Header Ads

উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা: পর্ব চার - নীল অপ্সরী

  পড়ুন উপন্যাস:  সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব চার - নীল অপ্সরী (ছবিটির নিচে)

নিবেদনউপন্যাসটির প্রেক্ষাপট

আশির দশকের প্রথম ভাগ। তখন মোবাইল ফোন আসেনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিফোনও ছিল না। তখন চিঠির মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতো সবাই। আর গ্রাম-গঞ্জে পাহাড়ি অঞ্চলে বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল না। এরকম সময়-পরিবেশে যাপিত জীবনের কল্পকাহিনি  নিয়ে গড়া উপন্যাসটি। আশির দশকের সময়-পরিবেশ অনুধাবন করে উপন্যাসটির সকল পর্ব পড়তে থাকলে নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে। এটি চতুর্থ  পর্ব । প্রথম  পর্ব থেকে পড়ার অনুরোধ রইলো। প্রথম পর্বের লিংকটি এখানে দিয়ে দেয়া হলো https://bengali.pratilipi.com/series/supriya-priyatma-porbo-ek-anuprabesh-by-iqbal-jafu-abmqnd4trcwo

 

উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা: পর্ব চারনীল অপ্সরী

 

মিস মিলি আমার সর্বস্ব কেড়ে নিলো।

প্রজেক্ট এর সর্বত্র জুড়ে তুমুল হই-চই পড়ে গেল।

উত্তরের ফার্মের ওভারশিয়ার লতিফ পশ্চিমের ফার্মের ওভারশিয়ার রশিদের বিরুদ্ধে পাঁচ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে কেন তাদের বিরুদ্ধে উপরে কোন রিপোর্ট করা হবেনা তার কারণ দর্শানোর নোটিশ ইস্যু করা হলো আমাকে দিয়ে।

প্রথম দিন অফিসে এসে যে তরুণী সহজ বালিকাটির মত হাত-পা গুটিয়ে ঘোমটা টেনে চুপটি করে বসে ছিল, সে- দশ পনেরো দিন যেতে না যেতেই সকল কর্মচারীদের ত্রাসের বিষয় হয়ে পড়লো

প্রথম চাকুরীতে ঢুকেই কাউকে এতোটুকু একটিভ হতে দেখিনি আমি। শাড়ির আচল কাঁধের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে উপরের বেসামাল চুলগুলোকে ঢেকে ডান হাতের নিচ দিয়ে এনে কোটির উপরিভাগে শক্ত করে পেঁচিয়ে ছাতা মাথায় যখন পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাড়াতো, তখন এক অপরূপ দুর্ধর্ষ ডানপিটে পাহাড় কন্যার মত মনে হত মিস মিলিকে। মনে হতো পাহাড় থেকেই তার জন্ম হয়েছে। দেহবল্লরীতে নিষ্ঠুর রূঢ় মাধুর্য নিয়ে এইমাত্র বেরিয়েছে পাহাড় থেকে। সম্পূর্ণ কাজ তদারকি করে আবার পাহাড়ের ভিতর ঢুকে যাবে। ওকে তখন সমাজের একজন বলে মনে হতো না। মনে হতো ভূমির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা বেআব্রু পাহাড়মাতা কে সবুজ পাতার কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে পারলেই বুঝি তার মুক্তি। আর পাহাড় মাতার ইজ্জত রক্ষা করার দায়িত্বটুকুই যেন তাঁরই উপর ন্যস্ত।

মিস মিলি একদিন আমাকে এসে বলল, - যাই বলুন স্যার - ওভারশিয়ার ব্যাটাদের কোথাও যেন দুর্বলতা আছে। তা না হলে কি ত্রিশ টাকার একটা লেবার কাজে ফাঁকি দিতে পারে? লেবাররা যেন কাজে ফাঁকি দিতে না পারে, সেজন্য কিছু জরুরী পদক্ষেপ নিল মিস মিলি। ওভারশিয়ারদের একঘন্টার অফিস ডিউটিকে আধাঘণ্টায় নামিয়ে আনলো - যাতে বেশি সময় ধরে তারা ফার্মের কাজের তদারকি করতে পারে। ফার্মের তদারকিতে অবহেলা, কাজে-অকাজে অফিসে না আসার জন্য নোটিস জারিও করলো মিস মিলি। লেবারদের কাজের তদারকিতে ন্যাস্ত সরদারদেরকেও কাজে ন্যাস্ত করা হলো। এবং দিনের শেষে কতটুকু কাজ হয়েছে আমাকে রিপোর্ট করার জন্য ওভারশিয়ারদের নোটিশ জারি করলো। নতুন ফার্মের কাজের অগ্রগতির জন্য ফিউটারলস আর্লি কিনো ফার্মের ওভারশিয়ারদেরকে দৈনিক চার ঘন্টা করে নতুন ফার্মে নিয়োগ করলো।

কাজের প্রথম পর্যায়ে আমাকে এসে বললো, - স্যার প্রোজেক্টের গুদামে অবশ্যই একটা ছোট টিনের ছাপড়া করার মত প্রয়োজনীয় টিন কাঠ রয়েছে। তাই যে 'দিন নতুন ফার্মের কাজ চলবে সে কয়দিন নচেৎ আমার ফার্মের অফিসটা নদীর পাড়ের খালি জায়গাটুকুতে হলে কাজের তদারকি করতে সুবিধে হতো। আমি তার প্লান পাস করিয়ে ওখানে ওর জন্য একটি অফিস করে দিলাম। একখানা টেবিল চেয়ার দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম। একজন পিয়ন নিয়োগ করে ওর প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সাহার্য্য করার সুবিধা করে দিলাম। একদিন ফার্মের কাজ পরীদর্শনে গেলে আমাকে বলল,  …..

স্যার ল্যান্ড পিপারেশন তো প্রায় শেষ হয়ে গেল। ল্যান্ড পিউরিফাই করার দরকার আছে কি?.....

আমি বললাম, ….

না। কেমন দরকার নেই। তবে ফাঙ্গাস অর এনি আদার ডিজিজ এজেন্ট এর ব্যাপারে কিছু কিছু প্রিভেন্টিভ মেজার নিলেই হয়ে যাবে। আর সয়েলের এসিডিটি কিছুটা কমানোর জন্য পরিমাণমতো চুন মিশালেই চলবে।

প্রিভেন্টিভ মেজার হিসেবে কি কি নেয়া যায়?

ডিজিজ ফ্রি চারা ব্যবহার, পিট্ ডিগিং করে পিট্ মাটিকে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নেয়া,…

রোপণের আগে গাছের চারাকে ট্রিটমেন্ট করার দরকার হবে না?

অবশ্যই দরকার হবে। সে জন্য বোর্দো-মিক্সার বানিয়ে নার্সারিতে স্প্রে করতে হবে। …..

 

একদিন অফিস আওয়ারের শেষদিকে কতগুলো কাগজপত্র নিয়ে আমার অফিসে এলো মিস মিলি। ….

স্যার আমি আসার আগে লতিফ সাহেব রশিদ সাহেব মাস্টাররোলে অতিরিক্ত লেবার দেখিয়ে পাঁচ হাজার টাকা আত্মসাত করেছে। এই যে তার প্রমাণ। হাত থেকে কতগুলো কাগজপত্র আমার টেবিলে রাখল মিস মিলি। ব্যাপারটা যেহেতু আমার সময়ে ঘটেছে, সেহেতু আমি দারুণভাবে লজ্জিত হলাম। ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, …..

অবশ্যই একটা বিহিত ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনবোধে এটার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ওদেরকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করে রাখবো।

অবশ্য ওভারশিয়ারদেরকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করতে হলো না। একদিন সন্ধ্যায় ওভারশিয়ার দুইজন আমার বাংলায় এসে হাজির। আমি গলা চেচিয়ে বললাম, ……

দেখুন আমার কাছে কিচ্ছু হবেনা। আপনারা ম্যাডামের কাছে যান। উনি যা করার করবেন।…..

পরদিন মিস মিলি ওভারশিয়ার দুজনকে নিয়ে আমার অফিসে এলো। পাঁচ হাজার টাকা গুনে আমার সামনে টেবিলের উপর রেখে বলল, ……

স্যার এবারের জন্য মাফ করে দিন। এরা টাকাগুলো দিয়ে দিয়েছে। আর ফার্মের কাজ প্রায় শেষ। বেশ খাটুনি কেটেছে সবাই। তাই স্টাফদের জন্য স্পেশাল বোনাসের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।….

অফিসের একাউন্ট বইতে এই টাকাফাইভ থাউজেন্ড প্রফিট ফর্ম দা ভেজিটেবল কাল্টিভেশন’ - লিখে দিয়ে টাকাগুলো ফান্ডে জমা করে দেয়ার জন্য কেশিয়ার সাহেবকে নির্দেশ দিলাম।

মিস মিলি চলে গেল। মুখে কৃতিত্বের হাসি। চোখে আনন্দের দীপ্তি।

ক্রমে ক্রমে চারা রোপণের দিন ঘনিয়ে এলো। দুই ফুট দৈর্ঘ্য দুই ফুট প্রস্থ দুই ফুট গভীর করে গর্ত খোঁড়া হল। প্রয়োজনমতো সার চুন মিশিয়ে গর্তগুলো ভরা হল। কলম করা কমলা লেবুর চারা এনে গর্তের মাঝখানে রোপন করা হলো। রোপণ করা ছোট্ট ছোট্ট  চারার লাইন দিয়ে নতুন পাহাড়টির চার দিকে মেখলা পড়ানো হলো। এভাবে একদিন নতুন ফার্মের কাজ ফুরিয়ে এলো। অস্থায়ী লেবারদের বিদায় করে দিয়ে শুধুমাত্র স্থায়ী লেবারদেরকে কাজে লাগানো হলো। বৃষ্টি না হলে গাছের গোড়ায় পানি দেয়া, বেশি বৃষ্টিতে অতিরিক্ত পানি সরাতে গাছের গোড়া থেকে নিচের দিকে চিকন নালা কেটে দেয়া, বৃষ্টিতে গাছের গোড়ার মাটি ধুয়ে নিয়ে গেলে নতুন মাটি দিয়ে গাছের গোড়া ভরাট করা, বৃষ্টির পরে গাছের গোড়ার মাটি শক্ত হয়ে গেলে নিড়ানি দিয়ে মাটি ঢিলা করে দেওয়া, কীটপতঙ্গ বা অন্য কোন ফাঙ্গাস গাছকে আক্রমণ করলে সময় মত ঔষধ ছিটানো, গাছের চার-পাশের জায়গায় আগাছা পরিষ্কার ছাড়া লেবারদের যেনো আর কোন কাজ রইল না। ওভারশিয়ার দেরও কাজ কমে এলো। পুরনো বাগানে গাছের গোড়ায় চতুর্দিকে মাটি কুপিয়ে তাতে সার মেশানো এবং বাগান রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া কারোরই যেন কোন কাজ রইল না।` ফার্মের কাজ শেষ হয়ে এলো। একদিন মিস মিলি এসে বলল, ……

স্যার, সামনের লনটাতে তো আমরা ফুলের বাগান করতে পারি।…..

আসলে মতামতের জন্য সে নিশ্চয়ই আসেনি। সে জানতো, সামনের লনে ফুলের বাগান করলে আমার আপত্তি থাকার কথা নয়। তাই সে আমাকে জানাতে এসেছে যে সে অফিসের সামনের লনটিতে ফুলের বাগান করতে যাচ্ছে। মিস মিলি আসার পরে বস্তুতপক্ষে আমার প্রভাব প্রজেক্ট এর সর্বত্রই কমে গেছে। সবকিছু দেখাশুনা করত মিস মিলি। নতুন ফার্মের তদারকি, সুপারভাইজারদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া, লেবারদের মজুরি বিষয়ক বিল অনুমোদন করা, স্থায়ী লেবার সুপারভাইজারদের ছুটির আবেদন পত্রে অনুমোদন দেওয়া, -সবই মিস মিলি নিজ দায়িত্ব বলে ধরে নিয়েছিল। অফিসে বসে সিগনেচার দেয়া ছাড়া আমার আর কোনো কাজ রইলো না যেন। তবুও ফার্ম পরিদর্শনে যেতাম। কোথাও কোনো খুঁত ধরতে পেতাম না। লেবার ওভারশিয়াররাও আমার যাওয়া না যাওয়াতে কোন আমল করত না। আমি যেন বহিরাগত একজন ভিজিটর মাত্র। মিস মিলিই যেন সব - ওদেরকে আদেশ পরামর্শ দেয়া একমাত্র অফিসার্স। তাই আমার জবাব দেয়া না দেয়ায় গুরুত্ব উপলব্ধি করে বললাম ….

মন্দ হতো না।…..

মিস মিলি গর্বিত ভাব নিয়ে চলে গেল। পরের দিন বাগানের কাজ আরম্ভ হল। চতুর্দিকে হলুদ পাতাবাহারের বেড়া দেয়া হলো। পথের দুপাশে আটটি করে ষোলোটি ছোট ছোট প্লট তৈরি করা হলো। প্রতি প্লটের চার দিকে নাইন--ক্লক এর লতা লাগিয়ে বাউন্ডারি দেয়া হলো। একদিন শহরের আরবেরী কালচার ফার্ম থেকে নানান রকমের ফুলের চারা আনা হলো। রোপন করা হলো মেরিগোল্ড, রজনীগন্ধা, ল্যান্টেনা, নয়ন তারা, ইকজোরা, কক্সকম ডায়ান্থাস ফুলের কচি কচি চারা। কোনায় কোনায় লাগানো হলো গোলাপ, গন্ধরাজ, বেলি, কসমস, ঝাউ, অ্যালামন্ডা সুদৃশ্য ঝোপ জাতীয় আরো অনেক অর্নামেন্টাল প্লান্ট। কখনো নীল, কখনো আকাশী, আবার কখনো বিচিত্র রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরে মিস মিলি ঘুরে বেড়াতো বাগানের চারদিকে। পায়ে চামড়ার পাতলা স্যান্ডেল জোড়া পড়ে চটচট শব্দ করে হেঁটে যেতো পাহাড়ে। বড় রঙিন চশমা চোখে লাগিয়ে হেঁটে বেড়াতো পাহাড়ের সরু পথে। আনন্দে আবেগে হাত বুলাতো কমলালেবুর ছোট ছোট সবুজ পাতায়। ফার্ম পরিদর্শন করে কখনো এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে বলতো, ……

ফার্মের গাছগুলো যা সুন্দর হয়েছে না স্যার!....

স্বর্গের অপ্সরী কোনদিন দেখিনি। স্বর্গে অপ্সরীরা নেচে বেড়ায়। গান গায়। হাসি ছড়ায়। ইত্যাদি ইত্যাদি বর্ণনা শুনেছি মাত্র। কোনদিন হৃদয় দিয়ে তাদের সৌন্দর্যকে অনুভব করিনি। তবুও হৃদয়ে তাদের একটা আবছা আবছা মূর্তি রচিত হয়ে গিয়েছিল। হয়তো তাই মিস মিলি যখন নীল শাড়ি পড়ে, লাল রঙের লো-কাট ব্লাউস পরে, ডান হাতে নিল দুটি চুরি গলিয়ে, ভ্রুতে কাজল লাগিয়ে, ঠোঁটে রঙ ছড়িয়ে, দেহ দুলিয়ে, চুল উড়িয়ে হেসে হেসে বেড়াতো, তখন তাকে নীল অপ্সরীর মত মনে হতো। মনে হতো তার বাগানের মাঝ দিয়ে ঝরনা বইছে। গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। ফুলে ফুলে দোলা দিয়ে বাতাস সৌরভ ছড়াচ্ছে। গাছের সবুজ ডালে পাখিরা গান ধরেছে। আর ঝরনার নীল স্বচ্ছ পানিতে মিস মিলি পা নাচিয়ে নাচিয়ে পানি ছিটিয়ে খিলখিল করে হেসে দৌড়ে পালাচ্ছে। আর পেছনে আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা পাথরের ভাস্কর্যের মতো। মূক, স্থবির, প্যারালাইসিস রোগীর মত। দেখি আর অনুভব করি - কিন্তু নিশ্চুপ থাকি।

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই

50

Blogger দ্বারা পরিচালিত.