Header Ads

উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব দুই - প্রিয়তমা

  পড়ুন উপন্যাস:  সুপ্রিয়া প্রিয়তমা পর্ব দুই - প্রিয়তমা (ছবিটির নিচে)


নিবেদনউপন্যাসটির প্রেক্ষাপট

আশির দশকের প্রথম ভাগ। তখন মোবাইল ফোন আসেনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিফোনও ছিল না। তখন চিঠির মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতো সবাই। আর গ্রাম-গঞ্জে পাহাড়ি অঞ্চলে বৈদ্যুতিক বাতিও ছিল না। এরকম সময়-পরিবেশে যাপিত জীবনের কল্পকাহিনি  নিয়ে গড়া উপন্যাসটি। আশির দশকের সময়-পরিবেশ অনুধাবন করে উপন্যাসটির সকল পর্ব পড়তে থাকলে নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে। এটি দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বটি না পরে থাকলে পড়ার অনুরোধ রইলো। প্রথম পর্বের লিংকটি এখানে দিয়ে দেয়া হলো https://bengali.pratilipi.com/series/supriya-priyatma-porbo-ek-anuprabesh-by-iqbal-jafu-abmqnd4trcwo

 

উপন্যাস: সুপ্রিয়া প্রিয়তমা

পর্ব দুই - প্রিয়তমা

মহিলাটির চোখ দুটি ডাগর ডাগর। প্রশস্ত। ভাসা ভাসা। ড্যাব-ড্যাবে। চোখের নীলাভ সাদা পটের মধ্যিখানে উজ্জ্বল গভীর তারা। অজস্র আনন্দের শ্বেতক্ষেত্রে ঘনীভূত মায়ার বলয় যেনো! সোনালী চুল। পরিপাটি। গাঁয়ে লতাপাতা-প্রিন্টের লম্বা কামিজ। উন্নত নাক। লম্বাটে চোঁয়াল। মায়া ভরা মুখ। ফালি ফালি ঠোট। ঠোঁটের কোণে উজ্জ্বল দীপ্তি। প্রশ্বস্থ কপাল। গৌর রং। সৌম্য কান্তি। একটি নারী মুখের পুত-পবিত্র সৌন্ধর্য্য!

মহিলাটি মা। তনময় দৃষ্টি। কোলে জড়ানো ছোট্ট শিশুর কচি মুখের উপর। ডান স্তনটি উদোম হয়ে শিশুটির রক্তিম মুখে। দুধ পানরত শিশু। গায়ে জড়ানো নীল তোয়ালে। রাঙ্গা পা দুটি তোয়ালের বাইরে। মা-শিশু মিলে একটি মাতৃত্বের ছবি। কোন এক শিল্পীর আঁকা একটি তৈলচিত্র।

মাতৃত্বের এই ছবিটি বাংলোর পশ্চিম দেয়ালের সাথে সাঁটানো। মাতৃত্বের দুপাশে সারি সারি বাঁধানো আরো কয়েকটি ছবিপাহাড় ঘেঁষে উদীয়মান লাল সূর্যএঁকেবেঁকে চলমান নদীতীরের শ্যামল গ্রামনীল আকাশে উড়ন্ত বলাকামধুপান রত বিচিত্র রঙের প্রজাপতিবাঁশবাগানের ফাঁক দিয়ে রুপালি পূর্ণিমার চাঁদ…, আর গাছের আবডালে বসা সোনালী পুচ্ছের নীল ময়ূরী।

দেয়ালের পাশ ঘেঁষে সিলিং ধরে একটি প্রকাণ্ড মাকড়সা। কিলবিল করা ছড়ানো পা। বুকে সাদা ডিমের থলি। মাথার দুপাশে প্রকাণ্ড দুটি চোখ। উজ্জ্বল চোখদুটো স্টিমারের সার্চ লাইটের মতো। উত্তরের দেয়ালে সাঁটানো বছরের ক্যালেন্ডার। পাশে পূর্ণতা প্রাপ্ত শুকিয়ে রাখা হলুদ রংয়ের সূর্যমুখী ফুল। চ্যাপ্টা গোল। দিপ্তীময়ী যেনো।

শেফালীকে মাঝে মাঝে সূর্যমুখীর মতো মনে হয় আমার। এটা আমার মনন বিকৃতি হয়তো। মানুষের সাথে প্রকৃতির সৌন্দর্যের মিল খুঁজতে ভালো লাগে আমার। প্রকৃতির রূপের মাঝে মানুষের বোবা রূপ মূর্ত হয়ে বেজে ওঠে যেনো। ঝংকার দিয়ে দিয়ে। বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির সাথে মানুষের অঙ্গসৌষ্ঠব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। দীপ্তি ছড়ায় চারদিকে। সৌন্দর্যের ঢেউ তোলে আমার চোখে। শরতের বৃষ্টি শেষে ফুলেরা যখন দলবেঁধে হেসে উঠে, - তখন হাতধরে নৃত্যরতা লাস্যময়ী একদল তরুনীর তরঙ্গায়িত হাসির মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনা আমি। তখন, ফুল তরুণী,  উভয়ের জীবনের যেনো সুন্দর একটি মিল খুঁজে নেই আমি! উভয়ের উদ্দেশ্য যেনো একই - প্রকৃতিকে আরো আনন্দময়ী করা। উভয়ের গন্তব্য যেনো একই,  একই বিন্দুতে।

মেয়েদেরকে তাই ফুল এর মতো অনুভব করি আমি। চেয়ে থাকি কখনো তন্ময় হয়ে ওদের কুসুম-কোমল মুখের দিকে। শেফালী তাই মাঝে মাঝে চোখ দুটো উপরে তুলে মুখে আশ্চর্য ফুটিয়ে বলে, - একি! খেয়ে ফেলবে নাকি! কেমনতর বেশরম!..... আমি তাকিয়ে থাকি। একনজরে। পলকহীন! শেফালী কাঁচ ভাঙ্গা শব্দে হেসে ওঠে। তড়িৎ এগিয়ে আসে আমার কাছে। আমার চোখ দুটোকে হাত দিয়ে চেপে ধরে। বলে, ….

এই ভালো হবেনা কিন্তু! এমন করলে এখান থেকে চলে যাব আমি!

চলে যাবে?

তা নয়তো কি? তুমি এভাবে গরুর চোখে তাকিয়ে থাকলে

গরুর চোখে? তবে রেশেফালিকে প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরি আমি। ওর বুকের মাংস আমার বুকের পাঁজরের সাথে পিষতে থাকে। ওর পাঁজরের হাড়গুলো ঘষে ঘষে এদিক ওদিক সরে যায় হয়তো। ককিয়ে ওঠে, ….

! মেরে ফেলবে নাকি? ….  শেফালী ঝাপটা মেরে আমার হাত দুটো কে সরিয়ে দেয়। নিজেকে মুক্ত করে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। আমার চোখে চোখ রেখে মিষ্টি হাসে।  ধীরে ধীরে আবার আমার কাছে ঘন হয়ে আসে। আমার বুকের কাছে মুখ রাখে। আমি দুই হাত দিয়ে শেফালির মুখখানাকে উঁচু করে ধরি। তার মুখের কাছে মুখ রাখি। পেয়ালায় মুখ রাখার মতো তার ঠোঁটে ঠোট রাখি। প্রবল তৃষ্ণার্তের মতো অমৃত সুধা পান করি। উহ!… শব্দ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় শেফালী। একটু দূরে সরে গিয়ে ঠোঁটে আংগুল রাখে। …. কি দুষ্টু রে বাবা, একেবারে ফাটিয়ে দেবে যেনো! …

শেফালিকে সূর্যমুখীর মতো মনে হয় আমার কাছে। ওর মুখ খানা সূর্যমুখীর মতো গোল। ভাষা ভাষা ডাগর ডাগর চোখ। প্রশস্ত কপাল। সুঁচালো নাক। চওড়া মুখমণ্ডল। মাংসল গাল। কমনীয়। মসৃণ। উজ্জল শ্যামা বর্ণের শরীর। শ্যামল গাঁয়ের মতো। মায়াবী। আদুরে।

অফিসের পিয়ন মাহবুব এসে একখানা চিঠি দিয়ে গেলো, … স্যার ঢাকা হেড অফিস থেকে চিঠিখানা এসেছে।…. হাত বাড়িয়ে চিঠিখানা হাতে নেই। চিঠিখানা বড় সাহেবের কাছ থেকে। প্রজেক্টের কাজের সুবিধার জন্য বড় সাহেবের কাছে একজন সহকর্মী চেয়েছিলাম। তারই উত্তরে বড় সাহেবের চিঠি, …. প্রজেক্টের কাজের সুবিধার্থে একজন অফিসার নিয়োগ করা হলো। দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে রিপোর্ট করুন।

নির্জন এলাকা। ভালোই হলো। অন্তত অবসরে কথা বার্তা বলা যাবে। আজ তেরো। একদিন পেরুলে পরশু পনেরো। এরই মধ্যে এসে যাবে হয়তো। তার থাকার জন্য আর একখানা ঘরও দরকার হতে পারে। ঠিক আছে,  সময়ে ভাবা যাবে।

মনটা কেন যেনো একটু হালকা হলো। উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে বসলাম। বাংলোর ব্যালকনি। অনেক পুরনো বাংলো। ছিল কোন এক চা কোম্পানীর। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের সম্পত্তি হয়ে গেলো। বাংলোটিকে ঘিরে প্রজেক্টের অফিস। উত্তর পূর্ব দিকে প্রজেক্টের ফার্ম। কমলালেবুর প্রজেক্ট। বাংলোর পূর্ব দিকে ব্যালকনি। ক্যাকটাস ক্রিসমাসের টব দিয়ে সাজানো। এখান থেকে আমার অফিসটি দুশো গজ উত্তরে। ইউ টাইপের অফিস বিল্ডিং। সামনে প্রস্বস্থ লন। লনের মাঝ বরাবর সরু রাস্তা। নাইন--ক্লক ফুলের লতা দিয়ে সাজানো রাস্তার দু পাশ। বাংলোর দক্ষিনে নদী।  আর নদীর ওপাড়ে পাহাড়।

নদীর কথা মনে হতেই ঘাটে যাওয়ার ইচ্ছে হলো আমার। বাংলোর দক্ষিনে নদীর পানি ছুঁয়ে সাদা পাথরের তৈরি বাংলার ঘাট। ঘাটের দু'পাশে সিংহ মূর্তি খচিত দুটো ঢেলাঞ্চি। একটিতে এসে বসলাম।

এখান থেকে নদী পাহাড় ছাড়া কিছুই দেখা যায়না। নদীটি পশ্চিম দিকে বাংলোর দক্ষিণ ঘেঁষে উত্তরে বাকিয়ে আর একটি পাহাড় ঘেঁষে সোজা পূর্বদিকে চলে গেছে। দক্ষিণের পাহাড়টি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। শাল-সেগুন-মেহগনি শিশু গাছের ঘন পাতা দিয়ে ঢাকা। সমস্ত পাহাড় জুড়ে ঘন সবুজের মেলা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বহমান নদী। নদীর বুকে ছোট ছোট ঢেউ। কাগজের ঠোঙার মতো হয়ে দৌড়ে দৌড়ে নদীর উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে যেনো। অপ্রশ্বস্থ নদী। কাকচক্ষু পানি। স্রোতস্বিনী অথচ শান্ত।

শেফালীদের দীঘিতেও চপল বাতাস খেলা করে। সে দিঘির উত্তর পাড়েও এমনি একটি ঘাট আছে। সে ঘাটের সাথে স্মৃতি বিজড়িত আমাদের জীবনের সোনা ঝরা মধুর মুহূর্তগুলোর নীরব সাক্ষী সে ঘাট। সে ঘাটের প্রতিটি কনার সাথে আমাদের সুখ ফোয়ারার প্রতিটি বিন্দু মিশে আছে যেনো। লাল সালুকে ভরা সে দিঘী। উত্তর পাড়ের ঘাটটিতে বসতাম আমরা। মধ্যরাত্রির কাছাকাছি। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। দিঘির উপরে ভেসে ভেসে হাসি ছড়াচ্ছে রুপালি চাঁদ। আমাদের হৃদয়েও জ্যোৎস্নার প্লাবন বউয়েছে যেনো। আনন্দে উচ্ছাসে কামনার মধুর রসে পরিপূর্ণ দুটি মন। শেফালির ডান হাতটি আমার বাঁ হাতের মুঠোয়। আমার বুকের সাথে মিশে ওর বুক। হৃদপিন্ডের প্রান্ত ছুঁইয়ে যেনো। একসময়ে আমার মুখের কাছে মুখ এনে বলে, ….এই শোনো! …. আমার দৃষ্টি দিয়ে আমি শেফালীর দৃষ্টির সাথে সরল রেখা টানি,  বলি,….

প্রজেক্টে থাকাকালীন আমার কথা মনে পড়ে?

কেন নয়?

আমি যে কালো?

ছি! কে বলে তুমি কালো। ওই চাঁদের চাইতেও চাইতেও তুমি সুন্দর। চাঁদে কলঙ্ক আছে, তোমার তো কোনো কলঙ্ক নেই। ….. ওকে বুকের সাথে আরো জোরে চেপে ধরি আমি। আবেগে কন্ঠ জুড়িয়ে আসে আমার। শেফালী তুমি আমার হৃদয়ে অক্ষয়! অমর! প্রেমের প্রতিমা! স্বপ্নের ডাহুকী!.... আমি ওর নরম গালে চুমু খাই। চুমুতে চুমুতে সারা মুখে কাজল কাজল মায়া ছড়াই। স্নিগ্ধ শান্তিতে চোখ জোড়া বুঝে আসে ওর। আমাকে প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরে। আমার কাঁধে প্রবলভাবে মুখ খানাকে ঘষতে থাকে। …. আমাদেরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে শীতল বাতাস ঘূর্ণি খায়। ওধারে জড়ো হয়ে কুণ্ডলী পাকায়। এরপর নেচে নেচে অনেক দূরে চলে যায়। আমাদের থেকে দূরে। অনেক দূরে। আনন্দে নেচে নেচে!

আমি একজন উদ্যানতত্ত্ববিদ। বাগান নিয়ে চর্চা করি। গাছেদের সবুজ গায়ে হাত বুলাই। ফুল ফোটাই। ফল ফলাই। এটাই আমার কাজ। প্রয়োজনে আনন্দে। সবুজের আনন্দে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। সুখ পাই। গান গাই। আনন্দের প্রস্রবণে অবগাহন করে ভেসে বেড়াই। জীবনকে ধন্য করি!

একদিন মা বাবাকে বললেন, …. ওগো, শুনেছি পাশের গ্রামের চৌধুরী সাহেবের নাকি একটি মেয়ে আছে? আমাদের পলাশের জন্য নাকি প্রস্তাব পাঠিয়েছে?.... বাবা শুইয়ে শুইয়ে উত্তর দিলেন,  হে …. আনন্দে মার মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললেন, …. শুনেছি উনার পাঁচ ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটাই নাকি সবার ছোট? দেখতেও নাকি লক্ষ্মীর মতো! আমার দেখতে সাধ জাগে গো!

বাবা বললেন,…. দেখবেই তো! চৌধুরী সাহেবের এক মাত্র মেয়ে! বড় আদরের মেয়ে! আমার ছেলের কাছে দেবেন না তো কার কাছে দেবেন! …. গর্বে ফোলা ফোলা বুক নিয়ে বাবা নড়েচড়ে আবার কাত হয়ে শুলেন।

আমার বিয়ের ব্যাপারে মার উৎসাহটা প্রবল ছিল। একদিন আমাদের সংসারে কারবারি হাসেমকে ডেকে মা বললেন, …

চৌধুরী সাহেবের মেয়েটাকে তুমি দেখেছো?

দুপাটি দাঁত বের করে হাসেম হেসে দেয়, …. যে খালাজান। কোনদিনকার মাইয়া! খুব সুন্দর! চৌধুরী সাহেব নাকি ভাইজানরে ইঞ্জিনের সাইকেল দিবো। বিবি সাবের পা থনে মাথা পর্যন্ত সোনাদা মোড়াইয়া দিবো। শেষ মাইয়া তো! বহুৎ আনন্দ করবো!

মা আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলেন। আহাহা.. কত সুন্দর মেয়ে! আল্লাহ বাছাকে বাঁচিয়ে রাখুন! মা তার কল্পনার হাত চৌধুরী সাহেবের মেয়ের মাথায় রাখলেন যেনো!

হঠাৎ একদিন ব্লাড প্রেসারে চৌধুরী সাহেব ওপারে চলে গেলেন। বাবা বললেন, .. আরে চৌধুরীদের আর আগেকার দিন আছে নাকি! আমি পলাশকে মাতাব্বর সাহেবের মেয়ে বিয়ে করাব। ডিসির বোন। বড় খাতির যত্ন পাবে।

মা ব্যথিত হলেন।

মহা ধুমধামে একদিন আমার বিয়ে হয়ে গেলো। শেফালী শিউলি ফুলের সৌন্ধর্য্য নিয়ে পলাশের নিচে আশ্রয় নিলো।

চৌধুরী সাহেবের মেয়েকে আমি কখনো দেখিনি। শেফালির তুলনায় সে কেমন, তাও জানিনা। একদিন বিকেলে চৌধুরী সাহেবের সরকার সাহেব আসলেন আমার কাছে। বড় বিনয় মধুর স্বভাব সরকার সাহেবের। কাতর গলায় আমাকে বললেন,… বাবা, চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। …. সংশোধন করে আবার বললেন, … না না, আমি নিজেই এসেছি। ….

আমি বিনীত দৃষ্টিতে সরকার সাহেবের দিকে তাকালাম। একটা ঢোক গিলে সরকার সাহেব আবার বললেন, … বেগম সাহেবা আমাকে বললেন, সরকার সাহেব, ছেলেটাকে তো আপন করে পেলাম না। তবুও একবার দেখতে ইচ্ছে করে। গিয়ে একবার নিয়ে আসবেন। আমি প্রাণভরে একবার দেখবো।

সরকার সাহেবের অনুরোধ রক্ষা করিনি। ভাঙ্গাচুরা মনে বেদনার তান বাজিয়ে লাভ কি!

এক সপ্তাহের মধ্যেই শেফালী আমার মন প্রাণ জয় করে নিলো। আমার ভাটি মনে প্রেমের জোয়ার আনলো। হৃদয়ের পুষ্পোদ্যানে সুরভিত ফুল ফোটালো। শেফালি আমাকে মোহিত করলো।

মাঝে মাঝে মনে হয়, - শেফালী পৃথিবীর আর সব মেয়েদের চাইতে আলাদা। ওর শরীর মন অন্যদের চাইতে ভিন্ন রকমের। পৃথিবীর আর সব মেয়েদের সৌন্দর্য গুন এক পাল্লায়, - আর শেফালীর ধৈয্য গুন আরেক পাল্লায়। ওকে পেয়ে আমি পৃথিবীর সব কিছুই পেয়েছি। শেফালীর রূপ রস গন্ধ দিয়ে আমি জীবন পূর্ণ করেছি। তাইতো ওকে এতো স্মরণ করি। দূরে থেকেও প্রাণের আবেগ দিয়ে ওকে ভালোবাসি। পত্রের ভাষায় সোহাগের মালা গাথি, … প্রিয়া! প্রিয়তমা! আদরিনী! সোহাগিনী!... বলে সম্বোধন করি। মনে যখন ভাবের জোয়ার আসে, তখন কবিতার মতো ভাষার ছন্দ গাঁথি, …. পত্রের উপরে লাল নীল হলদে কালীর আলপনা আঁকি,…. প্রিয়তমেষু

কেন যেনো মাঝে মাঝে প্রিয়তমেষু সম্বোধন টাকে আমার কাছে পুরনো পুরনো লাগে। তাই প্রিয়তমেষু লেখা চিঠিটাকে ফেলে দিয়ে নতুন আর একটি কাগজ হাতে নেই। আবারো বামপাশের উপরিভাগে আলপনা আখি, … প্রিয়তমা। প্রিয়তমা,… আমার লক্ষ্মী প্রিয়তমা! …. সহজ সুন্দর সম্বোধন। চার অক্ষরেই হৃদয়ের সব কথা বলা হয়ে যায় যেনো। শেফালীও এই ডাকটি খুব পছন্দ করে। শেফালী বলার পরিবর্তে প্রিয়তমা বললে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। আদুরে আদুরে মুখখানাকে আরো আদুরে দেখায় তখন।

শেফালিকে বহুদিন ধরে দেখিনা। চাকুরে জীবন। বিরহী মন তাই মাঝে মাঝে নিভৃতে কাঁদে। অশ্রু ঝরা মনের বেদনা আমি নিরবে সহ্য করি। ম্যারিড ব্যাচেলরদের এইতো দুঃখ! এইতো বেদনা! সেই বেদনার মাঝেও টুকরো টুকরো সুখের স্মৃতিরা তাদের সপ্তডিঙায় পাল তুলে। আমি তখন হারিয়ে যাই। দূর থেকে দূরে। অন্ত থেকে অনন্তে। শেফালীর হৃদয় সায়রে।

 

 

কোন মন্তব্য নেই

50

Blogger দ্বারা পরিচালিত.