Header Ads

উপন্যাস:সুপ্রিয়া প্রিয়তমা: পর্ব তিন - সবুজ শোভা

  পড়ুন উপন্যাস:  সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব তিন - সবুজ শোভা (ছবিটির নিচে)


নিবেদন: উপন্যাসটির সময়কালের প্রেক্ষাপট

আশির দশকের প্রথম ভাগ। তখন মোবাইল ফোন আসেনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিফোনও ছিল না। তখন চিঠির মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতো সবাই। আর গ্রাম-গঞ্জে পাহাড়ি অঞ্চলে বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল না। এরকম সময়-পরিবেশে যাপিত জীবনের কল্পকাহিনি  নিয়ে গড়া উপন্যাসটি। আশির দশকের সময় পরিবেশ অনুধাবন করে উপন্যাসটির সকল পর্ব পড়তে থাকলে নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে। এটি তৃতীয় পর্ব।  প্রথম পর্ব থেকে পড়ার অনুরোধ রইলো।


উপন্যাস:সুপ্রিয়া প্রিয়তমা: পর্ব তিন - সবুজ শোভা

 

অফিসে বসে জানালা দিয়ে দক্ষিনে তাকালেই রাস্তার দুই ধারে ইউক্যালিপটাস গাছ গুলোকে দেখা যায়। লম্বা লম্বা গাছ। সোজা। স্বল্প শাখা। দুরন্ত বাতাসে ইউক্যালিপটাস-চূড়ার ডাল-পালা-পাতাগুলো যখন নাচতে থাকে, তখন মনে হয় - ইউক্যালিপটাস গাছগুলো বাতাসে ভর করে পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে শুণ্য আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে ! কল্পনার ইউক্যালিপটাস পাখিগুলোকে তখন সাদা পালক-খচিত উড়ন্ত পাখির চাইতেও সুন্দর দেখায়!

ইউক্যালিপটাস গাছের সারির দক্ষিনে আমার বাংলো। কাঠের মোটা পিলারের উপরে বানানো বাংলো। কবুতরের খোপের মত। ওপরে টিনের চাল। চালের চতুর্দিকে নকশা-কাটা ঝালর। চারদিকে ঝুলানো ব্যালকনি। বাংলোর চতুর্দিকে প্রশ্বস্থ লনে সবুজ ঘাসের আস্তরণ।

টেবিলে একগাদা ফাইলপত্র জমে আছে। ওভারশিয়ার ডাইরি, মাস্টার রোল, স্টক বুক, ইনভয়েস অব আর্টিকেল,  ক্যাশ বুক, কাল্টিভেশন রেজিস্টারআরো অনেক ফার্ম রেজিস্টার। সবগুলো পরীক্ষা করে সই দিতে হবে। একাউন্ট্যান্টএর রেখে যাওয়া ফাইলগুলোতে সই না করলেই নয়। কাজগুলো এগারোটার মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে। এরপরে ফার্ম ইন্সপেকশন।

হর্টিকালচার বোর্ডের সাইট্রাস প্রোজেক্টের ফার্ম। মোট চারটি ফার্ম নিয়ে প্রজেক্ট। পূবের দুটি পাহাড়ের তিনটি ফার্মে কমলালেবু এবং পশ্চিমের পাহাড়টিতে লেবু বাতাবি লেবুর চাষ। কমলালেবুর দুটি ফার্মে বছর প্রোডাকশন নামবে। বাকি ফার্ম টিকে সাজানো হচ্ছে। কাজ এগোচ্ছে।

রাজধানীর স্পেশালাইজড এগ্রি কলেজ থেকে পাস করার পর দু'বছরের ফেলোশিপ করি। এরপর এখানেই সরাসরি চাকরি। এর আগের ম্যানেজার অন্য জায়গায় বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। নতুন চাকরি। দায়িত্বই নিয়ে এখানে এলাম। জায়গাটিকে মনের কাছে খুব ভালো লেগে গেলো।

পূবে পাহাড়। পশ্চিমে পাহাড়। মাঝখানে টিপটপ গোছের সুন্দর অফিস। সবকিছু মিলিয়ে জায়গাটিকে! স্বপ্নপুরী বলে মনে হলো আমার কাছে। প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে মনোনিবেশ করি কাজে। কি অফিসটাইম - কি অফ টাইম ! সবসময়ই ডুবে থাকতাম কাজের মাঝে। চোখের আলো প্রভার সবটুকু জুড়ে একটা আসার দ্যুতি মিট মিট করে জ্বলতো - কবে ফার্মগুলো কে প্ল্যান অনুযায়ী সুন্দর করে সাজাতে পারবো! সাকসেসফুল প্রোডাকশন দেখিয়ে কর্তৃপক্ষের প্রশংসা কুরাবো! চাকরিতে প্রমোশন পাব! এবং আরো বড় হবো!

তিন চার মাস পর পর ঢাকা থেকে বড় সাহেব আসতেন কাজের অগ্রগতি দেখতে। দু বছরের কাজের আশাতীত সাফল্য দেখে খুশি হলেন তিনি। আরও একটি নতুন ফার্মের প্লান পাশ করলেন। আরো পরে চতুর্থ ফার্মটির জন্য টাকা বরাদ্দ করলেন।

প্রজেক্টটির পুবের দুটি পাহাড়ের তিনটি ফার্মে কমলালেবুর চাষ করা হচ্ছে। ফিউট্রেলস আর্লি, কিনো নাছ। এবারের ডিসেম্বর থেকে ফিউট্রালস আর্লি কিনো ফার্মে প্রথমবারের মতো প্রোডাকশন নামবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাষট্টি লক্ষ। বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা বত্রিশ লক্ষ টাকা। পরের বছরগুলোতে ক্রমে ক্রমে প্রোডাকশন বাড়বে। চারটি ফার্মের পুরা প্রোডাকশন নামলে আয় দাড়াবে বার্ষিক এক কোঠি বিশ লক্ষ টাকায়।

অফিসের পেছনে দুই একর সমতল ভূমি। সবটুকু জুড়ে নার্সারি। বর্ম চোখ কলম, দাবা কলম গুটি কলম দিয়ে অযৌন পদ্ধতিতে চারা করা হচ্ছে। চারাগুলো বড় হলে নতুন ফার্মগুলোতে রোপন করা হবে। নতুন ফার্মগুলোতে ল্যান্ড পিপারেশন পিট্-ডিগিং এর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।

অফিসের দরজার পর্দা ঠেলে মাহবুব এসে সামনে দাড়ালো। মাহবুব অফিসের পিয়ন। বাড়ি যশোর। নিরীহ, বিনয়ী। বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে। ব্যস্ত কন্ঠে বললো, ….

স্যার, এক ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করতে চান

ভদ্রমহিলা! মনে মনে শিউরে উঠলাম। গত চার বছরের চাকুরী জীবনে আমার অফিসে কোন মহিলার পদচারণা হয়নি। বুকের ধুপ-ধাপ শব্দটিকে বাইরে প্রকাশ করতে না দিয়ে বললাম,…. ঠিক আছে আসতে দাও….

মাহবুব দরজার পর্দা তুলে ধরতেই মহিলাটি ভেতরে এলো। মহিলা বললে ভুল হবে। মহিলা শব্দটি বেশি বয়সী নারীদেরকেই বোঝায়। আগন্তুক একজন বাইশ তেইশ বছরের তরুণী। তরুণীটি দরজা পেরিয়ে দু এক পা এগিয়ে আমার দিকে তাকাতেই থমকে দাঁড়ালো যেনো। সৌজন্যতা দেখাতে দাঁড়িয়ে গেলাম। তরুণীটি সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। টানা টানা পটল চেরা চোখ। চোখের কোনে সুরমার আলপনা। বাঁকা চাঁদের মতো কাজল ভ্রু। প্রশস্ত কপাল। সরু নাক। পাতলা-সতেজ রক্ত রাঙ্গা ঠোঁট।

তরুণীটির এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কেমন যেন অসঙ্গত মনে হলো আমার কাছে। কি যেন একটা কিছু বলতে এসে সবকিছু ভুলে গেছে তরুণীটি। তরুণীটি কি আমাকে দেখে ভড়কে গেছে? আমাকে কি তার কাছের কারুর চেহারার মানুষ বলে মনে হয়েছে? নাকি অন্য কিছু? হয়তো ভেবেছে, আমার বয়স একটু বেশি হওয়ার কথা ছিল - তার কল্পনার চাইতেও আমাকে তার নবীন মনে হয়েছে। অথবা বসকে তো সবাই একটু ভয় পায়।  তার বেলায়ও হয়তো এমনটি হয়েছে। সবটাই হতে পারে। কোনটা যে সঠিক, তা বোঝা বড়োই কঠিন।  এমনটিই হয়। মুখে একটু হাসির রেশ টেনে সামনের চেয়ারটি দেখিয়ে বললাম, ….. আসুন! দাঁড়িয়ে কেন?

তরুণীটি ধীর পায়ে এগুলো। চেয়ারটিতে বসলো। ভ্যানিটি ব্যাগটি কোলের উপর রেখে আমার দিকে আর একবার তাকালো। এবং পরে টেবিলে দৃষ্টি স্থির করে চুপ করে বসে রইলো। মনে হলো, যা কিছু বলতে এসেছিলো সব কিছু বলা হয়ে গেছে! এবারে আমার মতামতের অপেক্ষায় বসে সে! …..

মনে কিছু নেবেন না। আপনাকে কিন্তু চিনতে পারিনি.... নিরবতা ভেঙ্গে তরুণীটিকে বলি আমি।

মাথা তুলে আমার দিকে তাকায় তরুণীটি। দাঁড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করে.....

আই এম সরি স্যার! স্লামালিকুম।সালাম দিয়ে তরুণীটি দাঁড়িয়ে থাকে। গোল মুখমণ্ডল। চিক্কন চিবুক। লম্বাটে গড়ন। আলতা-রঙা শরীর। মাথাটিকে সামনে ঝুঁকিয়ে শব্দ না করে সালামের উত্তর নিলাম। বললাম, …. বসুন

চেয়ারে বসলো তরুণীটি। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে লম্বা একটি খাম বের করলো। খামের ভেতর হতে একটি কাগজ বের করলো। এবং কম্পিত হাতে  আমার দিকে এগিয়ে দিলো। কাগজ খানা হাতে নিয়ে সবকিছু বুঝে গেলাম। কাগজের  নিচে বড় সাহেবের সিল-যুক্ত সই। এটি একটি এপোয়েন্টমেন্ট লেটার। তরুনীর নাম মিলি তরফদার। সহকারি উদ্যানতত্ত্ববিদ।

সানন্দে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলাম, …..

ওহ! কনগ্রাচুলেশন্স মিস তরফদার!

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার! …একটু হাসলো মিস তরফদার।

….তা আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো?..

জিনা স্যার

কোন সাবজেক্টে পাশ করেছেন?

বোটানি

কোন ইয়ারে?

বছরেই স্যার

অ্যাপোয়েন্টমেন্ট হয়েছিলো কবে?

মাস দুয়েক আগে। দুমাস ঢাকাতেই ছিলাম। ট্রেনিং প্রোগ্রামে।

ওহ! ট্রেনিং কমপ্লিট করে এসেছেন! ভালোই হলো। এখানে কিন্তু ঢাকার মতো বিদ্যুৎ নেই। তাই ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। অসুবিধা হবে নাতো?

একটু অসুবিধেতো হবেই স্যার। তবে পুষিয়ে নেয়া যাবে।

ট্রেনিং কজন ছিলেন আপনারা?

মোট আটজন ছিলাম আমরা। ট্রেনিং শেষে আটজনকে আট জোনে পোস্টিং দিয়েছে।

একটু ইতস্তত করে বললাম, বড় সাহেব কি কিছু বলেছিলেন এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে?

এখানকার পরিস্থিতি?.... মিস মিলি একটু ভয় পেলো যেন….

আরে না, ভয়ের কিছুই নয়। এই মানে.. কোন মহিলা অফিসারের পোস্টিং হবে ভাবি নি। তাই আপনার থাকা খাওয়ার ব্যাপারে ....

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। সে ব্যাপারে আপনার ভাবতে হবে না স্যার। আমাদের বাড়ি নিকটেই। বাজারের একটু পশ্চিম পাশে। এসে গিয়ে অফিস করতে পারবো।

একটু লজ্জিত হলাম। পরিচয় এর শুরুতেই তার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। মুখে আক্ষেপের ভাব এনে বললাম,….

ফাইন! তাহলে তো ভালো চাকুরীই ম্যানেজ করলেন আপনি। ফ্যামিলির সবার সাথে থাকা হলো। চাকরিও করা হলো। ফাইন! ফাইন!

মিস মিলি হাসলো শুধু। টেবিলে রাখা ফাইলগুলোর উপর একবার লম্বা করে চোখ বুলালো। আমিও ফাইল গুলোর দিকে তাকিয়ে বললাম, …. মিস মিলি, একটু সময় আপনার কাছে চাইবো আমি। ফাইলগুলো এগারোটার মধ্যেই ছেড়ে দিতে হবে। আপনি একটু বসুন প্লিজ!

মিস মিলি মাথা নুইয়ে সম্মতি দিলো। টেবিলের উপর রাখা কলিং বেলটি বাজালাম। মাহাবুব এলে বললাম,… একাউন্ট্যান্ট ওভারশিয়ারদের সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো। বলবে যে নতুন অফিসার এসেছেন। সবাই যেন এখনই একবার আসে।

ওভারশিয়ার ক্যাশিয়ার একাউন্টেন্টরা সবাই একে একে এসে বসলো। আমি এক ফাঁকে চেকগুলো সই করে সিল লাগিয়ে দিলাম। চেকখানাকে পেপার ওয়েট এর নীচে চাপা দিয়ে সবার দিকে তাকালাম...

সবাই এসে গেছেন?

সবাই সমস্বরে মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলো, .. স্যার একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে গাম্ভীর্য নিয়ে বললাম, ….

আপনারা সবাই জানেন এই প্রোজেক্টের অফিস ফার্মগুলো ঠিকভাবে পরিচালনা করা আমার একার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আমি ঢাকা বড় সাহেবের কাছে একজন অফিসারের জন্য প্রস্তাব রেখেছিলাম। উনি ঢাকা থেকে এসেছেন। এখানকার স্থানীয়া। আমাদের প্রজেক্টে ওনার পোস্টিং হয়েছে।….

সবাই একসঙ্গে মিস মিলির দিকে তাদের উৎসুক্য দৃষ্টি বুলালো। মিস মিলির দিকে তাকিয়ে বললাম, ….. উনি হচ্ছেন মিস মিলি তরফদার। আর পেছনের সারিতে পূর্ব পার্শে সোফায় বসা ফিউট্রেলস আর্লি ফার্মের ওভারশিয়ার কে দেখিয়ে বললাম, …. আর ইনি হচ্ছেন.... আমার মুখের কথার রেশ টেনেই সোহরাব সাহেব দাঁড়ালো....

আসসালামুয়ালাইকুম, আমি সোহরাব হোসেন। ফিউট্রেলস আর্লি ফার্মের ওভারসিয়ার।

মিস মিলি পেছনের দিকে তাকিয়ে সালাম নিলো। ডানে বামে তাকিয়ে সবার পরিচয় জানলো।

এরই মধ্যে মাহবুব ট্রেতে করে চা সিঙ্গারা নিয়ে এলো। এমনি ছোট-বড় মিটিংয়ে যে চা সিঙ্গারা চলে - মাহবুব তা জানে।

চা পর্ব শেষ হলে একাউন্ট্যান্ট তারেককে বললাম, … তারেক সাহেব, ওনার তো অফিস কক্ষের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আপনি বরঞ্চ কেশিয়ার সাহেবের রুমে চলে যান। ওই রুমটা বড়োসড়ো আছে। তিনজনের কাজকর্মে কোন অসুবিধে হবে না। আর সোহরাব সাহেব, …. আপনি আজকের মধ্যেই মোটামুটি উনার বসার জন্য তারেক সাহেবের রুমটায় সব রকম ব্যবস্থা করে দেন। পরে শহর থেকে প্রয়োজনীয় ফার্নিচার এনে উনার যোগ্য করে অফিস সাজিয়ে দেয়া যাবে।

ঘড়িতে দশটা বেজে গেলো। ওভারশিয়াররা সবাই তাদের ফার্মে চলে যাবে। কিনো ফার্মের ওভারশিয়ার মিস্টার এনাম কে বললাম, ….. এনাম সাহেব আপনার কাজের তো বেশী চাপ নেই। আজ আপনি কতক্ষণ এর জন্য উনাকে ফার্মগুলো নার্সারিটা দেখিয়ে আনুন।…. সংশোধন করে আবার বললাম, … ঠিক আছে আমিও যাবো আপনাদের সাথে। উনাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। অফিসের কাজ পরে সারা যাবে।

সবাই ফার্মের দিকে এগুলাম।

অফিস বিল্ডিং এর সামনে লনের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর নিচ দিয়ে রাস্তাটি একটু পূর্বদিকে এগিয়ে গিয়ে নদীর পাড়কে চুম্বন করেছে। সেখান থেকে পথটি চলে গেছে পাহাড়ের গা ধরে ধরে। মাঝারি উচ্চতার পাহাড়। স্পষ্ট কোনো চূড়া নেই। ভূমি থেকে উপরের দিকে বিশ ফুট পর পর লাইন করে পাহাড়ের গা কেটে পাঁচ ফুট জায়গা জুড়ে ঢালু পাহাড়কে সমতল করা হয়েছে। এরূপ একটি সমতল ভূমি সমান দূরত্ব বজায় রেখে সম্পূর্ণ পাহাড়টির চতুর্দিকে ঘুরে এসে আবার পূর্বের স্থানে মিলিত হয়ে পাহাড়টির চতুর্দিকে একটি বলয় রচনা করেছে। এর উপরে আবার পনেরো ফুট দূরে আরো একটি সমান্তরাল সমতল বলয় পাহাড়টির চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করেছে। এভাবে পনেরো ফুট অন্তর অন্তর সমান্তরাল সমতল বলয়গুলো সম্পূর্ণ পাহাড়টির গায়ে অসংখ্য মেখলা পরিয়ে পাহাড়টিকে পরম যত্নে সাজিয়েছে। পাহাড়টির চারদিকের এই কন্টুরের মালাগুলো একত্র হয়ে পাহাড়র্টিকে এক অপূর্ব সাজে সাজিয়েছে।

পরপর সমান্তরাল সমতলে পনেরো ফুট পরপর কমলা লেবুর চারা লাগানো হয়েছে। ফিউট্রেলস আর্লি কিনো জাতের কমলা লেবু গাছগুলো বারো থেকে পনেরো ফুট লম্বা হয়ে গেছে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে একই সমতলে সব গাছের উচ্চতা প্রায় একই উচ্চতায় উঠে গেছে। একটি গাছে পল্লবিত শাখা- প্রশাখা আর একটি গাছের সাথে মিশে গিয়ে সবুজ রেখা তৈরী করেছে। সবুজ চওড়া রেখাটি পাহাড়ের চতুর্দিকে ঘুরে এসে একটা অবারিত দর্শনীয় সবুজের মেঘলা পরিয়েছে পাহাড়ের গায়ে। গাঁয়ে সবুজ মেখলা পরিহিত পাহাড় টিকে সবুজ স্বর্গ বলে মনে হয় আমার কাছে।

কেনো যেনো আমার কাছে তখন মনে হলো, শান্ত-সবুজ ছায়ার নিচে শান্তির পায়রারা উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আন্দোলিত পাহাড়ি কিশলয় পরিবৃত্ত হয়ে স্বর্গপরীদের সঙ্গীত সুধা ভেসে আসছে যেনো। সবুজে সবুজে একাকার হয়ে স্বর্গরাজ্যে অনাবিল শান্তির ফল্গুধারা-স্রোত বয়ে যাচ্ছে।

সব সৌন্ধর্যেরই একটা আবেদন আছে। নির্দিষ্ট প্রখরতায় তারা তাদের সে সৌন্ধর্যের মাধুর্যটি বিতরণ করে। মানব মনে অনুভূতির ভিত্তি গড়ে। সে সৌন্দর্যের কোনটার আবেদন স্বল্পকালীন, আবার কোনটার আবেদন দীর্ঘকালের। কোনটা ক্ষণস্থায়ী, কোনটাই চিরস্থায়ী। পৃথিবীর নীল আকাশের চন্দ্র, তারা, সূর্য্য, মেঘ, সাগর-নদী-দিঘি-পুকুর, প্রকৃতির বিচিত্র রং, দিগন্ত জুড়ে শ্যামলিমা…. সবই আমাদের চোখের গভীরে তাদের যার যার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আমাদের অনুভূতিশীল মনে রুনু-ঝুনু বাজায়। দৃষ্টির গভীরে গভীর হয়ে প্রখরতা ছড়ায়। অনুভূতির অনু-পরমানুর গায়ে প্রশান্তি মেশায়।

পাহাড়ের গায়ে উঠতে উঠতে কেন জানি আমার মনে হলো, …. সব সুন্দরের কেন্দ্রবিন্দুতে যে সৌন্ধর্য্য ঘনীভূত হয়ে সৌন্দর্যের পসরা ছড়ায়, তা প্রকৃতির সবুজ এর সৌন্ধর্য্য! পুরো পাহাড়জুড়ে কমলালেবু পাতার মনোহারী সবুজ সৌন্ধর্য্য চোখের সামনে সবুজ মেখলার ভালোলাগার ঢেউ তুলে যায়। পাতায় পাতা জড়াজড়ি করে সবুজের জোয়ার ডাকে আমার দুচোখের পুরো জায়গা জুড়ে।

কচি পাতার হালকা সবুজ বড় পাতার ঘন সবুজের কোলে আনন্দরা নেচে নেচে বেড়ায়। পত্রফলক এর ফালি ফালি সবুজ রং বাতাসের সাথে মিতালী করে হাত-পা নাচায়। সদ্যধরা গোল গোল সবুজ কমলা লেবুর গায়ে সবুজরা ঘনীভূত হয়ে শ্যামল সবুজের গম্বুজ গড়েছে যেনো। শ্যামল সবুজ কমলা লেবুর দল গায়ে গা লাগিয়ে শ্যামল সবুজ ঘনীভূত পিন্ডের মিছিল ডেকেছে যেনো। আমার মনে হলো, …. সবুজ সৌন্ধর্য্যই আর সব সৌন্দর্যের উৎস! পৃথিবী সৃষ্টি হবার পরে অনুভূতিপ্রবণ প্রাণীদের আগে পৃথিবী প্রকৃতির প্রথম সৃষ্ট লতা গুল্মের সবুজ জগতকে আঁধার করে প্রথম নিজের একটি নিজস্ব রূপ সৃষ্টি করে নিয়েছিলো। তারপর বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই সবুজ লতা-গুল্মগুলো বড় গাছে রূপান্তরিত হয়ে ফুল ফল ফলিয়ে এই পৃথিবীটিকে বৈচিত্রময় করে তুলেছে।

সবুজ পাতাদের অপরূপ সৌন্ধর্য্য ছিটকে এসে আমার দু চোখের স্বচ্ছ পর্দার উপরে লেপ্টে যেতে থাকলো। আমার তখন মনে হলো - পাতাদের সূক্ষ্ম পত্ররন্ধ্রের মধ্য দিয়ে সবুজ পাহাড় থেকে চতুর্দিকে দিগন্ত জুড়ে সবুজ রশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে। প্রকৃতির এই সবুজ গাছগুলো আর সব বস্তুগুলোকে সবুজে সবুজে সিক্ত করে এক অবারিত সবুজ সৌন্ধর্য্য-স্রোতের আবর্তে বিধৌত করছে যেনো। সে সৌন্ধর্য্যের আবর্তে ঘূর্ণি খেতে খেতে আমার চোখের কাজল কালো ভ্রু দুটি আনন্দ ভালোলাগায় আন্দোলিত হতে থাকলো। আমারমনে হলো, …. সবুজ পাখনা মেলে সবুজ পাহাড়টি নীল আকাশের নিচে মেঘমালার সাথে পাল্লা দিয়ে সবুজ-চুরা উঁচিয়ে বিস্তৃত পুচ্ছ ছড়িয়ে উড়ে উড়ে চলছে। আমার সৌন্ধর্য্য প্রেমী অনুভূতির প্রান্তে প্রান্তে এক মোহনীয় সবুজ সৌন্দর্যের ঢেউ খেলে গেলো। সবুজ সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এক সময়ে আমি হারিয়ে গেলাম নিঃসীম মাধুর্য্যের অতল তলে, গভীর হতে অনেক গভীরে….

মিস মিলির ছোট্ট কাশির শব্দে ভাব জগত থেকে বাস্তব জগতে ফিরে এলাম আমি। ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ করে চঞ্চল গলায় আনন্দ উসলে পড়ে মিস মিলির, …..

এত সুন্দর করে বাগান বানিয়েছেন স্যার! আমার মনে হয় কি জানেন স্যার? মনে হয় এইখানে না আসতে পারলে পৃথিবীর একটা সুন্দরতম স্থান বুঝি আমার দেখা হতো না।…. মিস মিলির চোখেমুখে অবিচ্ছিন্ন আনন্দের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়লো। চঞ্চল চোখ দুটোকে এদিক- ওদিক করে স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বললো,…. আমি আজকে ঘুরে-ফিরে সবগুলো বাগান দেখবো স্যার। তারপর কাল থেকে মন-প্রাণ দিয়ে কাজে লেগে যাবো স্যার।

বাগানের সবুজ-শ্যামল শান্ত ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে কিনো ফার্মের ওভারশিয়ারকে বললাম, …. এনাম সাহেব,  উনাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সবকিছু দেখিয়ে আনুন। আমি বরঞ্চ নাছ ফার্মের কাজগুলো তদারকি করে আসি। নাছ ফার্ম হলো নাগপুরী ছাতক কমলালেবুর ফার্ম। নাগপুরি ছাতক ফার্মে নাগপুরি ছাতক কমলালেবুর চাষ করার জন্য সকল প্রস্তুতি কাজ এগুচ্ছে। নাগপুরি ছাতককে আমরা সংক্ষেপে নাছ বলি।

এনাম সাহেব মিস মিলিকে নিয়ে অই  পাহাড়ের সবুজ কমলা বনে রওয়ানা হলো। সামনে এনাম সাহেব, আর পেছনে মিস মিলি। মিস মিলি এই প্রথম দিন একটি সবুজ শাড়ি পরে এসেছে। পাহাড়ের সবুজ রঙে তার শাড়ির সবুজ রং মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে। একসময়ে আমি দেখলাম, মিস মিলির সবুজ শাড়িটিও আর দেখা যাচ্ছে না। আমার মনে হলো মিস মিলি তার অস্তিত্বটুকুকে বিসর্জন দিয়েছে পাহাড়ের ওই সবুজ কমলালেবুর বনে। পাহাড়ের সবুজ শোভার গহীন গহবরের অতল তলে!

মিস মিলি কি পারবে এই সবুজ পাহাড়ের সেবিকা হতে? হঠাৎ করে প্রশ্নটি আমার মনে উদয় হলো কেন? পাহাড়ের সবুজ শোভার মাঝেই আমি প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজে পাবার উদগ্রীবতা নিয়ে নাছ ফার্মের দিকে পা বাড়ালাম।  

 


কোন মন্তব্য নেই

50

Blogger দ্বারা পরিচালিত.