Header Ads

উপন্যাস:সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব আট: ফিরে পাওয়া

 পড়ুন উপন্যাস:  সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব আট:  ফিরে পাওয়া (ছবিটির নিচে) 

নিবেদনউপন্যাসটির প্রেক্ষাপট

আশির দশকের প্রথম ভাগ। তখন মোবাইল ফোন আসেনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিফোনও ছিল না। তখন চিঠির মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতো সবাই। আর গ্রাম-গঞ্জে পাহাড়ি অঞ্চলে বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল না। এরকম সময়-পরিবেশে যাপিত জীবনের কল্পকাহিনি  নিয়ে গড়া উপন্যাসটি। আশির দশকের সময়-পরিবেশ অনুধাবন করে উপন্যাসটির সকল পর্ব পড়তে থাকলে নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে। এটি অষ্টম পর্ব। প্রথম পর্ব হতে পড়ার অনুরোধ রইলো। প্রথম পর্বের লিংকটি এখানে দিয়ে দেয়া হলো https://bengali.pratilipi.com/series/supriya-priyatma-porbo-ek-anuprabesh-by-iqbal-jafu-abmqnd4trcwo

উপন্যাস সুপ্রিয়া প্রিয়তমা

আট:  ফিরে পাওয়া

 

পূবের পাহাড়ের সবুজ বনানীকে আলোকিত করে রুপালি সূর্য অনেক উপরে উঠে এসেছে। আকাশের কোথাও এক টুকরো মেঘের চিহ্নও নেই। দক্ষিণ-পূর্ব আকাশ থেকে মৃদু বাতাস গাছ-গাছালির পাতা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আকাশের নীলিমায় পাখিরা পাখা মেলে দল বেঁধে উড়ছে।

গতকালের ঝড় বৃষ্টির দাপটের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক-সেদিক। গাছের পাতা ছোট ছোট শাখা-প্রশাখা রাস্তা বা অফিস চত্বরের এদিক-সেদিক বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে। দীর্ঘ-উদাসীন নির্জীব সময়গুলো কাটিয়ে হঠাৎ করে সজীব হয়ে উঠার প্রচেষ্টা সর্বত্র। উচ্ছল পরিবেশ আমার অফিস চত্বরটিকে কেন যেনো  আজ নতুন সাজে সাজিয়েছে মনে হলো, অফিসে এসেই একটা ভিন্ন রকমের টান অনুভূতি আমার সম্পূর্ণ সত্তাকে কুয়াশার মতো ঘিরে একটিমাত্র প্রতীক্ষার বলয়ে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। অফিসের এই ভালোবাসা ভালোলাগা পরিবেশে আমি তাই মিলির প্রতীক্ষায় প্রতিটি মুহূর্তকে পরিপূর্ণভাবে অনুভব করতে থাকলাম।

 

আমার কেন যেনো  মনে হলো - মিলির জন্য এই প্রতীক্ষা একটা সাধনার মতো। সাধনা করতে করতে আমি যখন মিলিকে আমার অফিস কক্ষের দরজার পর্দার পাশে দেখতে পাবো - তখন আমার সাধনা শেষ হবে।

আমি মিলিকে পাবো এবং সারাটা দিন আমার সময়গুলো আমি মিলির জন্য ব্যয় করবো।

কিন্তু সে মুহূর্তে আমার পাহাড় থেকে সাগর পানে ছুটে যাওয়া নদীর কথা মনে পড়লো। সাগরের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য নদী কি প্রবল স্রোত নিয়ে গড়িয়ে চলে ! সে স্রোতের গতি দুর্দমনীয়। স্রোতের আওতায় যা কিছু আসে, নদী সব কিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে। তারপর নদী যখন সাগরের কাছে আসে, তখন সে মিলনের ইচ্ছের প্রবলতায় সীমাহীন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে এবং প্রবল কান্নায় সাগরের বুকে আছড়ে পরে। এরপর অনন্তকালের জন্য মিলনের মহা সুখে মোহনা স্তরে নিশ্চুপ হয়ে নিথর হয়ে যায়। তখন হারিয়ে যায় তার প্রবল বিক্রম সর্বগ্রাসী তেজ - প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে তার সাধনার শেষ হয় !

প্রাপ্তিতে সাধনার যখন সমাপ্তি ঘটে তখন তেজস্বীনি নদীর বৈচিত্র্যময় এই রূপ  আর থাকে না। নদীর জীবনের যে সময়টুকুতে সাগরকে পাওয়ার ব্যাকুল সাধনা এবং ইচ্ছে লেপ্টে থাকে, আমার মনে হয় সে সময়টুকুই গৌরবময়। সে সময়টাতেই নদী সাগরকে তার সম্পূর্ণ অনুভূতি দিয়ে অনুভব করতে থাকে। সাগর মহিমার সম্পূর্ণটুকুই থাকে তার একান্ত নিজস্ব হয়ে - আপনার মনের মনিকোঠায় আবদ্ধ হয়ে।

মিলনের পরে চাওয়ার যখন আর কিছুই থাকে না, পাওয়ারও আর কিছুই থাকে না। আমার কেন যেনো  মনে হয় - নদীর শেষ সময়টুকু সম্পূর্ণ ক্লান্তিকর ! অবসাদময় ! যে জীবন ছিলো তেজ বিক্রমশালী - সে জীবন হয়ে যায় নির্জীব অকর্মণ্য ! - আর তাই মিলনের পরের জীবনটুকুকে চাকচিক্যহীন-ধোঁয়াটে কুয়াশাময় বলে মনে হয় যা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন !

এই ধরনের সমূহ ধারণা আমার মনে উদয় হতে আমার মনে হলো যে - মিলির জন্য আমার জীবনের এই প্রতীক্ষিত মুহূর্তগুলোই সবচাইতে মূল্যবান। এবং অনুভূতির রসালো ফলগু ধারায় সিক্ত। কিন্তু এক সময়ে অনুভূতির ফলগু ধারা গড়াতে গড়াতে প্রাপ্তির বলয়ের সীমারেখায় বিলীন হয়ে যায়। তখন আমি আগের চাইতেও প্রবল তাড়নায় মিলির জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকি !

কিন্তু অফিস সময়ের সমস্ত সময়টা প্রতীক্ষার পরও মিলি এলো না। নির্মল রুপালি সকাল নিয়ে যে দিনের আগমন - নিরালায় নিরানন্দ দুপুর দিয়ে তার বার্ধক্য। অফিস থেকে ফিরে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে মনের অবসাদ তাড়ানোর জন্য খাটের উপরে ক্লান্ত গা টাকে এলিয়ে দিলাম।

আমার চোখের রেটিনার সূক্ষ্ম পর্দায় মিলির ছবি স্থায়ীভাবেই অঙ্কিত হয়েছিলো। ঘুম এলো না। এটা সেটা স্মৃতিচারণের ফাঁকে ফাঁকে আমার ইচ্ছের-আত্মা আমাকে আমার অফিসে নিয়ে বসালো।…..

অফিসের কর্মচারীরা একজন দুজন করে আসছে। আমি অফিসে এসেই মিলির আগমনের অপেক্ষায় বসে বসে ভাবছি,  মিলি এলে সর্বপ্রথম মিলিকে আমি কি বলে সম্বোধন করবো। আর স্বাগত জানানোর পরইবা কেমন করে কোন কথাটা প্রথম তাকে বলবো। মিলি কি সেদিনের লাল পাড়ওয়ালা সাদা শাড়িটা পরে আসবে? লাল পাড়ওয়ালা সাদা শাড়িতে মিলিকে সুন্দর মানায়। গায়ে লাল ব্লাউজ, খোপায় লালফুল - হালকা গোলাপি ঠোঁট !......

এসো মিলি !  দরজার পর্দা ঠেলে মিলি এসে চৌকাঠ সীমানায় দাঁড়ালো। আমার ডাকে সাড়া দিয়ে সামনের সোফাতে এসে চুপটি করে মিলি বসলো…..

তা কেমন আছো

ভালো-.. মিলির সংক্ষিপ্ত উত্তর।

মিলির কানে ছোট্ট দুটি সোনার ঝুমকো। লম্বাটে মুখের দুপাশে ঝুমকো দুটি সুন্দর বানিয়েছে। পটলচেরা চোখের উপরে কাজল টানা রেখা। চোখের কোনে নির্মল সৌন্দর্য। মুখে স্মিত হাসি। অবনত দৃষ্টি। আমি এক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকি মিলির মুখের দিকে।  লজ্জা লজ্জা চোখ দুটি দিয়ে মিলি আমার দিকে তাকায়। সারা ঘরময় লজ্জা রাঙ্গা হাসি ছড়ায়। চোখের কোনে শাসন মিশিয়ে কণ্ঠে মৃদু ধমকের সুর তোলে…..

এই কি হচ্ছে !

কি?

তা এমন করে তাকিয়ে আছো কেন? মনে হচ্ছে আর কোন দিন দেখনি ! আজকেই নতুন দেখছো !

কেন, সুন্দরকে কি দেখতে নেই?

আহা ! ফাজলামো করোনা

ফাজলামো বুঝি? তুমি সুন্দর - তাইতো না তাকিয়ে পারিনা !

আবার ফাজলামো? আমি চলে যাব কিন্তু !.....

মিলি চলে যাবার ভান করে। মিলিকে আরো আশ্চর্য-সুন্দর লাগে। মুগ্ধ হয়ে মিলিকে দেখতে থাকি।

….. এই হচ্ছেটা কি? চোখ সরাচ্ছ না কেন? বেহায়া ! আমার লজ্জা করছে না বুঝি?...

মিলি লজ্জা-রক্তিম হয়ে দু'চোখে হাত রাখে। মিলিকে আরো সুন্দর লাগে! হয়তো, সব মেয়েদের জীবনের কোন একটা বিশেষ সময়ে এমন কতগুলো মুহূর্ত আসে, যখন তারা মিলির মত এমন লজ্জা-রক্তিম সুন্দর হয়ে ওঠে। আমার তাই মনে হলো।

আমার ভাবনার মাঝে টপ শব্দ করে সিলিং থেকে একটি টিকটিকি মেঝেতে পড়ে লেজ ফেলে দৌড়ে পালালো। ছেড়া লেজ লাফাতে থাকলো। আমার ভাবনার জগৎ থেকে মিলি অন্তর্হিত হলো। আমি ভাবলাম - এই যে টিকটিকির লেজটি লাফাচ্ছে, ওতে কি জীবন আছে? যদি থেকেও থাকে তাহলেও এটার কোন নিজস্ব সত্তা আছে কি? - নেই। কেন লাফাচ্ছে - তা আমি জানিনা। ডাক্তারি পড়লে হয়তো বলতে পারতাম। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার কেন যেনো  মনে হলো - মিলি আমাকে বলছে, …..পলাশ আমার জীবনটাও এই টিকটিকির লেজের মতোই। এটা শুধুই লেজ। এখন লাফাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর এটার স্পন্দন শেষ হয়ে যাবে। কারণ,  ওর মাথা সহ সম্পূর্ণ সত্তা এর থেকে অনুপস্থিত। আমারও ধরসহ সম্পূর্ণ সত্তা তোমাতে পলাশ। তোমাতে। তোমাকে ছাড়া যে আমার কোন অস্তিত্বও থাকবে না পলাশ ! তুমি যে আমার জীবনীশক্তি ! তুমি আমার জীবন ! তোমাকে ছাড়া এই মিলি যে শুধুমাত্র এই টিকটিকির খসে পড়া লেজের মতোই ! নির্জীব। জড়ো।…..

আমি ভেবেও কোন কুল পাচ্ছিনা - কেন আমি মিলিকে ভুলতে পারছিনা। কেন আমার ভাবনারা মিলিকে ঘিরে আমার অনুভূতিতে ক্যান্সারের কোষের মত ছড়িয়ে পড়ে !

গতকালের স্মৃতিগুলো মনে পড়লো। কিলবিল করে ক্ষুদ্র স্মৃতির জীবাণুরা আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে পরিব্যপ্ত করে ফেলল। আমি দেখছি ….মিলির অবিন্যস্ত চুল। উদ্ভ্রান্ত চাহুনি। কামনার পবিত্র উন্মাদনা। মিলি এগিয়ে আসছে আমার দিকে। মুগ্ধ দুটি চোখের দৃষ্টিতে আমার সম্পূর্ণ সত্তাকে আবেশিত করে। আমি চিৎকার দিয়ে বলি,

…. মিলি, এগিও না। মিলি এগিও না। যে পাপ ! মিলি যে পাপ !

না এটা পাপ নয় পলাশ!  এটা পাপ নয় ! আমি আমাকে তোমাতে সমর্পণ করবো পলাশ। এরই নাম যে ভালোবাসা ! পলাশ, এরি নাম ভালোবাসা। আমাকে নাও পলাশ ! আমি যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না ! আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।….

আমার বুকে এসে মিলি আছড়ে পড়ে। আমি মিলিকে প্রবল উন্মাদনায় জড়িয়ে ধরি। …..মিলি, কেন তুমি এমন করে আমার জীবনে এলে ! মিলি, আসবেই যদি - স্বাভাবিকভাবে আসলে না কেন? কেন তুমি আমার জীবনটাকে এমন করে দুমড়ে মুচড়ে দখল করে নিচ্ছ। আমিও তো মানুষ ! রক্তমাংসের মানুষ। অনুভূতিশীল। প্রেম পিপাসু মানুষ আমি। আমি যে আর পারছি না মিলি ! আমি যে আর পারছিনা ! তুমি আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছ মিলি। ভেঙে দিচ্ছ। খান খান করে। আমিও তোমাকে ভালোবাসি মিলি ! ভালোবাসি।….

দক্ষিণের জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। ঠিক এই মুহূর্তে বাতাসটিকে আমার কাছে বড় অসহ্য লাগছে। আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। অজানা এক উন্মাদনায় আমার শরীর পা কাঁপছে। আমি কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না। আমার ভাবনারা অনিয়ন্ত্রিত। একসাথে অসংখ্য ভাবনারা আমার এই ছোট্ট মস্তিষ্কে তাদের উচ্চকিত-মিছিলো তুলছে। আমি কি করবো। আমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে অস্থির হয়ে উঠলাম  …..না-না না....

ব্যস্তভাবে সমস্ত জানালাগুলো বন্ধ করে দিলাম আমি। …… এই ঘরে একা থাকবো আমি পৃথিবীর কোন ভাবনাকে আমি আমার ঘরে ঢুকতে দেবো না। আমি সম্পূর্ণ একা থাকবো। সম্পূর্ণ একা। আমার মস্তিষ্ককে সম্পূর্ণ ভাবনা-মুক্ত করবো আমি। আমি নিশ্চিন্ত থাকবো। সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত।….

লম্বা সোফার উপরে নিজেকে সমর্পণ করলাম। ….আহ কি শান্তি ! কি শান্তি ! অসীম শান্তি ! আমি এখন সম্পূর্ণ ভাবনাবিহীন। স্মৃতির জীবাণুরা আমার মস্তিষ্কে আর কিলবিল করছে না। পরম শান্তিতে আমার চোখ বুজে আসে। শান্তির প্রস্রবণে ভাসতে ভাসতে আমি আমার নিজেকে আকাশ পথে আবিষ্কার করলাম। আমি একটি রথে উড়ে উড়ে যাচ্ছি ! শীতল সাদা সাদা মেঘমালা আমার গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিগন্তে উড়ে যাচ্ছে। ঝাড়বাতির মত নক্ষত্রপুঞ্জ আকাশে প্রদীপ জ্বেলে জ্বেলে আমার কাছ থেকে দূরে - বহু দূরে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি এখানে সম্পূর্ণ একা। বিস্তৃত নীল আকাশ। স্বচ্ছ বায়ু। পৃথিবী এখান থেকে অনেক দূরে। আমার অস্তিত্বের নাগালের বাইরে। আমি নিরাপদ। স্মৃতির জীবাণুদের মস্তিষ্ক আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ আমি। পরম আনন্দে আমার রথের উপরে পরম বিক্রমে আমি নাচতে থাকি। আকাশের প্রান্ত থেকে প্রান্তে। আমি আমার জীবনের স্পন্দন অনুভব করতে থাকি। মহাকাশ উল্লসিত হয়ে ওঠে! আমার জীবন-সাগর আনন্দ জোয়ারে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে!

কিছুক্ষন পরে বিপরীত দিক থেকে, বহু দূরে, আকাশ আলোকিত করে এক ঝলক কুয়াশা রাঙ্গা মেঘমালার দিকে এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে উজ্জ্বল মেঘের টুকরাখানি আমার কাছ থেকে তার দূরত্ব কমিয়ে আনে। ক্রমে ক্রমে মেঘের টুকরোখানি ঘেসে আসে লাল সাদাটে গম্বুজ-সদৃশ মেঘের একটি টুকরো। গম্বুজের পাদদেশে নকশা খচিত রুপালি তোরণ। তোরণের নিচে কারুকার্য খচিত বিশাল দরজা। আমি অতি মনোযোগ দিয়ে তীক্ষ্ণভাবে দেখতে থাকি। আমার দৃষ্টির সম্পূর্ণ প্রখরতা দিয়ে আমার দিকে আসতে থাকা মেঘ-টুকরোটিকে দেখতে থাকি। লাল-সাদাটে মেঘ। মেঘের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে সুন্দর সুরম্য একটি অট্টালিকা। অট্টালিকার সম্মুখভাগে সুদর্শন একটি  রুপালি তোরণ। তোরণের নিচে কারুকার্য খচিত বিশাল দরজা।

আমার কাছাকাছি আসতেই অট্টালিকার বিশাল দরজাটি খুলে গেল। আর তক্ষণই দরজার সম্মুখভাগে আমি মিলিকে দেখতে পেলাম ! মিলি অস্থিরভাবে চেচিয়ে উঠলো….

পলাশ, আমি এসেছি পলাশ ! আমি এসেছি ! পৃথিবীতে কোথাও তোমাকে খুঁজে না পেয়ে আমি মহাশূন্যে তোমাকে খুঁজতে এসেছি। তুমি এসো পলাশ, তুমি আসো ! আমি তোমার জন্য অট্টালিকা গড়েছি !আমার স্বপ্নের অট্টালিকার মতো !এখানে আমি আর তুমি থাকবো ! আমি আর তুমি ! শুধুমাত্র আমরা দুজন পলাশ ! এসো !....

মিলির অট্টালিকা আমার রথের সামনে এসে স্থির হয়ে যায়। মিলি দুবাহু বাড়িয়ে আমাকে ডাকে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যাই মিলির দিকে। মিলির অট্টালিকায় পা রাখি। আমার রথ মিলির অট্টালিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মিলি আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি মিলির সারা দেহ-মনে আমার ভালোবাসা ছড়াতে থাকি !.....

বাইরে চড়ুই পাখিদের কাকলিতে আমার ভাবনার ছেদ ঘটে। আমি নিজেকে মহাশূন্য থেকে বাস্তবে আমার বাংলোর সোফাতে আবিষ্কার করি। আমি তখন বুঝতে পারি, সোফার উপরে নির্ভাবনার আশ্রয় নিয়েও আমি ভাবনা-বিস্মৃত হতে পারিনি। দুর্ভাবনার নির্জন কোলাহলোহীন মহাশূন্যে আমি মিলির স্মৃতি থেকে বিস্মৃত হতে পারিনি। কেন পারিনি? মিলি পেয়েছে কি ! সবসময়েই আমার মননের সর্বত্র নিজের তৈরি জাল পেতে বসে থাকে। কি তার অধিকার আমার উপরে? আমি কি মিলিকে ভালোবাসি? না না, আমি মিলিকে ভালোবাসতে পারি না। এই ভালোবাসা পাপ ! পঙ্কিল ! আমার সম্মুখে আমি মিলির দেয়া সব সামগ্রী দেখতে পাচ্ছি। মিলির দেয়া উপহারগুলো আমার সম্মুখে স্মৃতির জাল বিস্তার করে বসে আছে। আমি এসব কিছু পরিহার করব। একটা একটা করে সবকিছু আমার ঘর থেকে সরিয়ে ফেলবো। মিলি আমার ভালোবাসা পেতে পারে না। আমার উপরে তার কোন অধিকার নেই। ক্রোধে আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। আমি দ্রুতপদে মিলির দেয়া সমস্ত সামগ্রীতে হাত লাগাই। ঘরের প্রান্তে প্রান্তে সবকিছু ছুড়ে মারি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ঘরটিকে আমি ছড়ানো ছিটানো গুদাম-ঘরে পরিণত করে ফেলি। আমার গা ঘামতে থাকে। গায়ের চামড়ার সাথে গেঞ্জি লেপ্টে যেতে থাকে। ছড়ানো ছিটানো জিনিস গুলোর উপরে আগুন দৃষ্টিতে আমি মিলির উপহারের ধ্বংসস্তূপ দেখতে থাকি।

….পলাশ ! একি, কি হচ্ছে এসব ! তোমার কি হয়েছে পলাশ? তুমি এমন করছ কেন?....

মিলি বিহবল দৃষ্টিতে ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। মিলির পরনে লাল শাড়ি। কপালে টিপ। মাথায় ঘোমটা। চোখ জুড়ে অনেক মায়া। আদুরে-আদুরে চেহারা। মিলি তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। মায়া ছড়িয়ে। আমি অনুভব করি, মিলির মায়ার গতিশীল প্রস্রবণে আমার মনের সমূহ ক্রোধ ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। এক সময়ে আমি বুঝতে পারি, মিলির জন্য আমার মায়া হচ্ছে। আমি মিলির দিকে এগুতে থাকি। মিলিকে ছুঁয়ে ফেলি। উস্ফুট কন্ঠে উচ্চারণ করি, ….আই লাভ ইউ মিলি ! আই লাভ ইউ !....

মিলি আমার হাত ধরে আদুরে কন্ঠে বলে

এসো। আগে বসো। শান্ত হও। বসো, এখানে বসো।….

মিলি আমাকে সোফায় নিয়ে বসিয়ে দেয়। তারপর গার্ডিয়ান-সুলভ কন্ঠ চরিয়ে বলে….

বলো, ব্যাপার কি?

কোন ব্যাপার?

এই যে ! জিনিস-পত্র ছড়ানো ছিটানোর ব্যাপার ! আর তাও দেখছি যে - তুমি শুধুমাত্র আমার দেয়া জিনিসগুলোই বেছে বেছে ফেলেছো। ফেলেছো কেন?

তুমি আজ অফিসে আসোনি কেন?

তাই ! পাগল লক্ষীটি ! স্মরণ আছে কি? গতকাল কেমন একটা বিপদ গেছে আমার উপর দিয়ে?

তাতে কি?

তাতে আর কি ! জ্বর করেছিলো। মাথাটাও প্রবলভাবে ধরেছিলো। চার-চারটে এসপিরিন খেয়ে এরপরে এখানে এলাম। মন মানছিলো না। আর ইদানিং তোমাকে এক নজর না দেখলে বুকটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা লাগে। তাই খারাপ স্বাস্থ্য নিয়েও চলে এলাম।

তাই? এসেছো বেশ? এমন সুন্দর করে সেজে আসার মানেটা কি?

তোমার জন্য সেজেছি ! তুমি যে সাজগোজ পছন্দ করো !

আমার পছন্দ বলেই কি তুমি তাই করবে?

কেন নয়? আমার এই মন - এই দেহ - সবই তো তোমার! তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলা বা রাখার অধিকার তো আমার নেই !

তাতো বুঝলাম। একেবারে এমন বধু সেজে যে ! ব্যাপার কি?

তোমার বউ হব বলে। আমার আর ভালো লাগে না। আজই তোমাকে সালাম করে যাবো।

তারপর?

তারপর কি? আমি সম্পূর্ণ তোমার এবং শুধুই তোমার !

তারপর?

তারপর কি?

কেন? আর কি কিছু চাওয়ার নেই?

অসভ্য ! ফাজলামো রাখো।…..

মিলির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য উঠে দাঁড়ায়, বলে....

পলাশ, তুমিতো চা খাবে। আমি স্টোভে চা বসিয়ে দেই। এবং চা হতে হতে জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে ফেলি। যা করার তো করেছোই। বাবা ! বিয়ে না হতেই এত আদর ! বিয়ের পরে কেমন করবে !....

এক টুকরা পবিত্র হাসিতে মিলির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মিলি চা বসানোর জন্য উঠে দাঁড়ালো।

মিলি

হু

শোনো

কি

এদিকে আসো না একটু

কেন, বলো না

আসবে তো আগে ! তবে তো বলবো

না আগে বলো

আমি আমার হাতের তালুতে চুমু খেয়ে মিলিকে দেখাই

না, আমার লজ্জা লাগে

ধুর ছাই ! লজ্জা কিসের ! ….আমি উঠে দাঁড়াই। দু বাহু দিয়ে মিলিকে বেষ্টন করি। মিলির সারা মুখে ভালোবাসার চুম্বন আঁকি।…..

মিলি

হু

আমি যদি তোমার জীবন হতে কখনো সরে দাঁড়াই?

মিলি আঁতকে ওঠে। হাতের তালু দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে। ধরা গলায় ছোট্ট করে বলে...

যা ! এসব বলে না….

মিলি নিজেকে আমার বাহু থেকে ছাড়িয়ে নেয়। কেটলিতে পানি ভরে স্টোভে চাপায়। কটিতে আঁচল পেঁচিয়ে আগোছালো ঘরখানা সাজাতে থাকে।

আমার গত দিনের ঘটনাটি মনে পড়লো। ওই দিনও মিলি কেটলিতে চা চাপিয়ে ছিলো। চায়ের পানি বকবক করে ফুটছিলো। মিলির মনে একটা আদিম ইচ্ছে টগবগ করতে করতে মিলিকে আদিম করে দিতে চেয়েছিলো। অবিন্যস্ত চুল। বেসামাল পরিচ্ছদ। নেশাগ্রস্ত চাহনি। কামনাময়ী অধর। সাদা শাড়ি লাল স্লিভলেস ব্লাউজ। অর্ধ-নগ্ন মিলিকে তখন আমার স্বপ্নের ইভ বলে মনে হচ্ছিল। আমি একসাথে গতকাল এবং আজকের মিলিকে পাশাপাশি দার করিয়ে দেখতে থাকি। গতকালের কামনাময়ী আজকের স্নেহময়ী বধু। লাল বেনারসি দিয়ে সমস্ত শরীর খানাকে পরিপাটি করে সাজানো। সুরমা আঁকা চোখ। লজ্জা রাঙা অধর। কপালের লাল টিপ - সবকিছু আমাকে মিলির দিকে আকর্ষণ করতে থাকে। আমি মিলির দিকে তাকিয়ে থাকি। অবিরাম। অপলক। মিলি কাজ করার এক ফাঁকে আমার দিকে তাকায়। লজ্জা-রক্তিম হাসিতে শাসন মিশিয়ে মিষ্টি করে আমাকে ধমকে ওঠে....

এই ! হচ্ছে কি....

আমি কিছুই বলি না। বলতে গিয়েও মুখ দিয়ে কিছুই বেরোয় না। আরো মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমি মিলির দিকে তাকিয়ে থাকি। দুষ্ট হাসি নিয়ে মিলি আমার দিকে এগিয়ে আসে। মাথা নিচু করে আমার মুখের কাছে মুখ আনে….

হারে সাহেব, এতক্ষণ চুরি করে দেখেও কি আপনার স্বাদ মেটেনি?

আমি হাসি। মাথা নাড়ি।

না মেটেনি

কি বেহায়া রে বাবা ! একটু লজ্জাও নেই !....

মিলি খিলখিল করে হাসে। দুহাতের তালু দিয়ে আমার চোখ দুটোকে ঢাকে। আমি মিলির হাত ধরি। বলি

মিলি বসো…..

মিলি আহলাদি কন্ঠে বলে ….

না গো, জিনিস-পত্রগুলো গুছিয়ে রাখি

রাখতে পারবে। সময় পড়ে যায়নি তো….

মিলি আমার পাশে বসে। চোখে চোখ রাখে….

বলো, কি বলবে

আমি মিলির জন্য প্রবল মায়া অনুভব করি। ধরা গলায় বলি …. মিলি গতকাল তোমার মনে খুব কষ্ট দিয়েছি। না?...

মিলি আমার এরকম প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি হয়তো। একটা অবমাননাকর লজ্জা মিলির সমস্ত মুখে ছেয়ে যায়। চাপা কন্ঠে দুঃখ মিশিয়ে বলে...

গতকালকের প্রসঙ্গটা টেনে এনে আমাকে আর লজ্জা দিও না পলাশ! ওটা আমার ক্ষণিকের ভুল। ভুল যখন ভাঙলো, তখন আমি বুঝলাম - কি সর্বনাশটাই না করতে যাচ্ছিলাম আমি ! আমাকে ক্ষমা করো পলাশ,  আমাকে ক্ষমা করো।…..

মিলি প্রবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। দুহাতে মুখ চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। আমি মিলির শরীর ঘেঁষে তার মাথায় হাত রাখি...

মিলি, ওটা তোমার ভুল নয়। ওটা যে ভালোবাসার অভিব্যক্তি। কেঁদো না। দেখি আমার দিকে তাকাও !.... চোখের উপর থেকে আমি মিলির হাত দুখানা সরিয়ে আনি। সজল দুচোখে মিলি আমার দিকে তাকায়। ডুকরে কেঁদে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।….

পলাশ ! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না পলাশ। ভালোবেসে যে কি কষ্ট  ! তা তুমি বুঝবে না, তা তুমি বুঝবে না !...

আমি প্রচন্ড শক্তি দিয়ে মিলিকে জড়িয়ে ধরি। আমার ঘাড়ে মুখ রেখে মিলি ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে থাকে। এবং ধীরে ধীরে এক সময়ে শান্ত হয়ে ওঠে। আমি দুহাতের তালু দিয়ে মিলির মুখখানা কে আমার মুখের সামনে ধরি। জ্যোৎস্না-স্নাত মায়াবী একখানা মুখ। টিকালো নাক। কম্পিত অধর। মায়াবী চোখ। আমি মিলির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার মনে হলো - মিলির চোখ দুটো আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছে। আমি মিলির চোখের ভাষা পড়তে থাকি এবং সে ভাষার আবেদন বুঝতে পারি। আমার ঠোঁট দুটো মিলির ঠোঁট দুটোর দিকে এগুতে থাকে এবং এক সময়ে মিলির ঠোঁট দুটোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চার ঠোঁটের মিলন হতে থাকে।

মিলির চেতনা ফিরে আসে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। মিষ্টি ভেজা কন্ঠে শিউরে ওঠে...

লাগে তো !

মিলি

হ্যাঁ

পূর্ণিমা রাতের চাঁদ দেখেছো কখনো?

হ্যাঁ

প্রকাণ্ড, উজ্জল, পূর্ণ

হ্যাঁ দেখেছি

আমাদের গ্রামের বাড়িতে বোশেখের গরম রাত্রে উঠোনে শীতল পাটি বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে পূর্ণিমার ভরা চাঁদ দেখতাম !

তারপর?

দেখতাম, রুপালি চাঁদ - ফর্সা, ধবধবে। সে রাতের চাঁদ দেখে দেখে আমার মোহ ধরে যেতো। কেন যেনো  আমার মনে হতো - ওটা চাঁদ নয়, ওটা একটা জীবন্ত কুমারী ! পূর্ণযৌবনা-ঋতুবতী জীবন্ত কুমারী। উদ্ভিন্ন নারী রূপের ডালি সাজিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে !

তারপর?

আমার সর্ব শরীরে একটা অজানা মোহ ধরে যেতো। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম, আর সেই কুমারী মানবীকে কল্পনা করতাম !

তারপর?

এক সময়ে অনুভব করতাম - কুমারী আমার বুকের সাথে বুক লাগিয়ে ঠোটে ঠোট রেখে আমার ভালোবাসার সিন্ধুতে কামনার ঢেউ জাগাচ্ছে। তখন আমার সমস্ত শরীর অজানা উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে চঞ্চল হয়ে উঠতো। আমি কুমারীটিকে পাওয়ার জন্য সারারাত ধরে ছটপট করতাম !

তারপর?

তারপর, বহু বছর পরে ঠিক এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে - আমার স্বপ্নের কুমারী আমারই সম্মুখে আমার চোখের সামনে আমার ঠোঁটের সাথে ঠোঁট রেখে আমার সাথে কথা বলছে।

সত্যিই !

শুধু সত্যি নয় মিলি। চাঁদ কুমারী ভালোবাসার সিন্ধুতে কামনার যে ঢেউ জাগিয়েছিলো - আজ সাক্ষাতে তা ফুলে ফেঁপে দুকুল ছাপিয়ে চলছে।

পলাশ !

হ্যাঁ

তুমি আমাকে এত ভালোবাসো !

এটা তোমারই যোগ্যতায় মিলি !

আমার জীবন সুধা-রসের ষোলো কলায় পূর্ণ করেছো পলাশ ! তোমার এই ঋণ কি দিয়ে শোধ করবো পলাশ!

ভালোবাসা দিয়ে মিলি। আমিও মানুষ। রক্তে মাংসে গড়া ভালোবাসা-কাঙ্ক্ষিত একজন মানুষ !

তাইতো দিয়েছি পলাশ ! আমার ভালোবাসার সর্বস্বইতো তোমাকে দিয়েছি। তাইতো লোক নিন্দার উপেক্ষা করে প্রতিদিন তোমার কাছে ছুটে আসি। তোমার একটু ভালোবাসা, একটু আদর, একটু পরশ পাবো বলে!

মিলি, তোমাকে যে আমার প্রবলভাবে ভালবাসতে ইচ্ছে করে !

বাসোনা পলাশ ! আমাকে তুমি প্রবলভাবে ভালোবাসো ! আমার হৃদয়-নদী শুকিয়ে ভালোবাসার সুধা রসের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। তুমি ভালোবাসা  দিয়ে তার দুকুল ভাসিয়ে দাও পলাশ, দুকুল ভাসিয়ে দাও!

চলনা মিলি, আমরা সয্যাটির উপরে গিয়ে পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসা দিয়ে জীবনকে জয় করি?

না পলাশ। আমাদের পবিত্র ভালোবাসা তাতে কলঙ্কিত হবে।

তা নয় মিলি,  তা নয়। তোমার সে ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যে। কারণ সেটা যে ভালোবাসার ভিন্ন রূপ। সেটাকে আমরা অস্বীকার করবো কেমন করে?

তা আমাদের অস্বীকার করতেই হবে পলাশ ! কারণ এটা যে সামাজিক নিয়ম। আমরা কি সমাজকে অস্বীকার করতে পারি?

তা পারি না মিলি। কিন্তু ভালোবাসাটা যে ঐশ্বরিক - আমরা কি ভালোবাসার চিরন্তন ধারায় বয়ে যাব? -  নাকি সামাজিক রীতির বিরস ধারায় আটকে থাকবো?

পলাশ !

মিলি, হৃদয়ের টান সামাজিক শৃংখল এর চাইতে দৃঢ় মিলি। তাইতো ভালোবাসার কাছে সামাজিক অনুশাসন হেরে যায় !

পলাশ

আসো না মিলি, দুজনে পরস্পর পরস্পরে নিহিত হয়ে ভালোবাসার গান গাই !

পলাশ আমাকে শক্ত করে ধরো। আমি যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

মিলির ঠোঁট থেকে আমার দুঠোট বিচ্ছিন্ন হয়ে এলো। আমি মিলিকে জড়িয়ে ধরে একটা উদ্দিষ্ট স্থানের দিকে এগুতে থাকি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মিলি বলে

পলাশ দাঁড়াও, আমি তোমাকে সালাম করে নেই

কেন মিলি?

সে উত্তর শুনতে চেয়ো না স্বামী

মিলি নিজেকে সংযত করে। শাড়ির আঁচল টেনে মাথার উপরে লম্বা করে ঘোমটা টানে এবং মাথা নুইয়ে দুহাতে আমার পা ছুঁয়ে আমাকে সালাম করে। আমি দুই হাতে মিলিকে তুলে নেই এবং প্রবলভাবে বুকে চেপে রাখি। আমার পৃথিবীটা ধীরে ধীরে ছোট্ট হয়ে আসে এবং ছোট্ট হতে হতে এক সময়ে শুধু আমাতে এবং মিলিতে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। মিলি ধীরে ধীরে শয্যার দিকে এগিয়ে যায়। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আমাতে সমর্পণ করে। লজ্জায় আরষ্ট হয়ে দুহাতে শক্ত করে নিজের চোখ দুটোকে আবৃত করে রাখে।

বিবসনা মিলির মাখন-কোমল দেহের স্ফুরিত সৌন্দর্য আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় কাঁপিয়ে অনুভূতির প্রান্ত হতে প্রান্তে শিরশির করে বয়ে যায়। আমার সমস্ত দৃষ্টিতে এক আশ্চর্য মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে। আমি মুগ্ধ বিহবল দৃষ্টিতে অসাড় পদে মিলির দিকে এগিয়ে যাই এবং মিলিকে কামনার দূরবীন দিয়ে খন্ড-বিখন্ড করে দেখতে থাকি। আমার চঞ্চল কম্পমান হাত দুটো মিলির যৌবন উপন্যাসের পাতাগুলোকে একটি একটি করে উল্টোতে থাকে। আমার মস্তিষ্কে কামান্ধ আদিম প্রবৃত্তির নেশা বুদবুদ করে উঠতে থাকে। মিলির তপ্ত বুকের লোভে আমি উন্মাদ হয়ে পড়ি। টলতে টলতে যৌন উপাখ্যানের শেষ অধ্যায়ে মেতে উঠতে প্রস্তুত হতে থাকি। ত্রুদ্ধ ষাঁড়ের মতো বিশাল দেহটাকে খাটের উপর স্থাপন করে মিলির উত্তঙ্গ আবেদনময়ী দেহবল্লরীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার পাশবিক উন্মত্ততার প্রচন্ডতায় সম্পূর্ণরূপে পশু হতে থাকি !

আমার দেহের নিচে পিষ্ট হতে হতে মিলি উত্তেজিতা হয়ে ওঠে। মিলি হাত দুটো চোখের উপর থেকে সরিয়ে নেয়। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কোঁকাতে থাকে মিলি।…. ক্ষণিকে আমি শিউরে উঠি। আমার কামান্ধ মস্তিষ্কের কোণে একখণ্ড স্মৃতির টুকরো নিবু নিবু করে জ্বলতে থাকে এবং এক সময়ে পরিপূর্ণ দ্যুতি নিয়ে সবিদ্রোহে জ্বলে ওঠে। অতি পরিচিত একটি অব্যক্ত যন্ত্রনার কাঁকুনির স্মৃতির উন্মোচন হয়ে আমার মস্তিষ্কের পথপ্রান্তর ধুলায়িত করে প্রচন্ড এক ঝড় তোলে। সেই ঝড়ে আমি দুহাত দিয়ে অন্ধের মত কিছু একটা হাতড়ে মরি। আমার চেতনার রাজ্যে অন্ধকার বিভীষিকাময় অবচেতন মনের ছোট্ট কোণে এক টুকরো মুখ ভাসতে ভাসতে আমার চেতনার নব-জন্ম দিয়ে আমৃত্যু তার অধিকারের দাবি নিয়ে সশব্দে চিৎকার করে ওঠে...

পলাশ ! একি করছো পলাশ ! একি করছো ! তুমি যে আমার পলাশ - তুমি যে সম্পূর্ণ আমার !...

প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে আমি শিউরে উঠি। মিলির দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খাটের নিচে ছিটকে পড়ি। আহত ক্রূদ্ধস্বরে আমার কন্ঠের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠি...

নো নো ! ইট ইজ ইম্পসিবল মিলি, ইট ইজ কোয়ায়েট ইম্পসিবল ! এক্সকিউজ মি মিলি, এক্সকিউজ মি...

নিজেকে সামলে নিয়ে খাটের কোনা ধরে আমি উঠে দাঁড়াই। আহত ক্লান্ত যোদ্ধার মতো হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে ব্যালকনিতে এসে রেলিং ধরে দাঁড়াই। আমার মস্তিষ্কের সর্বত্র জুড়ে ঝড়ের প্রবল শব্দ শুনতে পাই আমি। সে ঝড়ের অমানিশার অন্ধকারে বিবেকের প্রদীপ দিয়ে আমি আমার হারানো স্মৃতির মালাখানি খুঁজতে থাকি। আমার স্মৃতির প্লাবনের স্রোতের মধ্যে আমি নিজেকে ভাসিয়ে নিতে থাকি। স্মৃতির সাগরে ভাসতে ভাসতে আমি আমার জাগ্রত আত্মার মাঝে পরম আবেগ ভরে আমার মানসীকে খুঁজে পাই এবং মুখে হাত চেপে অসহ্য বেদনায় কেঁদে উঠি। আমার অশ্রুর প্লাবনে আমাদের মধ্যকার ঝাপসা পথ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হতে থাকে। আমি আমার মনের চোখ দিয়ে আমার মানসীকে শোক-বিহবল দৃষ্টিতে দেখতে থাকি..

….পলাশ

কে ! কে তুমি?

…..আমি শিউরে উঠি। পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রেখে বিহবল মিলি বলে....

আমি মিলি, পলাশ ! হয়তো তোমার জীবনের অভিশাপ !

মিলি, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি ! গো এওয়ে ! আই কান্ট টলারেট ইউ ফর এনি লঙ্গার ! প্লিজ ! গো এওয়ে। প্লিজ! গো এওয়ে!

চলে যাচ্ছি আমি পলাশ, চলে যাচ্ছি আমি। এত চেষ্টা করেও তোমার ভালোবাসার তল আমি খুঁজে পেলাম না পলাশ ! খুঁজে পেলাম না ! তাই আমি তোমার  কাছে ক্ষমা চেয়ে আমার ভালোবাসাকে অপমান করতে চাইনা। আমি চলে যাচ্ছি, আর কোনদিন যেচে এসে তোমার কাছে আমার ভালোবাসার প্রতিদান চাইবো না। আমার ভালোবাসা যে আমার নিজের চাইতে সুন্দর ! আমার আত্মার চাইতেও আমি যে তাকে বেশি শ্রদ্ধা করি ! আমি আমার ভালোবাসাকে অপমান করতে দেবো না পলাশ ! সে ভালোবাসা যে তোমাকেই সমর্পিত ! সৃষ্টিকর্তার সাধ্য নেই - তোমার সিংহাসন থেকে তা কেড়ে নেয় !

ওহ ! মিলি আমাকে আর জ্বালাতন করোনা মিলি ! আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও ! তুমি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও ! আর কখনো বাংলোতে পা বাড়াবে না ! প্লিজ ! তুমি চলে যাও !....

পরম আক্রোশ এবং ক্রোধে আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। আমার সম্মুখের সমস্ত পৃথিবীটাকে নির্জীব বলে মনে হয়। বাইরের জগতটাকে আমার অসহ্য লাগে। আমি ভেতরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ি। মিলির কন্ঠ আবারো ককিয়ে ওঠে....

পলাশ ! আমি এক্ষুনি চলে যাব। যাবার আগে একটি মিনতি শুনবে? তোমার মুখটা একবার আমাকে দেখতে দাও ! আমি প্রান ভরে একবার দেখে যাই !

ওহ মিলি ! গেট আউট প্লিজ ! গেট আউট ! আই হেট ইউ ! আই হেট ইউ !....

 

মিলি চলে গেলে দ্রুতগতিতে বাংলোয় ঢুকে আমি দরজা বন্ধ করে দেই। বাইরের পৃথিবীটা আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমি নিজেকে একাকী ফিরে পাই। দরজার চৌকাঠের উপর নিজের দেহের পূর্ণ ভার দিয়ে আমার মিলির মাঝের শক্ত দেয়ালটাকে আরো শক্ত করতে করতে আমি ভীষণ হাঁপিয়ে উঠি। এবং অবশেষে ক্লান্ত অবশ দেহটিকে মেঝেতে স্থাপন করে রক্তাক্ত স্মৃতির আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকি। নিমেষে আমার চেতনায় আমার মানুষীর ভালোবাসার সপ্ত রং ছড়িয়ে পড়ে। আমি তখন পরম যত্নে, পরম আবেগে আমার মানসীকে স্মরণ করি!

ধীরে ধীরে আমার শরীর-মনে হারানো শক্তি ফিরে আসে। আমি উঠে দাঁড়াই এবং ধীরে ধীরে আলমারিটার কাছে এগিয়ে যাই।

আলমারির একটি ড্রয়ার থেকে আমি পারিবারিক অ্যালবামটি হাতে তুলে নেই এবং অ্যালবামটির প্রথম পাতাটি আমার চোখের সামনে উল্টে ধরি।

সূর্যমুখীর মতো অপরূপ স্নিগ্ধতা নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শেফালী হাসছে।

বিজয়ের বেশে শেফালী যেনো  বলছে ….পলাশ আমি জানতাম, তুমি আমাকে কখনো ভুলে থাকতে পারবে না।….

শেফালী আরো মিষ্টি করে হাসছে যেনো আমি শেফালির ছবিখানা বুকের মধ্যিখানে চেপে ধরি। বহুদিন পর আমি আমার শেফালির পরশ পাচ্ছি। পবিত্র এক অনুভূতি আমার সমস্ত শরীর জুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে….

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই

50

Blogger দ্বারা পরিচালিত.