীর মুখের দিকে। গভীর দৃষ্টি দিয়ে। কিশোরীটি ভয় পেতো। কিশোরীটি চাইতো, ছেলেটি দোকানে না আসুক। কিন্তু, কিছুদিন গেলে কিশোরীটির মনের ভয় উড়ে গেলো। সন্ধ্যার পরে মেয়েটিও যুবকটির জন্য অপেক্ষা করতো। একটি ক্যাপস্টেন সিগারেটের প্যাকেট এনে সামনে রাখতো। ছেলেটি আসলে তার কিছু বলতে হতো না। লজ্জার খোলস ফাটিয়ে কিশোরীটি হাতখানা বের করে ছেলেটির দিকে সিগারেটের একটি শলা এগিয়ে ধরতো। ছেলেটি কিছুই বলতো না। দু’ঠোটের ফাঁকে সিগারেটটি নিয়ে ম্যাচ বাক্সে টস শব্দ করে সিগারেটে আগুন ধরাতো। নিচের দিকে তাকিয়েই ছেলেটির মুখ-খানাকে দেখতে পেতো কিশোরীটি। আনমনে দেখতো আর শিহরিত হতো।….
তারপর?
তারপর, একদিন মেয়েটির দোকানে বসার মেয়াদ ফুরিয়ে এলো। বাসার চার দেয়াল ও স্কুলে যাওয়া আসার পথের সীমানায় মেয়েটি আটকে গেলো। মেয়েটির চোখের অন্তরালে ছেলেটি হারিয়ে গেলো।
তারপর?
অনেকদিন পর বড় হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর মেয়েটি বাংলাদেশ হর্টিকালচারাল বোর্ডের একটি সাইট্রাস প্রজেক্টের অফিসে ছেলেটিকে খুঁজে পেল।
কি বলছো তুমি যা-তা। আমারতো একটুও মনে পড়ছে না। মিলি নামের কোন মেয়েকে আমি জানিই না।
আমার কাগজে নাম ছিল মিলি। মা ডাকতেন সুফিয়া বলে। মিনি নাম তার পছন্দ ছিল না।…..
মিলি ভাবের জগত থেকে ফিরে এলো। কন্ঠে বিষিন্নতা এনে বললো, ……সত্যি কি আপনার মনে পড়ে না কিছুই?
আমি বললাম, .. ওহো !...
কাতর-বেদনার্ত টানা চোখের উদাস দৃষ্টি নিয়ে মিলি আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ফেলে অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো, … সত্যি?...
ধীরে ধীরে আমার মুখের উপর থেকে দৃষ্টি টেনে মাটির দিকে নামাল মিলি। পায়ের জুতো দিয়ে পাহাড়ের উপরের ঘাস গুলোকে দুমরে মুচড়ে মাটির সাথে পিসিয়ে দিচ্ছিল সে। বাম হাতে সেগুন শাখার ছাল খুঁটতে খুঁটতে অবচেতন মনে এক সময়ে আমার আঙ্গুল নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। আমি চৌকিতে আমার হাত খানা টেনে এনে গলায় ছোট্ট একটি কাশি দিয়ে বললাম, … চলো মিলি, ফেরা যাক।…
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটি কামড়াতে কামড়াতে কি যেনো ভাবছিলো মিলি।আমার ডাকে সাড়া দিয়ে বললো, … চলুন। …
আমি পাহাড় থেকে নামতে উদ্যত হলাম। হঠাৎ করে মিলি বললো, … এই শুনুন !...
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। মিলি বিনীত কন্ঠে ধরা গলায় বললো, …. একটা কথা রাখবেন?
কি? বলো না
আমাকে একবার সোফিয়া বলে ডাকবেন?....
মিলির করুণ চাহনি। আমি ইতস্তত করতে করতে বিব্রত কন্ঠে বললাম, … চলো সুপ্রিয়া !...
মিলি চমকে উঠলো। লজ্জায় ওর মুখ লাল হয়ে গেলো। অধরখানা কাঁপাতে কাঁপাতে পেছন ফিরলো। আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকলো। চোখ মুছলো। আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম। নিঃশব্দে। একবার ভাবলাম, আমার ভুল শুধরে আবার সুফিয়া বলে ডাকি। কিন্তু মনের জোর পেলাম না। চতুর্পাশের নির্জনতাকে বিষাদ-করূন নির্জনতা বলে মনে হলো। সমস্ত পরিবেশটিকে নিষ্প্রভ মনে হলো।
অনেকক্ষণ পর মিলি এদিক ফিরলো। গালে আনন্দের লালিমা। আর্দ্র চোখে আনন্দের ছটা। ঠোঁটের কোনে হাসির মায়া। চেহারায় বিজয়ের উল্লাস। অভিমানে-ঝরা আহলাদি কন্ঠে বললো, …. আমি কিন্তু নিচে নামতে পারবো না, ভয় লাগে। পা ফসকে যদি নিচে পড়ে যাই !
মিলি তার ডানহাত খানা আমার বাঁ হাতের দিকে এগিয়ে দিলো। পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম ডান হাতে সেগুনের গা ধরে ধরে। মিলি আমার আগে আগে। তার চিকন নরম লম্বা আঙ্গুলগুলো আমার শক্ত মোটা লম্বা আঙ্গুলের মাঝে। পথের মাঝখানটায় মিলি হঠাৎ করে পড়ে যাবার ভান করে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, …. এই পড়ে গেলাম তো ! কি পুরুষ লোক ! ধরে রাখতে জানে না !... অধর কে সরস করে মিলি হাসলো। মিষ্টি করে। সেগুনের চওড়া পাতা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে।
…..এই একটু দাঁড়ান তো !... মিলি তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুললো।
…… এই যে চোখ বন্ধ করে ডান হাতখানা এগিয়ে দিন তো !.... মিলির চোখে দুষ্টুমির হাসি। আমি চোখ বন্ধ করে ডান হাতখানা এগুলাম। মিলি আমার হাতে কি যেনো একটা রাখলো। উচ্চস্বরে বাতাস কাঁপিয়ে মিষ্টি হাসলো।……যারটা তার কাছে থাকুক, আমি কেন কষ্ট করে ব্যাগে বয়ে টানবো ! … বলেই একটু সলজ্জ হাসি দিয়ে দৌড়ে পাহাড়ের নিচে একাই নেমে গেলো। আমি চোখ খুলে হাত মেললাম। দেখলাম, একখানা সাদা রুমাল। চারদিকে অতি যত্নে নেটকরে বর্ডার ধরা ছোট্ট একটি মনোমুগ্ধকর ফুল। তারই নিচে বাংলা হরফের আলপনা, ‘সুফিয়া’।
বন বিভাগের বাংলোর সামনে এসে দেখি, ঘাটে নৌকা নেই। মিলি কন্ঠে আদর টেনে বললো, দেখুন তো, রুবি কি দুষ্টু ! নৌকাটা নিয়ে কোথায় উধাও !
মিলির কন্ঠ মিলিয়ে না যেতেই দূরে নদীর বাঁক থেকে রুবির কন্ঠ ভেসে এলো, - এই যে দাদু ভাই ! অপেক্ষা করুন, এসে গেছি !
…..জানিস আপু, সম্পূর্ণ পথটা আমিই বেয়েছি। মাহবুব চাচা যা চালু না ! মাত্র দশ মিনিটেই আমাকে সব কিছু শিখিয়ে দিলেন।…. আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ….. কি দাদু ভাই ! আপনার মুখে কালী মেখেছে কে? আসুন পার করে দেই। ভাড়া স্বরূপ মিষ্টি চাই, মিষ্টি !....
মিলি সপ্রতিভ হয়ে বললো,… ঠিক আছে চল। তোকে আজ পেট ভরে আমিই মিষ্টি খাওয়াবো।
কোন মন্তব্য নেই
50