Header Ads

উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব ৬ – শৃঙ্গধ্বস

 পড়ুন উপন্যাস:  সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব ৬ – শৃঙ্গধ্বস (ছবিটির নিচে) 

ইকবাল জাফু

নিবেদনউপন্যাসটির প্রেক্ষাপট

আশির দশকের প্রথম ভাগ। তখন মোবাইল ফোন আসেনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিফোনও ছিল না। তখন চিঠির মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতো সবাই। আর গ্রাম-গঞ্জে পাহাড়ি অঞ্চলে বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল না। এরকম সময়-পরিবেশে যাপিত জীবনের কল্পকাহিনি  নিয়ে গড়া উপন্যাসটি। আশির দশকের সময়-পরিবেশ অনুধাবন করে উপন্যাসটির সকল পর্ব পড়তে থাকলে নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে। ষষ্ঠ পর্ব। প্রথম পর্ব হতে পড়ার অনুরোধ রইলো। প্রথম পর্বের লিংকটি এখানে দিয়ে দেয়া হলো https://bengali.pratilipi.com/series/supriya-priyatma-porbo-ek-anuprabesh-by-iqbal-jafu-abmqnd4trcwo

 

উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা

পর্ব  – শৃঙ্গধ্বস

 

মানুষ কি জন্য স্বপ্ন দেখে তা আমার জানা নেই। কেউ বলেন, স্বপ্ন ভবিষ্যতের কোন ঘটনা-দুর্ঘটনার আভাস দেয়। কেউ বলেন, স্বপ্ন ব্যক্তি জীবনের যে সকল স্মরণযোগ্য ঘটনা স্নায়ুতন্ত্রে দাগ কাটে, নিদ্রা অবস্থায় তা- আবার মস্তিষ্কে স্বপ্ন হয়ে ভেসে ওঠে। আবার কেউ বলেন, - পূর্ণ অনুভূতি নিয়ে কেউ যখন কোনো কিছু ভাবে এবং তা- স্নায়ুতন্ত্রে দাগ কাটে। আর পরে স্বপ্ন হয়ে পুনর্বার মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে।

 

সবগুলো তত্ত্বই কি সত্যি? যা কিছু ভাববো, তা- স্মৃতি হবার যোগ্য এবং তা- স্বপ্ন হয়ে বাজবে; আর যা ভাববো না, অথবা চিরস্মরণীয় নয়, এমনকি - যা নিয়ে কোনদিন কল্পনাও করিনি, তা- যে স্বপ্নে ভাসবে নাতা-তো নয় !

এমন অনেক কিছু আছে, যা নিয়ে কখনো চিন্তা পর্যন্ত করিনি অথবা যা সম্বন্ধে কোন বাস্তব অভিজ্ঞতাও নেইতাও-তো স্বপ্ন হয়ে আমাদের নিদ্রার মাঝে অশান্তি বা প্রশান্তি ছড়িয়ে দিয়ে যায় - এটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারে? নিশ্চয়ই নয়। হতে পারে এই ধরনের স্বপ্নগুলো একটু অন্য ধরনের। অর্থাৎ অস্বাভাবিক। তাইতো ধরনের সামঞ্জস্যহীন স্বপ্ন দেখে আমরা ভাবি, কেন স্বপ্ন দেখলাম ! সুখ-স্বপ্ন দেখে আমরা মনে কখনো রোমাঞ্চ অনুভব করি, আবার কখনো কখনো দুঃস্বপ্নের কারণে উদ্বেগ-ভীতি নিয়ে আমাদের দিন কাটে।

 

আমাদের প্রজেক্টের ফার্মগুলো পাহাড়ি অঞ্চলে। পাহাড়ের উপরে। কারণ কমলালেবু পাহাড়ি অঞ্চলে ভালো জন্মায়। তারও অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে একটি হলো আবহাওয়ার উপযোগিতা। তাই যখনই যেখানে পাহাড় দেখি, তখনই সে পাহাড়টাকে নিজের বলে মনে হয়। আপন-সত্তা পাহাড়ের ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র কণাগুলোর সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়। চাই সে পাহাড় সবুজ তৃণে ঢাকা, অথবা সবুজ বৃক্ষের ছায়ায় মাখা - কিংবা পাথরের শক্ত আবরণে সুবসনা। এখানেই সমতল ভূমি পাহাড়ের সাথে আমার মনের দূরত্ব বা নিকটত্ত্ব।

 

সারি সারি পাহাড়। তৃণাচ্ছাদিত সবুজের স্তুপ। সোনালী প্রভাত। বসন্তের সমীরণ। পূবাকাশ রক্তিম-লাল। প্রকান্ড লাল সূর্য পাহাড়ের এধারে। ওধারে মরুভূমি। ছড়ানো ছিটানো এলোমেলো বালির স্তুপ। পিন-পিনে বাতাসে শরীর মন পুলকিত।

এরকম মনোরম পরিবেশে যদি সাথে একটা তন্বী-তরুণী থাকতো ! ভালোলাগার অনুভূতিতে একটি তরুণীর উপস্থিতি কল্পনা করে সুখানুভূতির পরশ পেতে দোষ কোথায়? চোখে না-হোক, মনে মনে আমি নিজেই একটি তরুণিময়ী পরিবেশ কল্পনা করলাম। …..

পাহাড়ের গায়ে সবুজ ঘাসের নরম কার্পেট। পায়ের নিচে নরম কার্পেট মাড়িয়ে মাড়িয়ে তরুণীটি উপরে উঠে যাচ্ছে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় ! দক্ষিণা বাতাস বইছে শির-শির করে ! তরুণীর খোলা চুল উড়ছে চঞ্চলা বাতাসে। চপলা বাতাসে উড়ছে তরুণীর শাড়ির আঁচল। ব্রা পরা উন্নত বুক দূর আকাশের লাল আবিরের সাথে সূঁচালো দুটি সমান্তরাল শৃঙ্গ রচনা করছে। তরুণীর দুঠোটের ফাঁক দিয়ে রক্তিম সূর্যের লাল আলো দীপ্তি ছড়াচ্ছে। মনোহরি-উত্তেজক এই দৃশ্যগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি।  আর মুগ্ধ হচ্ছি !

কামনার রসে সিক্ত এই দৃশ্যগুলো উপভোগ করতে করতে হঠাৎ কেন যেনো  মনে হলো - একটি পাহাড়ের চূড়া অন্য সব পাহাড়ের চূড়া থেকে আলাদা, অধিক আকর্ষণীয় - রূপসী ! আবেদনময়ী একটি তন্বী-তরুণীর মত। মনোহরি-উত্তেজক এই দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ  করে মনে হলো, ওই চূড়াটি আরো মোহনীয় হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। আমার পুরো শরীর মনে যৌনতাময়-ভালোলাগার মাদকতা ছড়াচ্ছে।

 

আরো পরে আমার মনে হলো, পাহাড়ের ওই চূড়াটি  আমাকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকছে।  অত্যন্ত আন্তরিকভাবে। দুবাহু বাড়িয়ে নগ্ন শরীরে। আবেদনময়ী বনিতাদের মতো করে।

চূড়াটির আহ্বানে আবিষ্ট হয়ে যাই আমি।  আমি এগোতে থাকি পাহাড়চূড়াটির দিকে। মোহাবিষ্ট হয়ে। শরীরের জৈবিক ক্ষুদা নিবারণে। 

আমার পায়ের নিচে সবুজ ঘাসের নরম গালিচা।

উত্তেজিত আমি টলমলে পায়ে চূড়াটির কাছে গেলাম। অত্যন্ত কাছে। হাত বুলালাম ওর মাথায়। নরম ঘন ঘাসের ডগায়। দেখলাম - নীল লাল বেগুনি হলদে সাদা ফুলের চূড়াটি অপরূপ সাজে সেজেছে। চূড়াটিকে আমার খুব ভালো লাগলো। শারীরিক চাহিদা মিটিয়ে তৃপ্ত হওয়ার মতো ভালোলাগা।  আবেগে মুখ খানাকে ফুলের মুকুটে ঘষতে লাগলাম। অত্যন্ত নরম। মসৃণ। সুঘ্রান। মোহনীয়া।

 

মুহূর্তে মনে হল - অন্য সব পাহাড়ের চূড়াগুলো অকষ্যাৎ ঝুমুর বাজিয়ে আমার কাছের পাহাড়টির চূড়ার কাছে এসে ভীড় জমিয়েছে। পাশাপাশি অসংখ্য শৃঙ্গ। হাজার হাজার শৃঙ্গ। যেনো  বিচিত্র রঙের ফুল দিয়ে সজ্জিতা অগণিত শৃঙ্গের মিছিল !

 

কিন্তু অগণিত শৃঙ্গের মাঝে একটি শৃঙ্গকে জীবন্ত মনে হলো। শৃঙ্গটির দিকে তাকাতেই শৃঙ্গটি নড়েচড়ে উঠলো। জীবন্ত এই শৃঙ্গটি ধীরে ধীরে উঁচু হতে হতে অন্য সব শৃঙ্গের শীর্ষ-মনি হয়ে গেলো। হেলে দুলে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমাকে গ্রাস করলো। আমি আবেশিত। নড়াচড়ার শক্তিও যেনো  নেই !

 

কিন্তু একি ! আর সব শৃঙ্গগুলোকে  আর দেখা যাচ্ছে না কেন ? দেখলাম, সব শৃঙ্গগুলো ক্রমে ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আর এরই মধ্যে সমস্ত পাহাড় জুড়ে পুরো পরিবেশটি বদলে গেছে। ঘন নিকষ কালো অন্ধকারে পৃথিবী ছেয়ে গেছে। তুমুল ঝড় আরম্ভ হয়েছে। পাহাড় শুদ্ধ সমস্ত পৃথিবীটা আকাশে উড়ছে। ঝড়ের দাপটে পড়ে যাচ্ছিলাম যেনো  আমি। ঝাপটে ধরলাম পাহাড়ের শৃঙ্গটাকে।  মিশে রইলাম শৃঙ্গের সাথে। লোহা হয়ে চুম্বকের সাথে। একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে। শৃঙ্গটি যেনো  একটি রূপসী তরুণী। কামনার উগ্রতায় তরুণীটি তার দেহ-বল্লরী সমর্পন করে আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমি পুলকিত হচ্ছি। তৃপ্ত হচ্ছি। আমার সারা শরীর জুড়ে কামনার মধুরস প্রবাহিত হতে থাকে। আমি চোখ বুজে সুখ-সাগরে ভাসতে থাকি। 

এভাবেই অনেক সময় কেটে গেলো। ঝড় শেষ হয়ে গেলো। দেখলাম একটি পাহাড়ের শৃঙ্গও আর নেই। ঝড়ে সবগুলো ধ্বসে গেছে। বর্ণাঢ্য ফুলে সজ্জিত শৃঙ্গের বিলোপ হয়ে উলঙ্গ শিরহীন পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে। বড় বীভৎস। কদাকার ! এরই মধ্যে আকাশের মেঘ ঠেলে সূর্য অনেক উপরে। রুপালি আলোর চিকন রশ্মি। নিচে নেমে এলাম। কিন্তু একি ! আমি উলঙ্গ ! বে-আব্রু !

 

অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। একি স্বপ্ন দেখলাম ! একেবারে অসংলগ্ন। একটা অজানা আশঙ্কায় বুকের পাঁজর চিনচিন করে ভারী হয়ে গেলো। খাটের উপরে বসে পড়লাম। গায়ে মোচর ভেঙ্গে হাই তুলে মনের ভীতি জড়তা ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলাম। না ! সম্পূর্ণ মন দখল করে স্বপ্নটাএখনো চেপে আছে। বুকটা বড় ভারী হয়ে গেছে।

খাট থেকে নেমে কতক্ষণ পায়চারি করলাম। পায়চারি শেষ হলে খাটের কাছে দক্ষিণের জানালার পাশে এসে চুপি চুপি বসলাম।

কিন্তু ধরনের স্বপ্ন দেখার কোন মানে থাকতে পারে? স্বপ্নের কোন সংজ্ঞায় এর ব্যাপ্তি। কেনই বা স্বপ্ন দেখলাম? ধুর ছাই ! স্বপ্ন স্বপ্নই! স্বপ্ন বাস্তব নয়। আবার বাস্তবের বাহকও নয়। এটার নির্দিষ্ট কোন উৎস নেই। যার কোন উৎস নেই - তার কোন ভূমিকাও নেই। সুতরাং মন খারাপ করার কোন মানে হয় না। বরঞ্চ জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের নদী, পাহাড় নীল আকাশের দৃশ্য দেখা যাক। তাই ভালো।

 

নদীর পানির কালো সমতল বুকে ছোট ছোট ঢেউয়ের নাচানাচি। এপারে বাংলোর সানবাঁধা  ঘাট। ঘাটের পার্শ্বে একটি নৌকা বাঁধা। মাহবুব এনে রেখেছে। আগামীকাল রোববার রুবিরা আসবে। সকালে। ইদানিং রুবি বাংলোর চাইতে নদীকেই বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। মাহবুবকে নিয়ে নৌকা চড়ে ঘুরে বেড়ায়। নদীর গভীর বুকের উপর দিয়ে। যেনো  এক নদীময় রুবি এখন !

বেশ কদিন আগের কথা। সেদিন রোববার দুপুরে। একদম ধাম করে খাট জুড়ে শুয়ে পড়লাম। রুবিরা আসার আগে ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিতে হবে। এটা সেটা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বলতে পারবো না।

একসময় রুবির জোরালো ধমকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। …..এই যে দাদু ভাই ! কি হলো বলুন তো দেখি? কি হলো আপনার? সন্ধ্যে হয়ে এলো প্রায়। আপনি এখনো ঘুমাচ্ছেন? উঠুন, শিগগির উঠুন !...

রুবি আমাকে টেনে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো।…..

বিকেলে একটু এদিক ওদিক ঘুরবেন, না তা নয় ! ধুম করে পড়ে আছেন ! আস্ত একটা হাতির মতো !... 

নিচে নেমে কল চেপে গা-হাত-মুখ ধুয়ে রুবির পার্শ্বের সোফায় গা এলিয়ে দিলাম।

তা একা যে রুবি ?

কেন, আপনার কাছে একা আসতে নেই নাকি?

না, এমন একাকী আর তো কখনো আসোনি।

হ্যাঁ আসিনি। আজ এসেছি।  আপু নেই বলে।

কেন, মিলি কোথায়?

আপু ঢাকায়। খালাম্মাদের বাসায় গেছে। ফিরতে তিন দিন সময় লাগবে। তাই আগামী তিন দিন অফিসে আসতে পারবে না।

কি জন্যে গেছে বলতে পারো?

কি জানি ! জিজ্ঞেস করলাম, খালাম্মাদের সাথে নাকি দেখা করবে। আর নাকি, কিছু কেনাকাটা আছে।…..

বলতে বলতে রুবি আঙ্গুল দিয়ে টেবিলে অদৃশ্য অনেকগুলো  দাগ কাটলো। রুবির হাতে ছোট্ট একটি নতুন ঘড়ি। চিকন সোনালী চেইন। আমি সেদিকে তাকালাম……

আরে ! ঘড়ি পেলে কোথায়?

সুন্দর ! না? ভাইয়া পাঠিয়েছে। কুয়েত থেকে।

তোমার ভাইয়া !

হ্যাঁ হ্যাঁ। ভাইয়া তো কুয়েতে থাকে। একটা কনস্ট্রাকশন ফার্মের সুপারভাইজার।

, জানতাম না তো !

আমাদের ভাই একটাই। আর, আমি আর আপু, এই দুই বোন। আব্বুর প্রভিডেন্ট ফান্ডের হাজার পঁচিশেক টাকা জমে ছিল। তাই দিয়ে ভাইয়াকে কুয়েত পাঠালো। আর, ঢাকার কলোনি বাজারে যে দোকানটি ছিল, আব্বু তার পজিশন বিক্রি করে দিলেন ষাট হাজার টাকায়। সে টাকা দিয়ে আমাদের বাড়ির পাশে তিন বিঘা জমি কিনলেন। সে জমি, আর আমাদের আগের যে জমি ছিল, তা থেকেই সারা বছরের খোরাকি এসে যায়। ভাইয়া বিদেশ গেলে আব্বু রিটায়ার্ড করলেন। ভাইয়া কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠায়। এখন ব্যাংকে অনেক টাকা জমে গেছে। আর আপু চাকরি করে যে বেতন পাচ্ছে, সে টাকা তো এটা সেটা কিনতেই তার শেষ হয়ে যায় !

মাহবুব চা-সিঙ্গারা চানাচুর এনে টেবিলে রাখলো।

রুবি অনর্গল কথা বলে চলল। তাদের সংসারের কথা। ঢাকার কথা। কুয়েতের কথা চা খাওয়া শেষ হলে বললো….

আমাকে পৌঁছে দিতে হবে

পৌঁছে দিতে হবে মানে?

তা পৌঁছে দেবেন না ? আমি কি আপনার বাংলোয় রাত কাটাবো নাকি?

কেন? রিকশায় চলে যাবে?

ইস !  হলো আর কি ! এখান থেকে সেই বাজারে হেঁটে যেতে হবে ! তার পরে  !

সেভাবেই যাবে আর সব দিনের মতো ?

ইস ! আমি একা হেঁটে যেতে পারবো না

তা আমি নচেৎ বাজার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম

দেখুন ! এসব হবে না। আমি কিন্তু আজকে আপনার মোটরসাইকেলে করে বাড়ি যাবো।

! আসল ব্যাপার তাই?.....

রুবি হাসে। চোখ রাঙিয়ে। ঠোঁট মুড়িয়ে। ধমকের ভঙ্গি করে। আমার হাত ধরে জোর করে তুলে দেয় রুবি।

মাহবুকে অফিসের স্টোর-রুম খুলে মোটরসাইকেলটি বের করতে বললাম।

কাপড়-চোপড় পড়ে নিচে নেমে এলাম।

রুবি আমার পেছনে গা-ঘেঁষে বামদিক ফিরে বসলো। আনন্দে চমকিত হয়ে বললো…..

দাদু ভাই, আমাকে কিন্তু মোটরসাইকেল চালানো শিখাতে হবে

তাহলে আর পরের ঘর করতে হবে না

আহা ! আমার বয়েই গেছে !....

রুবি অনেকক্ষণ কি যেনো  ভাবলো। এক সময়ে বললো….

জানেন দাদু ভাই ! আম্মু আপনাকে দেখতে কেমন যে করেন ! প্রতি রবিবারেই আমাকে বলেন, তোর দাদু ভাইকে আজকে নিয়ে আসবি। আমি একটু দেখব। আমি আসার সময় আপুকে বলি। আপু বলে, আরে আনবো ! আমাদের বাড়ির যে ছিরি ! একটু সাজিয়ে নেই, তারপর। জানেন? আপু অনেকগুলো কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের সুঁচিকাজ করে আয়নার ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঘরের বৈঠকখানার দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে। নতুন চেয়ার টেবিলে বৈঠকখানা সাজিয়েছে। আর উঠোনের চারপাশে ফুলের গাছ লাগিয়েছে। বাড়ির লম্বা দরজার দুই পাশটা ইউক্যালিপটাস গাছের সারি দিয়ে সাজিয়েছে।..

! তাই নাকি?...

রুবি হয়তো হাসে। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে

আচ্ছা বলুন তো ! আপনি কি আমাদের পর? আপনাকে আনার জন্য এতো সাজগোজের কি দরকার? একথা আপুকে বললে কি বলে জানেন?

কি বলে?

বলে, তুই সব বুঝবি না।…..

 

এটাই তো তোমাদের বাড়ি?

হ্যাঁ। থামলেন কেন? সোজা বাড়িতে চলেন।

আজ নয় ভাই। আর একদিন আসবো।

না। আমি নামছি না। আজকে আপনাকে যেতেই হবে। শুধু আম্মুর সাথে সাক্ষাৎ করেই চলে আসবেন।

তা মিলি আসুক না ! তখন না হয়  একদিন আসবো।….

রুবি রেগে গেলো। অনেক কষ্ট করে তাকে বোঝালাম। রুবি ঝপ করে নেমে পড়লো। চোখে মুখে কালি মেখে উচ্চ গলায় চেচিয়ে বললো,….

হয়েছে মশাই ! একদিনতো চোখের লজ্জা শরম খেয়ে রাতে বিরাতে এসে জ্বালাবেন। সেদিন মজাটা দেখিয়ে ছাড়বো…..

রুবি হনহন করে চলে গেলো।

তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে আঁধার নেমেছে।

 

মাহবুবের কন্ঠে আমার স্মৃতি রোমন্থনে ছেদ ঘটলো…..

স্যার, চা।

টেবিলের উপর রেখে যাও

টেবিলের উপর মাহবুব চা রেখে চলে গেলো।

চায়ে চুমুক দিতেই আবার স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। মনটা বিষন্ন নিস্তেজ হয়ে পড়লো। মনে হলো, মিলিরা আজ বিকেলে আসলে ভালো হতো ! খারাপ স্বপ্নটা দেখা হতো না। স্বপ্নটাকে দূরে সরিয়ে রাখতে অন্যদিকে মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করলাম। মিলির কথাই নচেৎ ভাবা যাক !

মিলির কথাই তো ভাবতে হবে। কখন ভাবা না হয়ে থাকে? - প্রজেক্টের সর্বত্রই তো মিলির পদক্ষেপ। মিলির প্রভাব। সুপারভাইজার থেকে আরম্ভ করে লেবার পর্যন্ত। মিলিকে দেখলে রাস্তার উপর থেকে সরে পথ করে দেয় তারা। হাত তুলে মাথা নোয়ায়। সালাম ঠুকে। একটু অন্যায় হয়ে গেলে ইনিয়ে-বিনিয়ে কৈফিয়ত দেয়। বেশি অপরাধ হয়ে গেলে মাফ চায়। আবার বেতন বোনাসের জন্য ধরনা ধরে। শুধু কি তাই? প্রজেক্টের সকল ফার্মগুলোর সবুজ বনানীরাও যেনো  মিলিকে দেখলে আরো সজীব হয়ে হেসে ওঠে। তাদের সবারই গায়ে যেনো  মিলির স্নেহ-স্পর্শ লেগে আছে। তারা যেনো  সদা-সর্বদা আগমনের অপেক্ষায় থাকে। মিলি যখন পথ দিয়ে চলে, তারা যেনো  শাখা দুলিয়ে মিলিকে অভিবাদন জানায়। স্নেহাতুরা হয়ে মিলির পরশ প্রার্থনা করে।

হয়তো আমার এসব ধারণা ভুল। হয়তোবা আংশিক সত্যি। প্রজেক্টের বস হলেও অনুভব করি, প্রজেক্টের সবকিছুর উপরে আগে যেমন আমার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, এখন আর তেমনটি নেই। এটাও ঠিক, মিলির আধিপত্য আমার আধিপত্যকে ম্লান করে দিয়েছে। সব কাজেই আমার একটা সিগনেচার করা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

 

প্রজেক্টে জয়েন করার আগে সামাদ সাহেব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর বড় সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। বড় সাহেব আমার পূর্ব পরিচিত। অফিসে ঢুকে দেখি, তিনি সামনে ফাইল নিয়ে কাজে ব্যস্ত….

স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?.....

বড় সাহেব মাথা তুলে সপ্রতিভ হয়ে উঠলেন…..

, পলাশ ! মাই ডিয়ার বয় ! বসো বসোবাম হাতে টেবিলের উপর রাখা পাইপটি টেনে নিয়ে দুঠোটের মাঝে স্থাপন করলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে একটি সোফায় বসে গেলাম।

….আই থিঙ্ক ইউ আর লিভিং ফর সাইট্রাস প্রজেক্ট?

ইয়েস স্যার

রিমেম্বার অলওয়েজ মাই বয় ! ইউ আর নট অনলি আওয়ার রিপ্রেজেন্টেটিভ দেয়ার। ইউ উইল ট্রিট দেয়ার এন ঔনার অফ দ্যাট প্রজেক্ট। টেক এভরিথিং দেয়ার এজ ইফ অল থিংস বেলং  টু  ইউ। দেয়ার, ইউ আর দা ঔনার। ইউ আর আওয়ার রিপ্রেজেন্টেটিভ এন্ড, একটা দা  সেম টাইম - ইউ আর রিসার্চার। ডোন্ট ফরগেট দিস। ইওর প্রমোশন ডিপেন্ডস আপন দিস প্রিন্সিপলস। ওকে?

থ্যাংক ইউ স্যার

গুড লাক দেন….

 

সেদিন থেকে প্রজেক্টের সবকিছু কে আপন করে নিয়েছিলাম। নিজেকে একটা প্রজেক্টের মালিক ভেবে গর্ব করতাম। একজন গবেষক হিসেবে তীক্ষ্ণ মনোযোগ দিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতাম। অবচেতন মনে প্রত্যেক গাছে স্নেহের পরশ বুলাতাম। এমন করে প্রজেক্টের সবকিছুই যেনো  একেবারে আপন হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। সারাদিন ঘুরে এসে রাতে বাংলায় শুয়ে বলতে পারতাম, কোন ফার্মের কোন কোনার কোন গাছটি কেমন আছে।

ইদানিং মনে হয় সবকিছুই যেনো  আমার পর হয়ে গেছে  আমার বলয় পেরিয়ে যেনো  মিলির বলয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। মিলি যেনো  আমাকে পর করে দিচ্ছে। যে প্রজেক্টের সর্বত্র ছিল আমার আধিপত্য, আজ সেখানে আমার আধিপত্য মিলির আধিপত্যের আড়ালে ঢাকা পড়েছে তাই মাঝে মাঝে হিংসে হতো মিলিকে দেখলে।

কিন্তু হিংসার জন্ম হয়ে তার আবার সাথে সাথেই মৃত্যু ঘটতো। ভালোবাসার দ্যুতির কাছে আমার হিংসের তেজ নিষ্প্রভ হয়ে যেত। এটা হয়তো মিলির যোগ্যতা অথবা প্রজেক্টের প্রতি তার ভালোবাসার প্রতিফলন।

 

তিন দিন পেরিয়ে চতুর্থ দিন এসে গেলো। মিলি এলো না।

চতুর্থ দিন পেরিয়ে পঞ্চম ষষ্ঠ এবং পরপর চৌদ্দ দিন কেটে গেলো। মিলি এলো না। প্রথমে একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। অফিসের দায়িত্ব ফেলে মিলি কিভাবে এমনভাবে বিনা নোটিশে ছুটিভোগ করছে ! কিন্তু চৌদ্দ দিন কেটে যেতেই মনটা ভালো হতে থাকলো। আমার দায়িত্ব পালন করার সাথে সাথে মিলির দায়িত্বটুকুও পালন করতে হলো। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রজেক্টের সবকিছুর সাথে আমাকে একাত্ম হতে হলো। সবকিছু যেনো  আবার ধরা দিল। আমি আবার পূর্বের প্রশান্তি ফিরে পেলাম। তখন কেন যেনো  মনে হতো, মিলি না আসলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু দীর্ঘ চৌদ্দ দিন পর রোববারের সোনা-ঝরা সকালে মিলি রুবি এলো।

সবেমাত্র ব্রেকফাস্ট সেরে উঠে দাঁড়িয়েছি। রুবি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলদাদু ভাই ! আপু এসেছে ! উফ! কতদিন ধরে আপনাকে দেখিনি !....

মিলি এসে চুপ করে বসে পড়লো। মুখে কোন কথা নেই। ম্লান, সৌম্য মূর্তি।….

কি মিলি ! এমনভাবে পালালে? একটু ইনফর্মেশন দেওয়ার দরকার মনে করলে না !

ইনফর্মেশন নেয়ার কে- বা আছে?

অফিসের যা কাজ ! আমাকে একা রেখে ফেলে গেলে। অফিস সামলাবো, না তোমার খবরা-খবর নেব।

থাক, ভণিতার প্রয়োজন নেই। এসে গেছি।

অসুখ-টসুখ করেছিল নাকি?

রুবি চেচিয়ে উঠলো….. দাদুভাই ! আপুর চেহারা দেখেও কি বুঝতে পারেন না? ঢাকা যাওয়ার তিনদিন পর খালাম্মাদের বাসায় আপুর সে-কি জ্বর !

- তাই নাকি?....

মিলি চুপ করে রইলো

…..এখন কেমন?

….মোটামুটি ভালো

দুটো লোক দুটো বোঝা এনে ভেতরে পারবো।

….আরে এগুলো আবার কি ?....

মিলি মৃদু হাসে।

একটু পরে একটি ছেলে স্ট্যান্ড ওয়ালা একটি পিতলের বড় কেরোসিন ল্যাম্প এনে আমার পাশে রাখলো। লোকগুলো সব চলে গেলো।

মিলি বোঝা গুলো খুললো। ছোট্ট একটা প্যাকেট আমার পাশে রাখলো। অন্যান্য জিনিস পত্র একটা একটা করে নামালো। এটা সেটা সব ঘর-কন্যার জিনিস ঘর-সাজাবার জিনিস।

প্যাকেট খুলে একটি পাজামা একটি পাঞ্জাবি সামনে রাখলো…..

দেখুনতো কেমন হয়েছে? পছন্দ হয় নাকি?....

আমি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম।…..

আর এই দুটি শার্টের পিস। দুটি প্যান্টের পিস।

রুবি মাহবুবের সন্ধানে নিচে নেমে গিয়েছিল। হয়তো নৌকা চালানোর বাতিক ধরেছে।….

মিলি, এসবের কি কোন মানে আছে?

কেমন?

এত খরচ করার কি দরকার ছিল ! তোমাদের পয়সা হয়তো বেশি !.....

ঠাকুরের পায়ে পুজাই যথার্থ। এগুলোতো সামান্য প্রসাদ। আর, যার ছায়াতলে আশ্রয় পেয়েছি, আমার সবকিছুই তো তার।

মিলি, তোমাকে একটা কথা বলা দরকার

কি কথা?

আমার কথা, তোমার কথা।

আমার কথা আমার জানা আছে। আর আপনার কথা শোনার সময় কই? আমাকে এগুলো গোছাতে হবে।…..

মিলি হাসে। ওর সারামুখে দীপ্তি ছড়িয়ে। ছোট ছোট দাঁত। মুক্তোর মতো। দু ঠোটের ফাঁকে।

……জানেন? এবারে ঢাকাতে কোন কোন জায়গায় গিয়েছি?..... মিলি আমার দিকে তাকালো, …

…..আরে - মাথা নিচু করে ভাবছেন কি ?.....

থতমত খেয়ে বললাম, …. না, কিছুই না।…..

জানেন কোথায় গিয়েছি?

কোথায়?

মিরপুরের মাজারে, হাইকোর্টের মাজারে।

কেন?

কেন, আবার কি ! মাজারে মানুষ কেন যায়?

তা তো জানিনা !

আচ্ছা আপনার নাকে মুখের চেহারা এমন হয়েছে কেন? একটু হাসুন না দেখি !

.. হ্যাঁ কেন গিয়েছিলে?

দোয়া করার জন্য। প্রাণভরে কেঁদে কেঁদে দোয়া করেছি।

দোয়া কার জন্য?

কার জন্য আবার? নিজের জন্য। আপনার জন্য। আমার সেবার সুযোগ আপনার শান্তির জন্য।

লজ্জায় মিলির চোখ-মুখ ছেয়ে গেলো। নিচে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ কি যেনো  ভাবলো। পরে ধীরে ধীরে চোখ তোলে আমার দিকে তাকিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো…..

আচ্ছা বলুন তো আজকে কি পন করেছেন নাকি হাসবেন না?

না, তা তো নয়। ……আমি হাসতে চেষ্টা করলাম।

মিলি কোমরে আঁচল প্যাঁচালো। ঢাকা থেকে আনা জিনিস দিয়ে ঘরটাকে পরিপাটি করে সাজালো। ঘরকন্নার জিনিসগুলো এক এক করে শোকেইসে আলমারিতে রেখে দিল। মিলির চোখে আনন্দ।

এক সাগর আনন্দ। চোখের কোনে আনন্দাশ্রুর সিক্ত ভাঁজ।

 

মাহবুবের দেয়া চায়ে শরীরটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। ঘুমের জড়তাও কেটে গেলো। কিন্তু স্বপ্নের ভিতি জড়তা বুকের মাঝখান থেকে সরে যাইনি। মনে হলো কাউকে বললে ভালো হতো। বুকটা একটু হালকা হতো। মিলি যদি সময়টা আসতো ! তাতো আর সময় নেই। কাল সকালেই আসবে। মাঝখানে একটি রাত। সতেরো আঠারো ঘন্টা সময় !

অনেক দীর্ঘ সময়। একটি বছরের মত !

সময়ের চাকা গড়িয়ে চলল। একটি রাত পেরিয়ে সূর্য পুবাকাশে আলো ছড়ালো।

ব্রেকফাস্ট সেরে মিলিদের অপেক্ষায় বসে রইলাম।

বেলা এগারোটা বেজে গেলো। মিলিরা এলোনা। মনের মাঝখানে মিলির জন্য চাপা-বিরহ অনুভব করলাম। হয়তো সবখানেই মিলি তার আসন পাকাপোক্ত করে বসে আছে। হৃদয়ের অপ্সরী হয়ে আমার অনুভূতির চার দিকে আচ্ছন্নতার জমাট কুয়াশার আবরণ গড়েছে। অধিকারের দাবি নিয়ে আমার উপরে প্রভাব বিস্তার করেছে। নিজের ব্যক্তিত্বের বলয় সৃজন করে আমার ব্যক্তিত্বকে আড়াল করে দিয়েছে।

 

 

একখণ্ড মেঘ এসে সূর্যটাকে ঢেকে দিল। উপরের সূর্য বন্দি হলো। নিচের পাহাড়ে ছায়া নেমে এলো। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী থেকে সূর্যের চকচকে ঔজ্জ্বল্য বিলুপ্ত হলো। প্রখর রৌদ্রের রুদ্র তাপের প্রস্থানে শীতল-শ্রান্তি এলো। অপরাহ্নের পূর্বের এই মুহূর্তটাকে বড় আপন মোহনীয় মনে হলো। পাহাড়, পাহাড়ের সবুজ বনানী, নদীর কাকচক্ষু পানি, পানি ঘেঁষে লাল হলদে বনফুলের মেলা, বাংলোর ঘাট - সব কিছুকেই নিজের মোহনীয় বলে মনে হলো। সকালের মেঘাকীর্ণ আকাশটাকে বিকেলের আকাশ বলে মনে হলো। উপরের মেঘের ছায়া ঘাটের ধাপ গুলোর উপরে লেফটে যেতে লাগলো। হঠাৎ করে মন থেকে একটা ইচ্ছের কলি বেরিয়ে এলো - আহা ! সময় যদি ঘাটের উপরে মিলিকে দেখতাম !  মিলির কথা মনে পড়াতে আর একটি স্মৃতি চোখের রেটিনাতে ভেসে উঠলো।

 

পরের রোববারের সকালে অফিসের কাজে মহাকুমা শহরে যেতে হবে। মিলিকে বলে রেখেছিলাম, তারা যেনো সকালে না এসে বিকেলে আসে।

মহকুমা শহর থেকে ফিরে দুপুরে একটু ঘুমুনোর চেষ্টা করলাম। ঘুম আসছিল না। টেপ রেকর্ডারে বনি এম এর লং প্লেটাকে কম ভলিউমে অন করে সাপ্তাহিকবিচিত্রাপড়ছিলাম। বিকেল চারটে হয়ে গেছে প্রায়। একটু পরে মিলিরা এলো।

…..দাদু ভাই ! কি সুন্দর বিকেল ! বিকেলে নৌকা চালাতে যা মজা হবে না ! আপনারা কথা বলুন, আমি নৌকা চালাতে যাই !

আহ ! বসো  না ! নৌকা চালাতে হবে না। বসে বসে কথা বলো আজ।

বিকেলে কোনদিন নৌকা চালাইনি। আমি মাহবুব চাচা কে নিয়ে নৌকা চালাতে যাই। ওই যে দূরে বড় বড় সাদা ফুল ফুটেছে না ! - ওখান থেকে আপনাদের জন্য ফুল নিয়ে আসবো…, রুবি দূরে নদীর পানি ঘেঁসে ভাসমান কতগুলো বন্যলতার ফুল দেখালো।

….ঠিক আছে চা খেয়ে যাবে।

এসে খাবো। এই আপু, আমার চা-টা ফ্লাস্কে রেখে দিস।….

রুবি চলে গেলো। মিলি আমার দিকে তাকালো। মিলির ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি লেপ্টে

চা খাবেন?

তাতো খেতেই হবে !

কিন্তু চায়ের সাথে.... আমি কিন্তু আজ কিছুই আনতে পারিনি। বাড়িতে মেহমান ছিল।

এটাসেটা এনে এনে আমাকে আর কত লজ্জা দেবে মিলি?

কি যে বলেন ! প্রতিদিন এনে এনে খাইয়ে আমি লজ্জা দিচ্ছি?

তা নয়তো কি?

আপনি এমন করে ভাবতে পারলেন? জানেন পুরুষের জন্য কিছু একটা করতে পারলে কতটুকু আত্মপ্রসাদ লাভ করে মেয়েরা? আর তৈরি করে খাওয়াতে পারলেতো আনন্দের সীমা পরিসীমাই থাকে না। মনের তৃপ্তির পাত্রটি টুইটুম্বুর হয়ে ভরে ওঠে।….

টেবিলের উপরে রাখা বিচিত্রার উপরে চোখ দুটোকে শান্ত করে রাখে মিলি। বাংলোয় বসে থেকেও যেনো  কোথায় হারিয়ে গেছে।

মহাকুমা শহর থেকে আসার সময় একটা ফ্র্রুটকেক এনেছিলাম। আলমারি থেকে বের করে মিলির সামনে রাখলাম।

আরে ! এটা আবার কোথায় পেলেন? বাহ ! খুব সুন্দর তো? ঠিক আছে, আমি চা বসিয়ে দেই? আপনি এই বিচিত্রা নিন।….

চা বানাতে গিয়ে মিলি সমস্যায় পড়লো। কলসিতে পানি নেই। যতটুকু পানি আছে, তা খেতেই লাগবে। কেটলি কাপ পিরিচ ধুতে আরো পানির দরকার। মিলি শাড়ির আচল খানা টিতে পেঁচাতে লাগলো।….

আমি নিচ থেকে পানি নিয়ে আসি…..

আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, ….. আর কথা আছে? নিচে টিউবওয়েল টা যে নষ্ট !

খাবার পানি আছে। ধোয়া-মোছার জন্য নদীর পানি হলেই চলবে।

আমি দেখি মাহবুব টা কোথায় গেলো !

ব্যস্ত হতে হবে না। আমার অভ্যাস আছে।….. মিলি হাসলো। ঠোঁটে মিষ্টি-আভা ছড়িয়ে।

পায়ের সেন্ডেল দুটোকে একপাশে সরিয়ে পারবো মিলি। কলসির পানিটুকুকে একটি পাত্রে রেখে দিল। হাতে কলসি নিয়ে নিচে চলে গেলো মিলি।

বিকেলের নিস্তেজ হয়ে যাওয়া পশ্চিম আকাশে হালকা লালের আভা এখনো ছড়ায়নি। ঘাটের দুপাশে চারটে ইউক্যালিপটাস গাছের প্রলম্বিত ছায়া। ঝিরঝিরে বাতাস। নদীতে বাতাস-সৃষ্ট ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের চিকন হাসি। কলসি নিয়ে মিলি ঘাটের প্রথম ধাপে পা রাখলো। সাদা হলদে উজ্জল পা দুটো। পদ্ম ফুলের পাপড়ির মত। কনুই এর উপরে শাড়ির আচল। এক এক করে ধাপগুলো পেরিয়ে মিলি নদীতে কলসি পারবো। উপরের পানি সরিয়ে নিচের পানি দিয়ে কলসি ভরলো। হেঁচকা টান দিয়ে কলসি টাকে বাঁ কাঁখে নিলো।

জানালা দিয়ে আমি তাকিয়ে ছিলাম। চোখে চোখ পড়াতে মিলি হাসলো। ওর চোখে আনন্দের বন্যা। লম্বা বেনি দুটো নিতম্বের নিচে ঝুলে। পরনে সাদা ধবধবে শাড়ি। গায়ে বয়েলের লাল ব্লাউজ। ওপারে আড়ালে নীল আকাশ। পাহাড়ের উপরে শাল-সেগুনের ঘন বন। নদীর-পাদদেশ ঘেঁষে ঝোপ জঙ্গল। ঝোপের উপরে সবুজের মেলা। লাল হলদে নীল বেগুনি অসংখ্য বনফুল। নদীতে শিরিষ বৃক্ষের কাঁপানো ছবি। আকাশের নীল। মিলি দাঁড়িয়ে কাঁখে কলসি নিয়ে। বাম কাঁধের উপর দিয়ে শাড়ির আঁচল খানাকে পেছনে এনে নিতম্বের উপর দিয়ে এক-প্যাচ দিয়ে সামনে কোটির উপরে শাড়ির বাঁধনের সাথে আটকানো। উপরের ডান কাঁধ উলঙ্গ। কাঁধের নিচের বাকিটা শাড়ির চওড়া লাল পাড়ের আড়ালে। বুকের উপরের লাল-হলদে রঙ্গা কন্ঠি গলার নিচ ভাগে আকর্ষণীয় হয়ে। ডান হাত খানা নিচে ঝুলে। বাম হাত খানা কলসির গলা পেঁচিয়ে কোটির উপরে।

কলসি কাঁখে নিয়ে ঘাটের সিঁড়ির উপর একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকালো মিলি। ডান পা বাড়াতেই ওকে অত্যন্ত মনোহরী মনে হলো। আয়ত চোখ দুটি নিয়ে মিলি তাকালো আমার জানালার দিকে। অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছি আমি মিলির মুখের দিকে। হয়তো মোহিত - নয়তো আবেশিত। মিলি ফিক করে হেসে ফেললো। চোখ দুটো বড় করে উপরে তুললো। মুখের হাসিতে আদর-মাখা শাসন মেশালো। ডান হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে মুঠি বানিয়ে উপরে তুলে আমাকে শাসন করার ভয় দেখালো। মুখে ভেংচি কেটে গর্জে উঠল….

লজ্জা শরম খুইয়েছেন নাকি?.... খিলখিল করে অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়লো মিলি। কাঁখের কলসিটি নেচে উঠলো।

….. এই ভালো হবে না কিন্তু ! চোখ ফেরান ! এমন করে তাকালে আমি কিন্তু ওপরে আসবো না।…..

হাসতে হাসতেই মিলি উপরে উঠে এলো।

মিলিকে আমার দেখার ব্যাপারটা মিলি যত সহজভাবে নিলো, আসলে তা সহজ করে নেয়ার কথা নয়। মিলির সৌন্দর্যে আমি এতটুকু আবেশিত হয়ে পড়েছিলাম যে - আমি ভুলেই গিয়েছিলাম - মেয়েদের শরীরের কোন কোন অংশে পুরুষদের দৃষ্টি দেয়া উচিত নয়।  অনেক ক্ষেত্রে তা শোভনও নয়। মেয়েদের ওই বিশেষ অঙ্গগুলো দেখার  অধিকারটুকু শুধুমাত্র স্বামীরই থাকে, যেটা আমার অন্তত জানা উচিত ছিল। মিলির প্রতি আমার অশোভন দৃষ্টিটিকে মিলি সহজভাবে নিয়েছে। এটাই হয়তো স্বাভাবিক। কারণ মিলির হৃদয়ে আমার যে আসনটি মিলি তৈরি করে নিয়েছে, আমার প্রতি মিলির দুষ্টুমির আচরণটুকুকে হয়তোবা সে তার অধিকার হিসেবেই মনে করে নিয়েছে।

মিলির সমস্ত মুখে হাসির দীপ্তিচ্ছটা বিচ্ছুরিত। চা বানাতে বানাতে মিলি যেনো  নিজেকে হারিয়ে ফেলল। টুকটাক কাজের ফাঁকে আমাকে আড়াল করে নিলো। হয়তো মনের অজান্তে সুন্দর একটি স্বপ্নের কথা ভাবছিল। এক সময়ে কাছে এসে ঠোঁটে লজ্জার আবির মিশালো…..

একটা জিনিস আপত্তি করব। দেবেন?

বৈষয়িক হলে এসিউর করতে পারি।

আর যদি বৈষয়িক না হয়?

ভেবে দেখতে পারি।

আমার জন্য কি আপনি এটুকুই করতে পারেন?

হয়তো আরো বেশি। ভনিতা না করে বলেই ফেলো।

যদি না পাই?

কেন? আমাকে কি তুমি এতো ছোট ভাবো?

ছি, তা বলছি নে।

তবে বলেই ফেলো। তোমার কি চাই?

মিলির মুখের হাসি কমে এলো। লাস্যময়ী অবয়বে ভাবের জোয়ার এলো। শাড়ির আঁচলের খুঁটখানা হাতে নিয়ে আনমনে হাতের আঙ্গুলে পেঁচাতে লাগলো। বাংলোর জানালা পেরিয়ে বাতাস এসে ভেতরে মিলির শাড়ির অংশগুলোকে আন্দোলিত করতে থাকলো। মিলির অধরে একটু হাসি এসে ছড়িয়ে পড়লো। লজ্জার ফিনফিনে বাষ্প এসে জড়ো হলো মিলির দুটি চোখের কোনায়। মিলি পাশ ফিরলো। মুখখানাকে আমার  দৃষ্টি থেকে আড়াল করলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে চোখদুটো মেঝেতে নিবদ্ধ করলো। ফিস ফিস করে অতি নম্র কন্ঠে উচ্চারণ করলো,

….আপনাকে তুমি বলার অনুমতি !….

আমি স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে রইলাম। পশ্চিমের দেয়ালের মাতৃময়ী মায়ের মুখখানাকে আমার কাছে অতি বিমর্ষ অনুভূত হলো। হিটলার ইভা ব্রাউনের মৃত্যুর পূর্বেকার করুন দৃশ্য আমার স্নায়ুতন্ত্রের পর্দায় খোঁচাতে থাকলো। আমার অন্তর গাত্রে প্রবল কাঁপুনি অনুভব করলাম। কপাল ফেটে ঘাম নির্গত হচ্ছে - অনুভব করলাম।

মিলি আবার পাশ ফিরে আমার দিকে তাকালো। বিনয়-ভঙ্গি নিয়ে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। অনেকটা মোহিত। অনেকটা আবেশিত।

আমি ভাবলাম অন্য কিছু। এমন একটা কিছু মিলিকে বলি, যা মিলিকে সন্তুষ্ট করতে পারে। মুখে স্বতঃস্ফূর্ততা টেনে এনে হেসে বললাম…..

এটা কি একটা জিনিস হল? তুমি ক্লাস ওয়ান অফিসার। আমিও ক্লাস ওয়ান অফিসার। একই প্রফেশন আমাদের। আর তাছাড়া মনের কাছ থেকেতো তুমি আমার অনেক নিকটের। আমাকে তুমি আপনি বলবে, নাকি তুমি বলবে - তাতো তুমি নিজেই নির্ধারণ করবে।

বিদ্যুতের উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়লো মিলির ফর্সা মুখে। উজ্জ্বল মসৃণ ফর্সা মুখ আরো উজ্জ্বলতর হয়ে উঠলো। খনিকে মিলির দেহ ভাবের আশ্চর্য পরিবর্তন হলো। দেহ বল্লরী কেঁপে কেঁপে চঞ্চলা হয়ে উঠল। চোখে-মুখে আনন্দের সুধারস উপচে পড়তে লাগলো। মেঝে হতে দৃষ্টি তুলে আমার দিকে তাকালো মিলি। ঠোঁট দুটোকে ফাঁক করে খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো…..

ইস ! উনার কাছ থেকে অনুমতি নেব? ড্যাব ড্যাবে ফ্যাল ফ্যাল করে যে শুধু তাকিয়েই থাকে, কিছুই বলতে সাহস করে না - তার কাছ থেকে আবার অনুমতি ? আমার বয়েই গেছে। আমিতো আজকে বাড়ি থেকে আসার সময় ফুল-ডিসিশনটাই নিয়ে এসেছিলাম যে তুমি বলেই ছাড়বো। জানো? ইচ্ছেটা যদিও বুক ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইতো, মুখ ফুটিয়ে বেরিয়ে আনতে তেমন সাহস পেতাম না। ভয় হতো, যদি সব গোল পাকায়ে উল্টে যায় ! তাহলে তো সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাবে ! তখন কোথায় থাকবে আমার স্বপ্ন ! আর কোথায় থাকবে আমার বিধাতা ! আমাকে তখন হারিয়ে যেতে হবে অতলান্ত বিষাদের সায়রে - যেখানে আমার অতৃপ্ত আত্মা শুধু তোমাকে খুঁজে খুঁজে হাবুডুবু খাবে।….

 

তখন পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে উঠেছে।

 

 

পরের রোববারে

এই ভাবছো কি?

আরে, মিলি যে ! এত দেরি করে? কি ব্যাপার? আমিতো অপেক্ষা করতে করতে সারা? তা কখন এলে?

অনেকক্ষণ

আমাকে ডাকো নি যে?……

মিলি তাকিয়ে রইল আমার দিকে। অনেক্ষন ধরে।  নিস্পলক নেত্রে।

... আরে কি দেখছো !

তোমাকে !....

আমি শব্দ করে হেসে দিলাম। আরে, আমাকে দেখছ? আমি আবার যুবরাজ চার্লস হয়ে গেলাম কবে? আরে কি হলো? তোমার আজ হলোটা কি? চেহারা-সুরত যে অন্যরকম লাগে? কেমন ছন্নছাড়া ভাব? চুলগুলো কি আঁচড়াতে ভুলে গেছো? কি হলো? মুখের সামনে বিচিত্রা রাখতে হবে দেখছি….

খাটের উপরে রাখা বিচিত্রার কপিটি টেনে নিয়ে মুখের সামনে স্থাপন করলাম। শব্দ করে হাসলাম। বিচিত্রাটি একটু উঁচিয়ে এর ফাঁক দিয়ে  দেখলাম, মিলি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি আমার খাটের উপরে….

আরে হলো কি তোমার? কথা বলতে চাচ্ছ না কেন? রুবি কোথায়?

ঢাকা গেছে

কোন খারাপ খবর আছে নাকি?...

মিলি মাথা নাড়লো, …না।ঠোঁটে একটু হাসি টেনে আনলো….

চা খাবে?

হ্যাঁ খাবো। তোমাকে একটি কথা বলবো

কি কথা?

আগে চা খাওয়াও। পরে বলবো। বলার জন্য কতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করছি।

তাই নাকি?....

 মিলি এবার হাসে। উদাস হাসি। মাথার উস্কখুস্ক চুল ছাড়া আর দেহটাকে বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে মিলি। পরনে প্রিয় লাল পাড়ের সাদা শাড়িটি। গায়ে হালকা ফিনফিনে পাতলা বয়েলের লাল স্লিভলেস ব্লাউজ। সিক্ত কম্পিত ঠোট জোড়ায় ঘন লিপিস্টিকের উপরে লিপসাইনার এর স্বচ্ছ আবরণ। রসে টইটুম্বুর পাতলা দুটি ঠোঁট। রসের চাপে ফেটে পড়তে চাইছে যেনো উদাস দৃষ্টি। চোখের ভ্রুতে কাজল। চোখের নিচে কাজলের চিকন রেখা। কালো চোখ দুটো দিয়ে আমার দিকে একবার তাকালো মিলি। ঠোঁট মেলে স্মিত হাসলো। কিছু একটা ভাবলো। কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু, কিছু না বলে কেরোসিন স্টোভের দিকে এগিয়ে চলল। মিলির পদক্ষেপ টলটলে। অশান্ত। অনেকটা বিভ্রান্ত। অসাড়। জড়তাগ্রস্ত !

গতকাল দেখা স্বপ্নটার কথা ভাবছিলাম। মিলিকে কেমন করে বলবো। ভাবছিলাম, কেমন করে পাহাড়টা আমার চেতনায় কামনার সুড়সুড়ি দিয়েছে। কেমন করে আমি পাহাড়ের উপরে উঠলাম। কেমন করে অন্য সব পাহাড়গুলো জীবন্ত হয়ে মানবীয় প্রণয় লীলায় মেতে উঠতে চাইলো। আবার - কেমন করে ওদের  প্রণয় লীলা সাঙ্গ হল ! সব ব্যাপারগুলো শুধু অনুভব করা যায়। একান্ত কাছের না হলে কাউকে যে মুখে বলা যায় না ! কারণ অশালীনতার নির্দিষ্ট গণ্ডিতো সভ্য-মানুষকে মানতে হবে !

 

টুনটুন শব্দ করে মিলি চা চড়িয়েছে। কিন্তু, ওর বেশবাস এমন অনিয়ন্ত্রিত কেন?   টির উপরের অংশের শাড়ি খসে পড়েছে। এলোমেলো চুল পিঠের উপরে ছড়িয়ে পড়েছে। উদোম বাহু দুটো কেঁপে কেঁপে ফুলে উঠেছে। স্লিভলেস ব্লাউজের গলার  নিচের লোকাট খোলা-অংশের মসৃন নরম মাংসপেশির অনেকটা বেরিয়ে এসেছে।


চা চড়িয়ে মিলি আমার দিকে তাকালো। কামনার দৃষ্টি ওর। সুগভীর দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে। চোখে কোন পলক নেই। ঠোঁট জোড়া একবার কেঁপে উঠলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছিল মিলি। কম্পিত চঞ্চল নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। শ্বাস-প্রশ্বাসে ওর বুকের উন্নত মাংস পিন্ড দুটি ফুলে উঠে আবার নেমে যাচ্ছে। মাংসপিণ্ড জোড়া ওপরে উঠে, উন্মুক্ত হয়ে আমাকে আহ্বান করছে যেনো লজ্জায় আমি চোখ তুলে আনলাম। গতরাতের স্বপ্নটাকে বারবার মনে পড়তে লাগল। পরিস্থিতিতে আমি কি করবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই কিছু একটা বলতে চেষ্টা করলাম....

ইয়ে মিলি। মানে এখানে এসো। ইয়ে মানে - আমার গতরাতের স্বপ্নটার কথা শুনবে !

মিলি এগিয়ে এলো। ধীর পায়ে। অনেক কষ্ট করে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না যেনো ওর সমস্ত শরীর কাঁপছে। আমি বললাম....

-ইয়ে বসো। তুমি আমার খাটের উপরে বসো। আগে বলতো তোমার কি হয়েছে? তুমি কি অসুস্থ?....

মিলি ধীর পায়ে আমার সামনে এসে খাটের উপরে বসলো। কোন কথা বললো না। গভীর দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। উগ্র দৃষ্টি ওর চোখের সাগরে। প্রচন্ড ঝড়। যৌনতার তপ্ত বাষ্প। ঘাম বিন্দু জমে সিক্ত গাল। টসটসে। হা করা মুখ। সিক্ত ঠোঁট। চকচকে-উজ্জ্বল উগ্র-কামনার তপ্তরসে ভিজে জুবু জুবু।

আমি কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে আমার গায়ের উপরে ভেঙ্গে পড়ে মিলি। আমার বুকের সাথে বুক মিশিয়ে আমাকে পিষিয়ে  দিতে থাকে। আমার গালে ঠোঁটে কপালে তার সিক্ত অধরের রং ছড়ায়। আমার বাহুর নিচে হাত দিয়ে অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার বুকের  উপরে মুখ রেখে কান্নার বান ভাসিয়ে মিলি আর্তনাদ করে ওঠে....

আমাকে বাঁচাও পলাশ ! আমি যে পারছিনে আর ! কতকাল আমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে ! আমি যে আর পারছিনে পলাশ ! বি-কাইন্ড, প্লিজ বি কাইন্ড ! মাই ডিয়ার ! মাই লাভ !...

আমার বুকের উপরে মুখ রেখেই ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে ওঠে মিলি। আমি ত্রস্তে ওকে ছাড়িয়ে নিলাম। খাট থেকে নেমে বাইরে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম।

আমার চোখ দিয়ে জোনাকি পোকার রিনিঝিনি দেখতে পেলাম। স্নায়ুতন্ত্রের চাঞ্চল্য অনুভব করলাম। সমস্ত গা ভিজে গায়ের গেঞ্জি ভিজে যেতে লাগল। কপালের ঘাম গড়িয়ে নিচে পড়তে থাকলো। চোখদুটো ছটপট করতে থাকলো। চোখ মুদে চক্ষুর স্থিরতা আনার চেষ্টা করলাম। চোখ বুজতেই গতরাতের স্বপ্নের ঝড়ের তান্ডব লীলা দেখতে পেলাম। প্রচন্ড ঝড় ! ধ্বংস মুখী ঝড় ! প্রলয়ঙ্করী ঝড় ! সমস্ত পাহাড়গুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে তুলার মত উড়ছে। জমাট আঁধার। আকাশ জুড়ে মধ্য রাত্রির  আঁধার-কালিমা।

 

সিঁড়িতে কারুর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে চোখ খুললাম। দেখি মিলি চলে যাচ্ছে। যৌন মূর্তির ছায়া নেই তার দেহে। নিস্প্রান অসাড় ভাব। অনুতপ্ত-লজ্জায় ছেয়ে গেছে মুখ খানা ওর। আমার দিকে না তাকিয়ে আমাকে কিছু না বলেই চলে যাচ্ছে মিলি। চোরের মত। খুনি আসামির মতো...

মিলি শোন !.... আস্তে করে ডাকলাম মিলিকে। মিলি দাঁড়ালো। আমাকে পেছনে রেখে।

….. মিলি, এদিকে তাকাও….

মিলি ধীরে ধীরে পেছন ফিরলো। চোখ দুটো সিঁড়ির উপরে তক্তপোষে নিবদ্ধ ওর। সমস্ত দেহে ভয় জড়তা।

এদিকে তাকাও !.....

ক্রমে ক্রমে অতি সাবধানে ভীত-ভাব নিয়ে চোখদুটো তুললো। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার ধীরে ধীরে মেঝেতে আমার পায়ের কাছে দৃষ্টি স্থাপন করলো...

মিলি, তোমার একা আসা উচিত হয়নি...

মিলির ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো। চোখ জোড়া এদিক ওদিক করে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে উঠল। মুখে হাত চেপে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল। আমি আরো কিছু বলার আগে মিলি সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে গেলো।

 

তখন আকাশে মেঘ করেছে। প্রবল বর্ষা নামবে হয়তো।

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই

50

Blogger দ্বারা পরিচালিত.