উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব সাত - মধুলগন
পড়ুন উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব সাত - মধুলগন (ছবিটির নিচে)
নিবেদন: উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট
আশির দশকের প্রথম ভাগ। তখন মোবাইল ফোন আসেনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিফোনও ছিল না। তখন চিঠির মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতো সবাই। আর গ্রাম-গঞ্জে ও পাহাড়ি অঞ্চলে বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল না। এরকম সময়-পরিবেশে যাপিত জীবনের কল্পকাহিনি নিয়ে গড়া এ উপন্যাসটি। আশির দশকের সময়-পরিবেশ অনুধাবন করে উপন্যাসটির সকল পর্ব পড়তে থাকলে নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে। এটি সপ্তম পর্ব। প্রথম পর্ব হতে
পড়ার অনুরোধ রইলো। প্রথম পর্বের লিংকটি এখানে দিয়ে দেয়া হলো https://bengali.pratilipi.com/series/supriya-priyatma-porbo-ek-anuprabesh-by-iqbal-jafu-abmqnd4trcwo
উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা
পর্ব সাত - মধুলগন
দক্ষিণের আকাশটা খুব কালো হয়ে গেছে। ঘাড় কালো। এক স্তর কালো মেঘের পর আর এক স্তর কালো মেঘ। ঝড় আসবে। ঝড় সমেত শিলাবৃষ্টিও হতে পারে। বৃষ্টি এলে আমার খুব ভালো লাগে। টিপটপ বর্ষণের শব্দ শুনতে-শুনতে অতীতের ভালোলাগা মুহূর্তগুলোকে ভাবা যায়। অনেকটা গাভীর বিশ্রাম-সময়ের জাবর-কাটার মতো।
কড়াৎ-কড়াৎ শব্দ করে বাজ পড়লো। দক্ষিণ থেকে তীব্র ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি আরম্ভ হলো। বাংলোর টিনের চালে বড় বড় শিলাগুলো ধরাম করে পড়ে প্রচন্ড শব্দ করে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়তে থাকলো।
কিছুক্ষণ আগেই মিলি বাংলো থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। বেশিদূর যেতে পারেনি হয়তো। হয়তো রাস্তায় ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছে। প্রচন্ড শব্দের বাজ ও শিলা বৃষ্টিতে ও-কি এগুতে পারছে? আর তাছাড়া মিলি বাজের শব্দকে ভীষন ভয় করে। একদিন এই বাংলাতেই রুবির সাথে আমার কথা হচ্ছিল....
আচ্ছা দাদু ভাই, এ পাহাড়ি অঞ্চলে এত বৃষ্টি হয় কেন?
পাহাড় উঁচু বলে
উঁচু বলে এত বৃষ্টি হবে?
হ্যাঁ, হবে। হবে না কেন? সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যতই উপরে উঠবে - ততই বাতাসের তাপমাত্রা কমতে থাকবে। আর তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে জলীয় বাষ্পের ঘনীভবন অবস্থার ত্বরান্বিত হতে থাকবে। যার ফলে পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি।
ধুর ছাই ! আমার বৃষ্টি বিলকুল পছন্দ নয় ! কেমন ভ্যাপসা ভ্যাপসা আবহাওয়া ! আর দুনিয়াদারীর অন্ধকার অন্ধকার ভাব ! একেবারে মনটাই খারাপ হয়ে যায় !
আমার কিন্তু বৃষ্টি খুব ভালো লাগে !....
মিলি চুপ থেকে কথা শুনছিল। আমার মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে বললো,….
আমারও বৃষ্টি খুব ভালো লাগে। বৃষ্টিতে পৃথিবীর কান্না কান্না ভাব থাকে। কান্নাটা নাকি খুব আদিম ! তাই দুঃখের রিপ্রেজেন্টেটিভ হলেও কান্নাকেই আমি পছন্দ করি !
নবজাতক তো পৃথিবীতে এসেই কাঁদতে শুরু করে। আর তাছাড়া, বৃষ্টিকে ভালো লাগার আরও একটা কারণ হলো - রেইন ইজ দা সাইন অফ গুডনেস…. আমি বলি।
……তবে আমার কিন্তু গাছের পাতায় টিপটপ টিপটপ ধরনের বৃষ্টিই পছন্দ ! আনুষঙ্গিক অন্য কিছুকে ভয় পাই আমি !
আনুষঙ্গিক?
এই ধরুন, ঝড়-বজ্র। ওরে বাপরে ! বিজলি চমকালে আমার পিলে চমকে উঠে ! দুই কানে আঙ্গুল দিয়ে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেই, বজ্র কখন পড়ে ! বাবা ! যে প্রচন্ড শব্দ ! আর গায়ে যে পড়বে না - তারও নিশ্চয়তা কোথায়? জানেন পলাশ ভাই ! ( মিলি রুবির সামনে আমাকে পলাশ ভাই ও আপনি বলেই সম্বোধন করতো) গতবছর না আমাদের গাঁয়ে বজ্রপাতে চারজন লোক মরেছিল। তখন থেকে, ওরে বাপরে ! আকাশে একটু ডাকাডাকি আরম্ভ হলেই ঘর থেকে বের হবার সময় কেমন যেন মৃত্যুর কথা মনে পড়ে আমার !....
বজ্রপাতে মিলির মৃত্যু-ভয়ের কথাটা মনে আসতেই আমি মিলির জন্য দুশচিন্তা অনুভব করতে লাগলাম। এই কিছুক্ষন আগেও মিলির অবৈধ কামচরণ প্রবৃত্তির কারণে তার উপরে আমার যে অসন্তুষ্টি ছিল, তা এখন আর নেই। এটা সত্য, এভাবে আমার প্রতি মিলির অবৈধ দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ করাটা শোভনীয় হয়নি। একেবারেই না। কিন্তু এটাওতো ঠিক যে - মিলিকে এই নিষিদ্ধ গন্ডি ডিঙানোর সাহস বা প্ললোভনটাতো আমিইতো জুগিয়েছি। জোগাইনি? - মিলি যখন কলসি ভরে নদীর ঘাটলার সিঁড়ি মাড়াচ্ছিলো, তখন আমার দৃষ্টি মিলির শরীরের নিষিদ্ধ অঙ্গে কি নিবদ্ধ ছিল না? আমার প্রতি কামনা প্রবৃত্তির প্রয়োগ করতে আমিইতো মিলিকে সাহস জুগিয়েছি। মিলিরতো কোনো দোষ নেই ! এই ঝড়-বৃষ্টিতে মিলিকে বেরুতে দেয়াটা আমার মোটেও উচিত হয় নি। নিজের মনের দৈন্যতা উপলুব্ধ হতেই মিলির বিপদ আশংকায় আমি দুশচিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম।
প্রচন্ড শব্দে কড়াৎ কড়াৎ করে এদিক সেদিক বাজ পড়ছে। বাজ পড়ার শব্দের সাথে সাথে মিলির মৃত্যুর একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলে কেন যেন আমার মনে হলো। আর তা মনে হতেই মিলির জন্য আমার উদ্বেগ আরো বেড়ে গেলো। ঝটপট প্যান্ট পরে চাবি নিয়ে গ্যারেজে ঢুকলাম। রেইনকোট দিয়ে শরীরটা মুড়িয়ে নিয়ে মোটরসাইকেলে রাস্তায় বেরুলাম। দূর থেকে প্রবল ঝড়ে গাছের পাতা ও ভাঙ্গা শাখা উড়ে এসে আমার মুখে ও রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে লাগলো। শিলাবৃষ্টির দাপট ও পরাক্রমশালী ঝড়ের মোকাবিলা করতে করতে অদূরে মিলির আর্তচিৎকার আমার কানে ভেসে এলো। আর একটু এগিয়ে যেতেই আমি মিলিকে পেলাম - মোটা সেগুনের গা জড়িয়ে ধরে মিলি চিৎকার দিচ্ছে… কে আছো ! আমাকে বাঁচাও ! আল্লাহ গো ! আমাকে মেরো না !...
মোটরসাইকেলের ব্রেক কষে গিয়ারটিকে জিরোতে আনলাম এবং গাড়ি থেকে ঝটপট নেমে মিলির কাছে এগিয়ে গেলাম। আমি দৌড়ে গিয়ে মিলির দুই বাহু ছাড়িয়ে নিলাম….
মিলি, জলদি এসো
কে, কে ! আমাকে বাঁচান, প্লিজ ! আমি মরে যাব !....
মিলি আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু পারলো না। শীত ও ভয়ে ওর হাত-পা আরষ্ট হয়ে গেছে যেন। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে তুললাম এবং জল-কাঁদা মাখা শাড়ি গুটিয়ে মোটরসাইকেলের কাছে এগিয়ে গেলাম। মিলিকে মোটরসাইকেলের সিটে বসিয়ে আমিও উঠে বসলাম।….
মিলি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে বসো। প্রবল ঝড় ! উড়িয়ে নেবে ! …
শীতে মিলির সমস্ত শরীর কাঁপছিল। কথা বলার শক্তিও হয়তো নেই। কম্পিত ক্ষীণকণ্ঠে উত্তর দিলো....
আমি যে পারছিনা…
কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। গায়ে-মাথায়-মোটরসাইকেলে-রাস্তায় সর্বত্র বড় বড় শিলা পড়ছে। উপায়ান্তর না দেখে আমি মিলির শাড়ি দিয়ে মিলিকে আমার দেহের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিলাম এবং মোটরসাইকেল চালিয়ে দিলাম। শিলা-বৃষ্টি দ্বিগুণ গতিতে নাকে মুখে আঘাত হানতে থাকলো। মিলি আমার পিঠের উপরে তার মুখ লুকাল। একেবারে ঘনিষ্ঠ হয়ে, আমার পিঠের সাথে লেফটে।
বাংলোর নিচে এসে গাড়ি থামিয়ে দিলাম এবং শাড়ির বাঁধন খুলে মিলিকে কোলে তুলে নিলাম। মিলির শরীর শক্ত-মাংসের মতো একতাল বরফপিন্ড যেন । সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম এবং খাটের উপর ওকে শুইয়ে দিলাম। মিলি অজ্ঞান হয়ে গেল।
জীবনের চরমতোম বিপদের সম্মুখীন হলাম। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ পরিস্থিতিতে মাহবুবকে ডাকার প্রয়োজন বোধক করলাম। তারওতো উপায় নেই! প্রচন্ড ঝড় ! এ ঝরে রন্ধনশালা থেকে মাহবুব কিছুই শুনতে পাবে না। এই অনেক বছর পর বার-কয়েক খোদাকে স্মরণ করলাম। কিন্তু তার আগে মিলির পরনের ভেজা কাপড় চোপড় ছাড়ানো দরকার। হাত লাগালাম এবং কয়েক মুহূর্তে ভেজা কাপড়-চোপড় ছাড়িয়ে ওর গায়ে লেপ চাপিয়ে দিলাম। মাথার চুল তোয়ালে দিয়ে মুছে দিলাম।
বাইরে ঝড়ের তান্ডব-লীলা চলছে। বিজলী-চমক ও বজ্রনিনাদ সমানে চলছে। শিলা পড়া বন্ধ হয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। মিলির জ্ঞান ফেরানোর কথা ভাবতে লাগলাম। ডাক্তার ডাকার কোন উপায় নেই। চট করে মনে পড়লো - গরম অলিভ অয়েল গায়ে মাখলে নাকি গা শীত নিরোধক হয়। ঝটপট কেরোসিন স্টোভ জ্বালালাম। অলিভ অয়েল গরম করে মিলির হাতে পায়ে মাখতে থাকলাম। আমার মনে হলো, অলিভ অয়েল মিলির সারা গায়ে মেখে দিতে পারলে হয়তো ভালো হতো ! কিন্তু লেপের আড়ালে আবৃত মিলির নগ্ন-দেহের সর্বত্র হাত চালানোর মতো মানসিক সাহস আমি সঞ্চয় করতে পারলাম না।
মিলির জ্ঞান-শূন্যতার এই ক্ষনটিতে মিলিকে ঘুমোচ্ছে বলে আমার মনে হলো। লেপের বাইরের মুখমন্ডলটাকে খুব সহজ-সরল সুন্দর-পবিত্র বলে মনে হলো। তখন আমার কেন যেন মনে হলো - পৃথিবীতে এমন সুন্দর নিষ্পাপ মুখ আমি আর কোথাও দেখিনি ! এবং সে মুহূর্তে আমার এটিও মনে হচ্ছিল যে - পবিত্র চেহারা নিয়ে পৃথিবীতে নিশ্চয়ই আর কোন মেয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। মিলির প্রতি আমার খুব মায়া হলো ! বজ্রপাত ও মিলির মৃত্যু-ভয় সম্পর্কে মনে হতেই আমার মনে মিলির জন্য প্রচন্ড বেদনা অনুভব করতে থাকলাম। মিলি যে আর বেঁচে উঠবে না এবং মিলির মৃত্যুর পর তাদের বাড়িতে মৃত্যুর খবর পৌঁছাতে হবে - এই ধরনের একটা কুলক্ষণ চিন্তাও আমার মনে এসে ভিড় জমাতে থাকলো। আমি ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম এবং একযুগ পর এই প্রথম আমি কাঁদলাম। আমি মাথা নুয়ে মিলির ঠান্ডা গালে চুমু খেলাম এবং আমার উষ্ণ-গাল মিলির ঠান্ডা-গালে চেপে রাখলাম। লেপের উপর দিয়েই মিলিকে জড়িয়ে ধরে আদর দিতে থাকলাম....
মিলি তুমি এ কেন করলে? ঝড়-বৃষ্টি দেখে কেন তুমি বাংলোয় ফিরে এলেনা। আমি এখন কি করবো মিলি ! আমি এখন কি করবো....
ধীরে ধীরে মিলির দেহ উষ্ণ হতে লাগলো। আমি মিলির ডান হাতখানা হাতের মুঠোয় টেনে নিলাম। মিলির শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি যখন ক্রমে ক্রমে বাড়তে লাগলো এবং মিলির দুই ঠোঁট একটু নড়ে উঠলো, আমি তখন মিলির জীবনের আশ্বাস ফিরে পেলাম।
কেরোসিন স্টোভের তেপায়া স্ট্যান্ডের উপরে কেতলিতে ওভালটিন এর জন্য দেয়া পানি যখন ফুটতে লাগল, মিলি তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করে কাতরাতে থাকলো। এবং এক সময়ে চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকালো। মিলি যখন আমাকে ও বাংলোকে চিনতে পারল। দুহাতে মুখ চেপে সশব্দে কেঁদে উঠলো।….
এ কি করলে পলাশ ! আমার মতো পাপীয়সীকে তুমি কেন বাঁচালে ! কেন বাঁচালে ! কেন বাঁচালে....
মিলি কাঁদতে থাকলো। আমি এগিয়ে গিয়ে ওর ডান হাতখানা আমার বাঁ হাতে নিলাম এবং ডানহাত খানা ওর মাথায় রাখলাম...
মিলি কেঁদো না। ভালোবাসা পাপ নয় ! তুমি তো আমাকে ভালোবাসো ! তুমি পাপী নও লক্ষ্মীটি ! আমি তোমার ভালোবাসার দাম দিতে পারিনি। তোমাকে অপমান করেছি। ঝড়-বাদল আসবে জেনেও তোমাকে যেতে বাধা দেইনি। সব দোষ আমার ! আমাকে ক্ষমা করো লক্ষী….
আমি আমার মুখখানা মিলির মুখের অতি কাছে নিয়ে গেলাম এবং মিলির ঠোটে আলতোভাবে ঠোঁট মেলালাম। এই প্রথম, মিলি বুঝি আমার আদরের স্বাদ পেলো। দু’হাত দিয়ে আমার মাথা টেনে নিয়ে ওর মুখের সাথে আমার মুখটিকে সজোরে চেপে রাখলো এবং আবেগ তাড়িত কন্ঠে বলে চললো.....
পলাশ আজ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমার পুনর্জন্ম হলো এবং আমার নতুন জীবনের শুরু হলো। পলাশ, লক্ষী ! কথা দাও, আর কোনদিন তুমি হারিয়ে যাবে না। আমার পাশে থাকবে। আমাকে আদর করবে। তোমাকে কতদিন পর ফিরে পেয়েছি ! কলোনি বাজার থেকে শুরু করে সব জায়গায় তোমাকে আমি খুঁজেছি। বহু খোঁজাখুঁজির পর তোমাকে আজ ফিরে পেলাম পলাশ ! কথা দাও - আর আমাকে ফেলে তুমি কোথাও চলে যাবে না। তুমি চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো ! কথা দাও ! কথা দাও....
আমাকে আরো জোরে চেপে ধরে মিলি ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি মাথায় হাত বুলালাম। কন্ঠে সোহাগ মেখে সান্তনা দিলাম....
কেদো না লক্ষ্মীটি ! কেঁদো না ! সবকিছু হবে। আগে সুস্থ হয়ে নাও - এসব পরে ভাবা যাবে।
আমাকে আরো জোরে চেপে ধরে মিলি ডুকরে কেঁদে উঠলো....
মিলি একটু শান্ত হও ! প্লিজ ! তুমি অসুস্থ...
ধীরে ধীরে মিলির কান্না থামে। চোখ মুছে গলা খাকারি দিয়ে মিলি কান্নার বেগ কন্ট্রোলে আনে। আমি মিলিকে আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নেই। স্টোভের গরম পানি দিয়ে মিলির জন্য একমগ ওভালটিন তৈরি করি। ওভালটিন এর মগটি হাতে করে মিলির কাছে এগিয়ে আসি….
মিলি
হ্যাঁ
এই নাও, গরম গরম খেয়ে নাও
আমি যে নড়তে পারছি না ! সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আছে।
ঠিক আছে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি...
আমি মিলির মাথার পেছনটা ধরে ওকে উঠানোর চেষ্টা করতেই মিলি শিউরে উঠলো...
ছি ছি পলাশ ! তুমি এ কি করলে? তুমি একটা পশু....
মিলি লজ্জা-তাড়িতা হয়ে নাকে-মুখে লেফ টেনে নিল
..... এছাড়া আমার আর কিইবা করার ছিল? তুমিই বলো ! তোমাকে বাংলোয় তুলে এনে যখন দেখলাম তুমি অচৈতন্য, তখন সহজ করে কিছু একটা ভেবে নিতে পারছিলাম না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার ভেজা কাপড় চোপড় ছাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। অনুভব করলাম, আর করলামও তাই। আমাকে মাফ করে দিও মিলি....
মিলি মুখের উপর থেকে লেপ সরালো। ওর চোখ দুটো ভেজা। আবেগ-আপ্লুত কন্ঠে বললো....
পলাশ ! এই মিলি আজ থেকে সম্পূর্ণ তোমার। এ দেহ, এই মন - সবই তোমার ! এই দেহকে সর্বপ্রথম যে নিরাবরণ করল - সে তুমি ! খোদা যে আমাকে তোমার জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন ! তা না হলে এত বছর পরে দু’জনের দেখা ! একই ফার্মে চাকরি। এবং সর্বশেষে এ ধরনের ঘটনাই বা ঘটবে কেন?...
মিলি লেপের কোনা টেনে চোখ মুছলো। আমার হাত টেনে কাছে বসালো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আবারো বলে চললো....
আমি কিন্তু আর বেশিদিন ওয়েট করতে পারবো না। আর এখন তো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে ! কিছু একটা করো। অতি তাড়াতাড়ি। আমার মন কিন্তু মানছে না... মিলি আদুরে কন্ঠে বলেই চললো…
আমি বাধা দিয়ে বললাম...
মিলি, তুমি অসুস্থ। আগে শরীর মন ঠিক করো। পরে সেসব ভাববে। এই নাও, ওভালটিনটুকু খেয়ে নাও। শরীরটা একটু চাঙ্গা হোক।…
মিলি হাত বাড়িয়ে ওভালটিন এর গ্লাস নেয় এবং গা তুলতেই আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় হাসে। আমি বুঝতে পারি....
মিলি, আমি বরঞ্চ বাইরে গিয়ে একটু দাঁড়াই। তুমি খেয়ে ফেলো। বৃষ্টির তোর কমলে আমি ডাক্তারের জন্য যাবো। …
আমি উঠে এসে বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়াই। ঝড়ের প্রকোপ কমে গেছে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ়ে বৃষ্টি। আমি বৃষ্টিকে ভালোবাসি। বৃষ্টির গুনগুন শব্দ আমার ভালো লাগে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির গান শুনি।
ভেতর থেকে মিলি ডাকলো, …পলাশ ভেতরে এসো...
আমি ভিতরে যাই। মিলির হাত থেকে মগটি নেই।
..... আমার কাপড়-চোপড় কোথায়?
সব আছে। তবে জল-কাঁদায় লেফটে আছে। তুমি ভালো হতে হতে সব পাবে। তুমি শুয়ে একটু রেস্ট নাও। আমি এরই মধ্যে নদী থেকে সব ধুয়ে নিয়ে আসি। স্টোভের সাহায্যে সব শুকিয়ে দেবো।
ছি ! তুমি বুঝি আমার কাপড়-চোপড় ধোবে?
কেন, তাতে কি?
আমার লজ্জা করবে না বুঝি?
আমি কিন্তু কাপড়-চোপড় তোমার গা থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম !
তখন তো আমি সেন্সলেস ছিলাম !
এখন নচেৎ সেন্সফুল। তো, নাওনা নিজের কাপড়গুলো ধুয়ে?
দাওনা একখানা শুকনো শাড়ি?
শাড়ি তো নেই। প্যান্ট ও শার্ট দিতে পারি
আহা ! আমি বুঝি প্যান্ট পরিনি?
অবশ্যই পরেছ। তবে ফুল প্যান্ট নয়। হাফ প্যান্ট, ছোট বেলায়......
মিলি হাসে
..... শোনো পলাশ। তোমার একখানা লুঙ্গি এবং একখানা চাদর দাও। আমি এখন উঠতে পারবো।
থাক, আর উঠতে হবে না। এই নাও, এখানে কিছু বিস্কুট ও কেক আছে। সাথে আপেল। কিছু ক্যালরি নিয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা করো। আমি ততক্ষণে নদী থেকে আসি।….
আমি মিলির কাপড়-চোপড় গুলো গুটিয়ে নেই। এবং নিচে নামার জন্য পা বাড়াই। মিলি ডাকে....
পলাশ শোনো
আবার কি হলো?
তুমি এমন বৃষ্টির মধ্যে নদীতে যাবে?
কিচ্ছু হবে না। রেইনকোট চাপিয়ে যাব।
আহ ! শরীর খারাপ করবে যে !
বৃষ্টিতে আমার শরীর খারাপ করে না
পলাশ একটু এদিকে এসো !
কেন?
আসো না, প্লিজ !...
আমি মিলির শিয়রের কাছে এগিয়ে গেলাম...
কি? কি বলবে বলো।
এত তাড়াহুড়া কেন?
কেন আবার? তাড়াতাড়ি বিদায় করব বলে।
তাহলে উদ্ধার অভিযানে না বেরুলেই পারতে?...
আমি হাসি।….
তোমাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করব, এ ব্যাপারটাকে কারুর চক্ষুর আড়াল করবো বলে।….
মিলি চিন্তিত হয়ে পড়লো। মুখখানা মলিন করে কি যেন ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হলো। আমি চলে আসতে উদ্যত হলাম। মিলি আবার ডাকলো....
এই শোনো
আবার কি? দেরি হয়ে গেল যে !
হোক না !
আর কথা পেলে না। কেউ জেনে গেলে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে না।
তোমার এই কেলেঙ্কারি যে আমার কাছে মর্যাদাবহ !
হতে পারে। কিন্তু, আমি তো শুধু বাংলোর বাসিন্দাই নই মিলি? এখানকার একজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটরও বটে।
তুমি এমন নিষ্ঠুর ভাবে কথা বলতে পারলে ?
মিলি, বাস্তবকে তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না
চাকরি আমরা করবো না
তা কি করবে
কেন? তোমার বাবার তো জমিজমা আছে। তুমি এগ্রিকালচারিস্ট। বড় ফার্ম করবে। আমিও বোটানিস্ট, তোমার ফার্মে যে একটু হেল্প করতে পারবো না ,তাইবা কেমন করে ভাবছো?....
আমি চুপ হয়ে গেলাম। মিলির ইচ্ছের আবেদনে কেমন করে সাড়া দিতে হবে, তা ভেবে উঠতে পারছিলাম না। আমার মৌনতা ভেঙে দিয়ে মিলি বললো...
না পলাশ। আমার প্রস্তাবটা কিন্তু খারাপ নয়। আমি বহুদিন এটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। ভেবেছি, বেশ বড় একটা ফার্ম… সে ফার্মে ফসল হচ্ছে… শাক-সবজি হচ্ছে… ফল-ফলারি হচ্ছে… মাছের চাষ হচ্ছে… গবাদি পশু ও মুরগি পালিত হচ্ছে ! সে ফার্মের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তুমি… আধুনিক ফার্ম.. আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে সে ফার্মে… প্লটে প্লটে সবুজ ধানের সারি…. চপল বাতাস ঢেউ খেলে যায় ধানের সবুজ পাতাদের উপর দিয়ে… তুমি হাঁটবে ধানের ক্ষেতের সবুজ আল বেয়ে বেয়ে…. আমি দূর থেকে ডাকবো, পলাশ ! দাড়াও ! দাড়াও, আমিও আসছি…
মিলি
হ্যাঁ
মানুষের জীবনটা বড় কমপ্লেক্স মিলি ! যা কিছু ভাববে, আর যা কিছু চাইবে, তা-ই যে হবে, আর তা-ই যে পাবে, তাইবা কেমন করে ভাবলে মিলি ! বাস্তব সত্যের মুখোমুখি যখন হবে, তখন দেখবে - যা ভেবেছো, যা চেয়েছো, তার কিছুই নেই ! এর জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে মিলি ! মানুষ হিসেবে মানবিক ভুলগুলোকেও যে তাই আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ কল্পনার ফানুস উড়িয়ে আমরা ক্ষণিকের শান্তি পেতে পারি, কিন্তু সেটা তো আমাদের স্থায়ী মুহূর্ত নয় ! আসল মুহূর্ত হলো, যখন আমরা চরম নিষ্ঠুর বাস্তবের সম্মুখীন হই। সেই মুহূর্তগুলোই যে আমাদের আসল পরিচয় বহন করে। এবং আমরা প্রত্যেকেই সে মুহূর্তগুলোর মধ্যেই আমাদের অবস্থান নির্ণয় করি। মিলি, আমাদেরকে সে মুহূর্তগুলোর সাথে পরিচিত হতে হবে। সে মুহূর্তগুলোর সাথে যুদ্ধ বা সমঝোতা করে আমাদেরকে টিকে থাকতে হবে।…
….আচ্ছা তুমি অলুক্ষণে আশঙ্কা করো কেন? এই শোনো !
বলোনা ! এইতো আছি।
আহা কানে কানে বলবো…..
আমি কান খানা মিলির মুখের কাছে নিয়ে যাই। মিলি চট করে আমার গালে চুমু খায়। আমার চোখে চোখ রাখে। লজ্জায় ওর মুখখানা লাল হয়ে ওঠে। ঝনঝন করে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে। লেপ টেনে মুখ আড়াল করে নিষ্কৃতি পায় মিলি।
আমি মিলির কাপড়-চোপড় নিয়ে নদীর দিকে এগুতে থাকি।
বাইরে তখন বৃষ্টির কান্না। প্রবল কান্না। আমার মনে হল - এ পরিস্থিতিতে আমার হৃদয়ের কান্না ও এই বৃষ্টির কান্নার মাঝে কোন প্রভেদ নেই। বৃষ্টিকে তাই আমার বড়ই আপন মনে হলো !
আমি বৃষ্টিতে নিজেকে সমর্পণ করার জন্য আরো জোরে জোরে নদীর দিকে এগুতে থাকি।
কোন মন্তব্য নেই
50